বেকারত্বের বিভীষিকা কম-বেশি সব দেশেই থাকে৷ কিন্তু জার্মানির মতো কল্যাণরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় গুণ বোধহয় এই যে, এখানে ব্যক্তিবিশেষের বোঝা সর্বসাধারণে বয়৷ বেকারত্বের ক্ষেত্রে সেটা বিশেষ করে প্রযোজ্য৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানি শিল্পোন্নত দেশগুলির প্রথম সারিতে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ইঞ্জিন বলা হয় এই দেশটিকে৷ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে জার্মানির খ্যাতি দুনিয়াজোড়া৷ আট কোটি, সাড়ে আট কোটি মানুষের এই দেশ, যার আয়তন বাংলাদেশের দ্বিগুণের কিছু বেশি, সেই দেশ রপ্তানি করে বিশ্বব্যাপী পণ্যের প্রায় দশভাগের এক ভাগ, একাধিকবার রপ্তানিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে৷
এ সব সত্ত্বেও আমাকে জার্মানিতে যা মুগ্ধ করেছে,তা হল তার সোশ্যাল বেনিফিটস সিস্টেম, তার হেল্থ অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার সিস্টেম, তার সোশ্যাল সিকিউরিটি সিস্টেম – এক কথায়, নাগরিকদের জন্য প্রয়োজনে সামাজিক ভাতা বা সামাজিক সুযোগ-সুবিধা৷ আরেকভাবে বলতে গেলে, সমাজ বা সরকার যেভাবে আপদে-বিপদে একক নাগরিকদের, একক বাসিন্দাদের পাশে এসে দাঁড়ায়৷
২০১৬ সালের মার্চ মাসে গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়নে বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম ছিল চেক প্রজাতন্ত্র আর জার্মানিতে: চার শতাংশের সামান্য কিছু বেশি৷ সে তুলনায় এ বছরের সূচনায় গ্রিসে বেকারত্বের হার ছিল ২৪ শতাংশ, স্পেনে ২০ শতাংশ৷ তুলনার জন্য বলা যেতে পারে, গত মার্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ছিল পাঁচ শতাংশ৷
জার্মানিতে পড়তে আসার আগে যা যা জানা প্রয়োজন
প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক বিদেশি শিক্ষার্থী জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা নিতে আসেন৷ জার্মানিতে কম খরচে উচ্চমানের শিক্ষা পাওয়া যায়৷ তবে জার্মানির উদ্দেশ্যে বিমানে চড়ার আগে শিক্ষার্থীদের কিছু বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন৷ পড়ে নিন সেগুলো৷
ছবি: DW
টিউশন ফি নেই, তবে
জার্মানির ১৬টি রাজ্যের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো টিউশন ফি নেই৷ এটা সত্য৷ তবে এক্ষেত্রে শর্ত প্রযোজ্য৷ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সুনির্দিষ্ট ডিগ্রি প্রোগ্রামে আবেদন করলে বিনা খরচায় পড়ার সুযোগ আছে৷ সেক্ষেত্রে স্থানীয়রা যেসব শর্ত মনে লেখাপড়া করে, বিদেশিদেরও সেগুলো মানতে হবে৷ ‘স্টাডি এবরোড’ প্রোগ্রাম এবং প্রাইভেট ইন্সটিটিউটে পড়াশোনা ফ্রি নয়৷
ছবি: Fotolia/Janina Dierks
বেশি কাজের মানসিকতায় লাগাম টানুন
একজন বিদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে পড়ালেখার ফাঁকে আপনি কতটা কাজ করতে পারবেন, সেটা নির্ধারণ করে দেয়া থাকে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ-র কোনো দেশের পাসপোর্টধারী নয়, এমন শিক্ষার্থীরা বছরে ১২০ দিন পূর্ণদিবস কিংবা ২৪০ দিন অর্ধদিবস কাজ করতে পারেন৷ এছাড়া সেমিস্টার চলাকালে সপ্তাহে ২০ ঘণ্টার বেশি কাজ করা যাবে না৷ ভালো কথা, গোপনে বাড়তি কাজের চেষ্টা করবেন না৷ ধরা পড়লে বড় সমস্যা হতে পারে৷
ছবি: Fotolia/MNStudio
যথাযথভাবে অনুদানের আবেদন করুন
