জার্মানির মসজিদগুলি মাঝে মাঝেই হামলার শিকার হচ্ছে৷ ইদানীং এই প্রবণতাটা আরো বেড়ে গিয়েছে৷ মসজিদের সামনে শুয়োরের মাথা কেটে ফেলে রাখা হচ্ছে৷ দেওয়ালে আঁকাজোকা, দরজা ভাঙা এমনকি রাতে আগুন জ্বালানোর ঘটনাও ঘটছে৷
বিজ্ঞাপন
বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন, রাজনীতিবিদ ও গবেষকরা তাই এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার কথা বলছেন৷
জার্মান সরকারের নতুন পরিসংখ্যানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, মসজিদগুলির ওপর হামলা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে বছরে ২২টি হামলা হয়েছে মসজিদের ওপর৷ ২০১২ থেকে ২০১৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫/৩৬টি৷ মুসলিম সংগঠনগুলির পরিসংখ্যানেও এই রকম চিত্রই উঠে আসে৷
মুসলিম বিদ্বেষ বৃদ্ধির লক্ষণ
মুসলিম কেন্দ্রীয় পরিষদের প্রধান আইমান মাজিয়েক এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘এটা মুসলিম বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাওয়ার স্পষ্ট লক্ষণ৷'' মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন ও হিজাবপরা নারীদের ওপর সহিংসতার হার যে ভাবে বাড়ছে তা উদ্বেগজনক বলে মনে করেন মাজিয়েক৷
মুসলিমবিরোধী অপরাধকে আলাদাভাবে তালিকাবদ্ধ করা ও মুসলমানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সুরক্ষার ব্যবস্থা করার দাবি জানান মাজিয়েক৷ বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে সহযোগিতার সংকেত আশা করেন তিনি৷ জার্মানিতে চার মিলিয়ন মুসলমান এই সমাজেই সম্পৃক্ত হয়ে বসবাস করছেন৷ পরিস্থিতি এখনও আয়ত্তের মধ্যে রয়েছে৷ কিন্তু কতদিন চলবে এইভাবে? এই প্রশ্ন আইমান মাজিয়েকের৷
বার্লিনের মসজিদগুলো...
জার্মানির রাজধানী বার্লিনে ৮০টিরও বেশি মসজিদ রয়েছে৷ ক্লাসিক বা আধুনিক যে ধরনেরই হোক না কেন, এই মসজিদগুলো বার্লিনের নানা অঞ্চলের এবং নানান সময়ের চিহ্ন বহন করে৷
ছবি: Max Zander
ভারতীয় মডেলে তৈরি
জার্মানির সবচেয়ে পুরনো মসজিদটি হচ্ছে বার্লিনের শহরে কেন্দ্রে অবস্থিত আবাসিক এলাকা ভিলমার্সডর্ফ-এ৷ এই আহমেদিয়া মসজিদটি জার্মান স্থপতি কার্ল আগুস্ট হ্যার্মানের পরিকল্পনায় এবং ভারতের বিখ্যাত ‘তাজমহল’-এর মডেলে তৈরি করা হয়৷ মসজিদটির উদ্বোধন করা হয় ১৯২৮ সালে৷
ছবি: Max Zander
বিতর্কিত মসজিদ
এই মসজিদটি উদ্বোধন করার সময় প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও পরে তা মেনে নেওয়া হয়৷ মেনে নেওয়ার উদ্যোগের পেছনে ছিল হাইনার্সডর্ফের সংগঠন ‘‘হাইনার্সডর্ফ তোমার দরজা খোলো’’ এবং প্রথম ইমাম আবদুল বাসিত তারিকের মোটো ছিল, ‘‘কারো জন্য ঘৃণা নয়, সবার জন্য ভালোবাসা’’ – এই নীতিবাক্য৷
ছবি: Max Zander
ছিমছাম মসজিদ
নারী স্থপতি মুবাশরা ইলিয়াস বেশ সাদামাটাভাবেই এই মসজিদের কাজ করেছেন৷ এখানে ২৫০ জন মুসল্লির নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে৷ মসজিদের প্রধান ঘরটির ঠিক ওপরেই মহিলাদের জন্যও রয়েছে আলাদা ঘর৷
ছবি: Max Zander
সবচেয়ে বড় মসজিদ
বার্লিনের নয়ক্যোলন এলাকার এই মসজিদটিকে মুলমানদের সাংস্কতিক মিলনকেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহার করা হয়৷ বার্লিনের সবচেয়ে বড় এই মসজিদে ১,৫০০ জন মানুষ একসাথে নামাজ আদায় করতে পারেন৷ মসজিদটিতে বিশেষ আয়োজনের জন্য আলাদা জায়গাও রয়েছে৷ ২০১২ সালে জার্মান প্রেসিডেন্ট ইওয়াখিম গাউক তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই মসজিদটি পরিদর্শন করেন৷
ছবি: Max Zander
মুসলমানদের কবরস্থান
