দক্ষিণ জার্মানির বাভেরিয়া প্রদেশের গার্মিশ-পাটেনকিয়র্শেন শহরে ফ্লোরিয়ান গেজিন-এর ‘ফ্লো'জ গ্যারেজ'-এ বহুমূল্য সব মার্কিন ভিন্টেজ গাড়ির দেখা পাওয়া যাব – কোনোটা সদ্য কলোরাডো থেকে আসা৷
বিজ্ঞাপন
একটি অ্যামেরিকান ওল্ডটাইমার বা ভিন্টেজ গাড়ি – কিন্তু দক্ষিণ জার্মানির বাভেরিয়া প্রদেশে, তাও আবার পর্যটকদের প্রিয় গার্মিশ-পাটেনকিয়র্শেনে৷ ফ্লোরিয়ান গেজিন হেডলাইট রিপেয়ার করছেন বটে, কিন্তু তাঁর মন পড়ে রয়েছে অন্যদিকে৷ আজ একটি ট্রান্সপোর্টারে করে সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নতুন ডেলিভারি আসার কথা: নতুন বলতে দু'টি বিশেষ ওল্ডটাইমার৷
‘ফ্লো'জ গ্যারেজ'-এর মালিক ফ্লোরিয়ান গেজিন জানালেন, ‘‘কলোরাডো থেকে দু'টো গাড়ি আসছে: ১৯৫০ সালের একটি ওল্ডস রকেট এইটি-এইট আর একটি শেভি সি-টেন পিকআপ ট্রাক৷ আমি স্বভাবতই একটু টেনশানে আছি, কারণ দু'টো গাড়িই প্রায় না দেখে কেনা – মানে শুধু ছবি দেখে৷ আমি আমার স্থানীয় এজেন্টকে চোখ বুজে বিশ্বাস করেছি, বলা চলে৷ নিজেই চমকে গেছি৷ আশা করি, গাড়িগুলো সব ঠিকঠাক৷''
ওল্ডটাইমার দু'টির কলোরাডো থেকে গার্মিশ-পাটেনকিয়র্শেনে আসতে চার সপ্তাহ লেগে গেছে৷ প্রথমে জাহাজে করে রটারডাম; তারপর সেখান থেকে ট্রান্সপোর্টারে করে ফ্লো'জ গ্যারেজ অবধি৷ লম্বা রাস্তায় অনেক কিছু ভেঙে কিংবা খোয়া গিয়ে থাকতে পারে৷
প্রথম দর্শন মানে খুঁটিয়ে দেখা৷ ফ্লোরিয়ান গেজিন নিজে মোটর মেকানিক, পুরনো গাড়ি ভালোবাসেন৷ ট্রান্সপোর্টারে প্রথম গাড়িটা দেখে তাঁর প্রতিক্রিয়া: ‘‘দারুণ৷ আমি খুব খুশি৷ খানিকটা আশ্বস্তও৷ আরো একটা গাড়ি আছে৷ সেটাও দেখা যাক!''
পুরনো মার্কিন গাড়ি তো চেনেন, পুরনো রুশি গাড়ি চেনেন কি?
সোভিয়েত আমলের সব পুরনো রুশি গাড়ি দেখার ও চেনার একটা ভালো সুযোগ পাওয়া যায় জুলাই মাসে মস্কোর ওল্ডটাইমার ব়্যালিতে৷
ছবি: C. Braemer
চাইকা
দেখলে মনে হবে যেন পুরনো মার্কিন গাড়ি! সোভিয়েত ইউনিয়নে ষাটের দশকে এই চাইকা ছিল যাকে বলে কিনা চরম বিলাসিতা৷ কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি নিকিতা ক্রুশ্চেভের প্রিয় গাড়ি ছিল এই চাইকা; পার্টির হোমরা-চোমরারা সবাই এই গাড়ি চড়তেন৷
ছবি: C. Braemer
লাডা শিগুলি
প্রখ্যাত ভল্গা অটোমোবাইল কারখানার এই প্রথম মডেলটি তৈরি হয়েছিল ইটালির ফিয়াট ১২৪-এর অনুকরণে৷ গাড়ি বলতে সোভিয়েত ইউনিয়নের খেটে খাওয়া মানুষ এই লাডাই বুঝতেন৷
ছবি: C. Braemer
‘গাজিক’
আসল নাম পিটন গাজ-এ; লোকে ভালোবেসে গাজিক বলত৷ সোভিয়েত ইউনিয়নে এই গাড়িটিই প্রথম অ্যাসেম্বলি লাইনে ‘মাস প্রোডাকশান’ পদ্ধতিতে – অর্থাৎ কারখানায় একসঙ্গে অনেকগুলো করে তৈরি হয়৷ দেখেই বুঝতে পারছেন, গাজিক হলো যুক্তরাষ্ট্রের কিংবদন্তি স্বরূপ ফোর্ড টি-র সোভিয়েত যমজ৷