আশার কথা হচ্ছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন অনুদান এবং ফেলোশিপের ব্যবস্থা রয়েছে জার্মানিতে৷ আপনার বিষয় যাই হোক না কেন, আপনি যদি তাতে মেধাবী হন এবং উচ্চশিক্ষার জন্য পরিশ্রমে আগ্রহী হন, তাহলে অনুদানের জন্য আবেদন করতে পারেন৷ ‘জার্মান অ্যাকাডেমিক এক্সচেঞ্জ সার্ভিস’ বা ডিএএডি এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে থাকে৷ তবে অনুদানের আবেদন প্রফেশনালদের মতো হওয়া চাই৷
ছবি: DW
ভিসা জটিলতা
উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে জার্মানিতে পড়তে আসার ভিসা পাওয়া একটু জটিল৷ তাঁদের বেশকিছুদিন সময় হাতে রেখে ভিসার আবেদন করতে হয়৷ আর জার্মানিতে আসার পর মাঝেমাঝেই যেতে হয় ‘আউসলান্ডারবেহ্যোর্ডে’ বা বিদেশিদের জন্য নির্ধারিত সরকারি কার্যালয়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সব কিছুর কপি রাখুন
জার্মানিতে আসার পর আপনি নিয়মিতই বিভিন্ন চিঠি পাবেন৷ এমনকি কবে কবে বাড়ির সামনে কোন কোন ধরনের ময়লা রাখা যাবে, সেটাও জানবেন চিঠির মাধ্যমে৷ বুদ্ধিমানের কাজ হবে সব চিঠি জমা করে রাখা৷ তবে প্রয়োজন অনুযায়ী উত্তর দিতে ভুল করবেন না যেন৷ জার্মানিতে বসবাসের এক বিরক্তিকর দিক হচ্ছে দেশটির জটিল আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া৷ সেই প্রক্রিয়ার অংশ এ সব চিঠি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জার্মান বলতে পারলে অনেক সুবিধা
এটাও সত্য, জার্মানির বড় শহরগুলোতে জার্মান না জেনেও বসবাস করা য়ায়৷ এছাড়া বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ইংরেজিতে পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে৷ তবে কিছুটা জার্মান ভাষা শিখতে পারলে দেশটিতে জীবনযাপন অনেক সহজ হয়ে যাবে৷ আর আপনি যদি পড়ালেখা শেষে জার্মানিতে চাকুরি করতে চান, তাহলে ভাষা জানাটা অনেক জরুরী৷ এক্ষেত্রে ডয়চে ভেলের জার্মান ভাষা শিক্ষা কোর্স আপনাকে সহায়তা করতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নিজেকে নিজেরই সহায়তা করতে হবে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাইভেট কলেজগুলো ব্যয়বহুল হলেও শিক্ষার্থীদের অনেক খেয়াল রাখেন৷ শিক্ষার্থী কোনো ক্লাস ক্রমাগত মিস করে গেলে তাকে তা জানানো হয়৷ ক্যাম্পাসে কখন, কোন প্রোগ্রাম হচ্ছে তাও সুনির্দিষ্টবাবে শিক্ষার্থীদের জানাতে উদ্যোগ আছে৷ জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম৷ কখন, কোথায় কেন ক্লাস হচ্ছে কিংবা কোন প্রোগ্রাম চলছে তার খোঁজ রাখার দায়িত্ব আপনার৷
ছবি: DW
জার্মানদের সঙ্গে থাকুন
জার্মানির বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশি শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা করে থাকে৷ তবে তাদের সেবা নেয়া বাধ্যতামূলক নয়৷ অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেছে দেয়া অ্যাপার্টমেন্ট শিক্ষার্থীর পছন্দ হয় না৷ আশার কথা হচ্ছে, অনেক ওয়েবসাইট রয়েছে যেগুলো থেকে থাকার জায়গা বেছে নেয়া যায়৷ কাজটা কঠিন৷ তবে চেষ্টা করবেন এমন জায়গায় থাকার যেখানে জার্মান শিক্ষার্থীরা থাকেন৷ তখন ভাষা শেখাটা আপনার জন্য সহজ হবে৷
ছবি: Fotolia
আপনি একা নন
শিক্ষার্থী হিসেবে জার্মানিতে বসবাস শুরুর দিকে অনেক কঠিন মনে হতে পারে৷ মনে হতে পারে আপনি একাই বুঝি এত পরিশ্রম করছেন৷ তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আপনার আগেও অনেক আপনার মতোই পরিশ্রম করে জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন৷ তাই নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করতে শিখুন৷ এ জন্য বিভিন্ন অনলাইন ফোরামের সহায়তা নিতে পারেন৷
ছবি: Fotolia/Amir Kaljikovic
থাকবেন, নাকি চলে যাবেন?