মুসলমানের জন্য যে কবরস্থান রয়েছে, ঠিক তার পাশেই ১৯৮০ সালে এই মসজিদ তৈরি করা হয়৷ পরে অবশ্য এটা আরো বড় করা হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে এটির পরিধি৷
ছবি: Max Zander
বিভিন্ন ধর্মের সংস্কৃতি বিনিময়
জার্মানির তুর্কি সম্প্রদায় মানুষরা অন্যান্য ধর্মের মানুষদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করে৷ এখানে ইসলাম ধর্ম এবং অন্যান্য ধর্মের নানা আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা হয়৷ যাঁরা এখানে আসেন, তাঁদের পুরো মসজিদটা ঘুরে দেখানো এবং ইসলাম সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়৷
ছবি: Max Zander
ইসলাম ধর্মের সেন্টার
প্রথম দেখে বোঝাই যায় না যে এটা একটা মসজিদ৷ উমর আল-ইবনে খাতাব মসজিদটি বার্লিনের আবাসিক এলাকা ক্রয়েৎসব্যার্গের মধ্যমণি৷ বলা বাহল্য, এই এলাকা তুর্কি অধ্যুষিত৷ মসজিদের ভেতরে নামাজের ঘরগুলোর আশেপাশে ছোটখাটো দোকান, কফি শপ, ট্রাভেল এজেন্সি ইত্যাদি রয়েছে৷ ২০০৮ সালে শুরু হওয়া এই মসজিদটিতে একটি মাদ্রাসাও রয়েছে৷
ছবি: Max Zander
ওজু ঘর
মাসহারি সেন্টারের মসজিদের বেজমেন্ট, অর্থাৎ মাটির নীচের একটি ঘরে তৈরি করা হয়েছে এই সুন্দর ওজু ঘরটি৷ এখানে পুরুষ এবং নারীরা আলাদাভাবে ওজু করতে পারেন, অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিজেকে বিশুদ্ধ করার ব্যবস্থা রয়েছে এই মসজিদে৷
ছবি: Max Zander
আন্তর্জাতিক কমিউনিটি
ঝাড়বাতির নীচে নামাজের এই ঘরটিতে একসাথে ১,০০০ জন মুসলমান নামাজ পড়তে পারেন৷ তুর্কি বংশোদ্ভূত মানুষ ছাড়াও মসজিদে নামাজ পড়তে আসেন আরব, আফ্রিকান, বসনীয় ও অন্যান্য দেশের মুসলমানরা৷ প্রতি শুক্রবার ঐতিহ্যগতভাবে জুম্মার নামাজ হয় আরবি ভাষায়৷ তবে সকলের সুবিধার্থে দেয়ালে লাগানো মনিটরে আরবি এবং তুর্কি ভাষাতেও পড়ে নেয়া যায় অনুবাদ করা আয়াতগুলি৷
ছবি: Max Zander
9 ছবি1 | 9
জার্মানিতে বিদেশি বিদ্বেষকে রাজনৈতিক অপরাধের আওতায় ধরা হয়৷ কিন্তু ইসলাম বা মুসলমান বিদ্বেষ বলে আলাদা কোনো ক্যাটাগরি নেই৷
২০০১ সাল থেকে প্রতি আড়াই সপ্তাহ পর পর কোনো মসজিদ বা ইসলামি সংগঠন আক্রমণের শিকার হচ্ছে৷ এই তথ্য উঠে আসে মুসলিমদের সমন্বয় পরিষদের এক ওয়েব সাইটে৷ পরিসংখ্যানের বাইরে থাকা সংখ্যাটা আরো বেশি হবে বলে উল্লেখ করা হয় এই সাইটে৷
সমাজের কেন্দ্রে পৌঁছেছে
লাইপসিগ শহরের গবেষক ও চিকিত্সা মনস্তত্ত্ববিদ এলমার ব্র্যালারও জার্মানিতে মুসলিম বিদ্বেষ বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন৷ ইতোমধ্যে তা সমাজের বিস্তৃত অংশ তথা মধ্যবিত্ত শ্রেণিতেও এসে পৌঁছেছে৷ তবে ইসলাম বৈরিতা ইহুদি বিদ্বেষের মতো প্রকট হয়নি এখনও৷ ইহুদি বিদ্বেষ সমাজের গভীরে প্রোথিত৷ জার্মানিতে চরম ডানপন্থি মনোভাব নিয়ে একটি সমীক্ষা সহকর্মীদের সহযোগিতায় লাইপসিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থাপিত করেছেন ব্র্যালার৷ এর সারমর্ম: বর্ণ বৈষম্যের নতুন রূপ হলো ইসলাম বৈরিতা৷ ‘‘প্রতি তিন জনে একজন জার্মান মনে করেন, জার্মানিতে মুসলমানদের অভিবাসন নিষিদ্ধ করা উচিত৷'' জানান সমীক্ষার লেখকরা৷
নতুন কোনো বিষয় নয়
বাম দলের রাজনীতিবিদ উলা ইয়েল্পকে মুসলিম বিদ্বেষ নতুন কোনো বিষয় নয় বলে মনে করেন৷ তাঁর দাবি, ইহুদি বিদ্বেষের মতো মুসলিম বিদ্বেষকেও নিষিদ্ধ করা উচিত৷ জার্মান সরকার বিষয়টিকে ছোট করে দেখছে বলে দোষারোপ করেন তিনি৷ মুসলমানদের রাজনৈতিক ও সামাজিক দুরবস্থার জন্য বলির পাঠা করা উচিত নয়৷ বিষয়টি পারস্পরিক সহাবস্থানের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর৷
ইসলাম আর্কাইভের তথ্য অনুযায়ী জার্মানিতে মিনারসহ মসজিদের সংখ্যা ৭০০ থেকে ৮০০৷ এছাড়া রয়েছে প্রায় ৩০০০-এর মতো দালান, যেখানে মুসলমানরা নামাজ পড়ে থাকেন৷