জার্মানিতে বাড়ির মালিকরা অনেক সময় ভাড়া বাড়ানো ও ঝামেলা কমানোর জন্য ভাড়াটেদের উঠিয়ে দেন৷ প্রয়োজন হলে আদালতের মাধ্যমেও৷ গত কয়েক বছরে এইভাবে ভাড়াটে উচ্ছেদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
ভাড়াটেদের বিতারণ করতে গিয়ে আদালতের কর্মচারীরা অনেক সময় বিপাকে পড়েন৷ কয়েক মাস আগে পটসডামে এক আদালত কর্মী ভয়ানক এক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন৷ ৫৫ বছর বয়সি ভাড়াটে মহিলা সেলারে ঢুকে একটি কম্বলে আগুন জ্বালিয়ে দেন৷ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়৷ সেই ভাড়াটেকে তখন অবশ্য পথে বসতে হয়নি৷ পাঠানো হয়েছিল হাসপাতালে৷ এর আগে কার্লসরুয়ে শহরে এক ব্যক্তি বাড়ি থেকে বের করার সময় আদালতকর্মীকে গুলি করে হত্যা করেন৷ ‘উচ্ছেদ রোধ কর' উদ্যোগের মুখপাত্র ইউলিয়া শ্মিডবাউয়ার বলেন ‘‘এইভাবে উচ্ছেদ করা মানুষের জীবনের জন্য ঝুঁকি হয়ে দাঁড়ায়৷''
জার্মানিতে ভাড়াটে উচ্ছেদের ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ ‘‘গত বছর সারা জার্মানিতে ২৫,০০০ উচ্ছেদের ঘটনা ঘটে বলে জানান ‘গৃহহীন সাহায্য সমিতির' টমাস শ্পেখট৷ এছাড়া ৪০,০০০ উৎখাতের ঘটনা ঘটে আদালতের অনুমোদন ছাড়াই৷ অভিযোগ আদালতে ওঠার আগে বা মামলা চলাকালে অনেক ভাড়াটে বাড়ি ছেড়ে দেন৷ ২০১০ সালে ২০,০০০টি উচ্ছেদের ঘটনা ঘটে৷ রাজধানী বার্লিনে ২০০৯ সালে ৫০০০-এর কিছু ওপর, ২০১১ সালে প্রায় ৭,০০০ ভাড়াটে বিতারণের ঘটনা ঘটে৷
বাড়ির মালিকরা কেন ভাড়াটেদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেন, তার ব্যাখ্যা দেন ইউলিয়া শ্মিডবাউয়ার৷ ‘‘একদিকে মানুষের পকেটে অর্থ কমে আসছে৷ অন্যদিকে ভাড়াও দ্রুতগতিতে বাড়ছে৷ তাই ভাড়াটে বের করার জন্য অনেক সময় আইনি ব্যবস্থা নেন বাড়িওয়ালারা৷''
বৃদ্ধ বয়সের জন্য আর্থিক নিরাপত্তা
আইনজীবী আলেক্সান্ডার ব্রডেরেকে আরেকটি কারণের কথাও জানান, মালিকরা বৃদ্ধ বয়সের আর্থিক নিরাপত্তার কথা ভেবেও ভাড়া বাড়াতে চান৷ অনেকে বাড়িটা নিজেই ব্যবহার করতে চান বলে ভাড়াটে উঠিয়ে দেন৷
বার্লিনে ভাড়াটেদের অবস্থা আরো সঙ্গিন৷ বর্তমান ভাড়াটেকে বিদায় করতে পারলে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে পরের ভাড়াটে আনতে পারেন বাড়ির মালিকরা৷ এই সুযোগটা অনেকে হাত ছাড়া করতে চান না৷
জার্মানিতে বাড়ি সমস্যায় অভিবাসীরা
অভিবাসীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ তবে বাড়ির সমস্যাকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে ধরা যেতে পারে৷এ সমস্যা জার্মানিতে বসবসারত তুর্কিদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়৷ কারণ জার্মানিতে প্রায় ৪০ লাখ তুর্কি আছেন৷
ছবি: Suzheh.sub.ir
অভিবাসী তুর্কিদের সমস্যা বেশি
জার্মানিতে অভিবাসীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ এগুলোর মধ্যে বাড়ির সমস্যাকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে ধরা যেতে পারে৷ জার্মানিতে অভিবাসীদের মধ্যে তুর্কিদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪০ লাখ৷ কাজেই সমস্যাটাও ওদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শীতকালে ঠান্ডায় কষ্ট পায়
তুর্কিদের সাধারণত বাসা ভাড়া দেওয়া হয় পুরনো এলাকায় বহু বছরের পুরনো বাড়িগুলোয়৷ সেই সব বাড়িতে হয়ত দরজা ঠিকমতো বন্ধ হয় না বা জানালা দিয়ে বাতাস ঢোকে বা খানিকটা খোলা থাকে৷ অথবা শীতকালে হিটার কাজ করে না, অর্থাৎ ঠান্ডায় কাটাতে হয়৷ বাড়ির মালিককে কয়েকবার বলেও ঠিক করানো যায়নি৷ এভাবেই জানান তিন দশক আগে তুরস্ক থেকে জার্মানিতে আসা আহমেদ খালিফি৷
ছবি: DW/C. Ruta
বাড়ির অবস্থা অস্বাস্থ্যকর
আহমেদ খালিফির ছেলে আদেলের বাড়িতেও প্রায় একই সমস্যা৷ বাড়িটি ৪০ বছরের পুরনো হওয়ায় খুবই স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার এবং অস্বাস্থ্যকর৷ এ ব্যাপারে অবশ্য বাড়িওয়ালার মাথা ব্যথা নেই, কয়েকবার বলেও কোনো কাজ হয়নি৷
ছবি: DW/C. Ruta
অবশেষে নিজেই দায়িত্ব নেন