শুরুর দিকে জার্মানিতে বসবাস কঠিন মনে হলেও দেশটি ক্রমশ আপনার ভালো লাগতে শুরু করতে পারে৷ অনেকের ক্ষেত্রে এমন হয়েছে৷ ডিগ্রি, চাকুরি আর নিরাপদ জীবন - এসব বিবেচনা করে আপনি হয়ত একসময় জার্মানিতে থেকে যেতে চাইবেন৷ কিংবা থাকবেন নাকি চলে যাবেন সেই দ্বিধায় পড়ে যাবেন৷ সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব আপনার, আমরা শুধু আপনাকে আগেভাবে জানিয়ে রাখলাম৷
ছবি: Fotolia/pressmaster
10 ছবি1 | 10
বেকার ভাতা
আজ আমরা শুধু দেখব, বেকার ভাতা বলতে জার্মানিতে মানুষজন কী পায় ও কখন পায়৷ জার্মানিতে দু'ধরনের আনএমপ্লয়মেন্ট বেনিফিটস বা বেকার ভাতা আছে৷ প্রথমটি হলো আনএমপ্লয়মেন্ট ইনসিওরেন্স বা ইউআই, যা সীমিত সময়ের জন্য দেওয়া হয়, কতোদিনের জন্য, সেটা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার আগের সাত বছরে কতোদিন কাজ করেছেন ও বেকারত্ব বীমার প্রিমিয়াম দিয়েছেন কিনা, তার ওপর৷ বেকারত্ব বীমার প্রিমিয়াম হলো মোট রোজগারের তিন শতাংশ, যার অর্ধেক দেন শ্রমজীবী আর বাকি অর্ধেক দেয় নিয়োগকারী সংস্থা৷ ৪২ বছরের কম বয়সি শ্রমজীবীরা বড়জোর ১২ মাস এই ইউআই পেতে পারেন – তারপর তারা পাবেন আনএমপ্লয়মেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স (ইউএ) বা বেকারত্ব সাহায্য৷ এটি দেওয়া হয় বড়জোর ২৪ মাস অবধি৷
‘হার্টৎস-চার'
হয়ত বেকারত্ব সাহায্য পাচ্ছেন, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়; অথবা চাকরি করেন, কিন্তু পারিশ্রমিক এত কম যে, দিন চলে না৷ তাহলে দ্বিতীয় ধরনের বেকারত্ব সাহায্য বা ইনকাম সাপোর্ট (আয় সাহায্য) পেতে পারেন – জার্মানিতে যা ‘হার্টৎস-চার' নামে পরিচিত৷ এই ভাতাটিকে বেসিক জবসিকার্স অ্যালাওয়েন্স বা চাকুরিসন্ধানীর বুনিয়াদি ভাতাও বলা হয়ে থাকে৷ এটি দিয়ে থাকে তথাকথিত জব সেন্টারগুলি৷ আনএমপ্লয়মেন্ট বেনিফিট-দুই সাধারণত ছয়মাস করে অনুমোদন করা হয়ে থাকে৷
আবার এই ‘হার্টৎস-চার' ভাতা ১২ সপ্তাহ অবধি স্থগিত রাখতে পারে জব সেন্টার, যদি সংশ্লিষ্ট ভাতাভোগীকে শ্রম দপ্তর যে কাজের অফার দিয়েছে, তিনি তা অকারণে প্রত্যাখ্যান করেন; অথবা কোনো পেশাগত প্রশিক্ষণে অকারণে অনুপস্থিত থাকেন; অথবা জব সেন্টারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট কোনো কারণ না দেখিয়ে অ্যাটেন্ড না করেন৷ নয়ত একটি সমৃদ্ধ দেশে ‘হার্টৎস-চার' বলতে অনুদান বোঝায় না: ভাতাভোগী এই ভাতা পাচ্ছেন মানুষ হিসেবে, এ দেশের নাগরিক হিসেবে; সরকার তার কর্তব্য করছেন, কৃপা নয়৷
শিশুদের জন্য
তার প্রমাণ, এই ভাতায় শিশু, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও তরুণ-তরুণীদের জন্য ‘শিক্ষা ও সমাজে অন্তর্ভুক্তি' সংক্রান্ত কিছু কিছু উপাদান রাখা আছে – যাতে তারা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অন্তত কিছুটা অংশগ্রহণ করতে পারে৷ যেমন স্কুল আউটিং বা ফিল্ড ট্রিপ, স্কুলের বইখাতা, স্কুল বাস কিংবা বাসের ভাড়া, স্কুলের খাবার, স্কুলের পর চাইল্ডকেয়ার, স্পোর্ট অথবা অন্যান্য কোনো সময় কাটানোর পন্থা, এমনকি টিউশনের জন্যও এই ‘হার্টৎস-চার' ভাতায় ব্যবস্থা করা আছে৷ আরো বড় কথা, ভাতাভোগীর স্বাস্থ্য বীমার প্রিমিয়াম দেওয়ার দায়িত্বও নিচ্ছে সরকার৷
কাজেই জার্মানির মতো দেশে আসল ঝুঁকিটা হয়ত কর্মহীনতার পরিবর্তে কর্মবিমুখিতা হয়ে দাঁড়াতে পারে৷ ইতিমধ্যেই যারা দীর্ঘদিন ধরে বেকার, তাদের সঙ্গে যুব সমাজের একাংশের কাছে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা কর্মখালির চেয়ে জব সেন্টারে নিয়মিত হাজিরা দিয়ে ‘হার্টৎস-চার' সংগ্রহ করাটাই হয়ত বেশি আরামদায়ক বলে মনে হতে পারে৷
বাংলাদেশেও কি এমন ব্যবস্থা দরকার? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