আবদাল ১৫ বছর এ বাড়িতে আছেন, কিন্তু একবারও রঙ করা হয়নি৷ আর সেকথা বাড়ির মালিককে কয়েকবার বলায় তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, প্রয়োজনে তিনি যেন নিজেই এ কাজ করে নেন৷ তাই আবদাল এ কাজ ভালো না জানা সত্ত্বেও নিজেই করছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
শীতের কথা ভেবে ভীত
একটি মাত্র ঘর আর সেখানেই বাচ্চাদের নিয়ে থাকেন আলিয়া৷ ঘরে যেসব জিনিসের জায়গা হয় না, সেসব জিনিস স্থান পেয়েছে বাড়ির বারান্দায়৷ কিন্তু শীতের সময় এসব প্রয়োজনীয় জিনিসের কি হবে – তা ভেবে অস্থির আলিয়া৷ এই অবস্থা অবশ্য শুধু আলিয়ার একার নয়৷
ছবি: DW/C. Stefanescu
অভিবাসীদের বেশি সন্তান
অভিবাসীদের বাড়ির বড় সমস্যা৷ তার কারণ, তাঁরা বড় শহরগুলোর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করতে পছন্দ করেন৷ তাছাড়া জার্মানদের তুলনায় অভিবাসীরা কম রোজগার করেন এবং তাঁদের সন্তান সংখ্যা বেশি হওয়ায় বাড়ি পেতেও অসুবিধা হয়৷ এছাড়া একই ধরণের বাড়ির জন্য জার্মানদের তুলনায় তাঁদের কাছে বেশি ভাড়াও চাওয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZB
বাড়ির অবস্থা করুণ
অভিবাসীদের বাসস্থান সমস্যা অবশ্য নতুন সমস্যা নয়৷ অভিবাসীরা যেসব এলাকায় থাকেন সেই পুরনো বাড়িগুলোকে ঠিকঠাক না করানোয়, দিনদিন সেগুলি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছে৷ এই অবস্থা নিদিষ্ট কোনো শহরে নয়, প্রায় শহরেই এই একই অবস্থা৷
ছবি: Fars
আগুনে পরিবারের আট জনের মৃত্যু
প্রায় চার মাস আগে বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যার্গের বাকনাং শহরে একটি বাড়ির বৈদ্যুতিক লাইন ছিল বিপজ্জনক এবং একথা বারবার মালিককে বলার পরও তা ঠিক করা হয়নি৷ যার ফল হয় মর্মান্তিক৷ ঘর গরম বা পানি গরমের জন্য ব্যবহার করা হতো কাঠের চুল্লি৷ ঐ বাড়িতেই আগুন লেগে একজন তুর্কি মা তাঁর সাত সন্তানসহ মারা যান৷ ছবিতে বাকনাং শহরের কিশোর-কিশোরীরা মৃত পরিবারের প্রতি ফুল আর মোমবাতি দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাড়ি মালিকদের মত
বাড়িওয়ালাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, তুর্কি পরিবারগুলো অনেক বড়, সবসময় হৈচৈ লেগে থাকে এবং তেমন পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন নয়৷ আর সেজন্যই তাঁদের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে কিছুটা আপত্তি থাকে বাড়িওয়ালাদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তরুণদের ভিন্নমত
বয়স্ক অভিবাসীরা বাসস্থানের ব্যাপারে যতটা বৈষম্যের শিকার হন বলে মনে করেন, এই প্রজন্মের তুর্কিরা তেমনটা মনে করে না৷ সম্ভবত এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা জার্মান ভাষা ভালো জানার কারণেই এমনটা ঘটছে৷
ছবি: Suzheh.sub.ir
10 ছবি1 | 10
প্রায়ই সামাজিক ভাতাভোগীরা উচ্ছেদের শিকার হন৷ এক্ষেত্রে অনেক সময় সোশাল সার্ভিস তাদের সাহায্য করে থাকে৷ বাড়িওয়ালা হিসাবে রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলি কিছুটা নমনীয়৷ কিছুটা মাশুল দিলে তাদের ভাড়াটেরা উৎখাতের হাত থেকে রক্ষা পান৷ কিন্তু সমস্যা হলো জার্মানিতে ব্যক্তিগত মালিকানার বাড়িই ৮০ শতাংশ৷ তাদের অনেকেই ভাড়ার ব্যাপারে নমনীয় হতে রাজি হন না৷
মালিক পক্ষেরও যুক্তি রয়েছে
আলাপ আলোচনায় অনীহার ব্যাপারে বাড়ির মালিকদের পক্ষেও যুক্তি রয়েছে৷ বাড়ি মালিক সমিতির কাই ভার্নেকে ডয়চে ভেলের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘জার্মানির বাড়িভাড়া সংক্রান্ত আইনকানুনে ভাড়াটেকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে৷''
আদালতের রায় প্রায়ই ভাড়াটের পক্ষে যায়৷ অনেক ক্ষেত্রে ভাড়াটেকে নোটিশ দেওয়ার পর তাঁর বিদ্যুৎ ও পানির বিল বাড়িওয়ালাকে দিতে বলা হয়৷ তাই বাড়ির মালিকরাও ‘অপ্রিয়' ভাড়াটেকে উঠিয়ে দিতে চান৷ অবশ্য কিছু কিছু বাড়ির মালিক শুধু লাভের জন্যও ‘সস্তার' ভাড়াটেকে উঠিয়ে দেন৷
কারণটা যাই হোক না কেন জার্মানিতে উচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছে৷ সেই সাথে বাড়ছে গৃহহীনদের সংখ্যাও৷ অদূর ভবিষ্যতে এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম৷