ছবি: C. Braemer
পোবেদা
পোবেদা নামটির মানে হলো বিজয় – এক্ষেত্রে বিজয় বলতে বোঝাচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের জয়৷ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৪৬ সাল থেকে তৈরি হচ্ছে সে আমলের গোর্কি ও হালের নিজনি নভগরোদ শহরে৷
ছবি: C. Braemer
মস্কভিচ
মস্কভিচ গাড়িটি নাকি জার্মানির ওপেল কাডেট-এর অনুকরণে তৈরি হয়েছিল৷ সোভিয়েত ইউনিয়নে যতো মস্কভিচ গাড়ি তৈরি হতো, তার ৪০ শতাংশ রপ্তানি করা হতো৷ সেই ৪০ শতাংশের অর্ধেক আবার যেতো পশ্চিমে, অর্থাৎ লৌহ যবনিকার অপর পারে৷
ছবি: C. Braemer
ভল্গা
ভল্গা গাড়িটির উৎপাদন শুরু হয় ১৯৫৭ সালে – লোকমুখে এর নাম ছিল ‘পুবের মার্সিডিজ’৷ ইয়ুরি গাগারিনের মতো নভশ্চর আর সরকারি আমলারা এই গাড়ি চড়তেন৷ ১৯৬১ সালে প্রথম মানুষ হিসেবে গাগারিন যখন মহাকাশযাত্রা করেন, তখন সরকারের তরফ থেকে তাঁকে একটি ভল্গা গাড়ি উপহার দেওয়া হয়েছিল৷ গাড়ির ভেতরটা ছিল আকাশের মতো নীল...
ছবি: C. Braemer
জাপোরোশ বা জাপো
পুরো নাম জাপোরোশেজ ৯৬৫ – সস্তার গাড়ি বলে বাজারে নাম খারাপ ছিল৷ কারখানাটি আজ দক্ষিণ ইউক্রেনে৷ ১৯৬০ থেকে ১৯৯৪ সাল অবধি এই ‘জাপোরোশ’ বা ‘জাপো’ গাড়ি তৈরি হয়৷ ১৯৬৭ সাল থেকে প্রচুর জাপো গাড়ি রপ্তানি হয়েছে সাবেক পূর্ব জার্মানিতে৷
ছবি: C. Braemer
7 ছবি1 | 7
পিকআপটাও দীর্ঘ যাত্রাপথ মোটামুটি অক্ষত অবস্থাতেই পার হয়েছে বলে মনে হচ্ছে৷ তবে ‘‘তিনটে মিরর বোধহয় পথে খোয়া গেছে,'' খেয়াল করেছেন ‘ফ্লো'৷ কখনো-সখনো বন্দর কর্মীরাই এটা-সেটা সরিয়ে থাকেন৷
‘ওল্ডসমোবাইল' গাড়িটা প্রথম রেজিস্ট্রি করা হয় ১৯৫০ সালে৷ ১৩৫ অশ্বশক্তির আট সিলিন্ডারের ইঞ্জিনটা বেশ ভালোই আছে মনে হচ্ছে৷ এবার ফ্লোরিয়ানকে গাড়িটা খোলার পন্থা আবিষ্কার করতে হবে – সাথে তো আর কোনো ম্যানুয়াল নেই৷ কিন্থু ফ্লোরিয়ানের মনোভাব হল: ‘‘সেটাই তো চ্যালেঞ্জ, সেটাই তো রোমাঞ্চ৷ প্রতিবার নতুন একটা কিছু৷ রোজ সেই চাকা বদলাও, ব্রেক ঠিক করো নয়; মাঝেমধ্যে মগজটাও ব্যবহার করো, দেখো কী করা যায়৷'' ফ্লোরিয়ানের কল্পনাশক্তিও কম নয়: ‘‘এরকম একটা গাড়িতে কী কী হয়েছে, তা জানতে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বৈকি৷ বিশেষ করে ব্যাকসিটে৷ কিন্তু সব মিলিয়ে নিজেই ভেবে নেওয়া যায়: গাড়িটা কত কী দেখেছে৷ ব্যাকসিটটা খোলার সময় অনেক সময় কাগজের চিট পাওয়া যায়৷ গ্লাভ কম্পার্টমেন্টেও অনেক সময় জিনিসপত্র পাওয়া যায়: হয়ত সত্তরের দশকের কোনো রক-এন-রোল পার্টির হ্যান্ডবিল বা কিছু৷''
১৯৬৯ সালে তৈরি পিকআপটা হয়ত স্টার্ট পর্যন্ত করতে পারে৷ তবে নিরাপত্তার কারণে দীর্ঘ যাত্রার আগে তেলের ট্যাংক খালি করে দেওয়া হয়৷ তেল ভরার পরে সেই বিশেষ মুহূর্ত: চাবি ঘোরালেই গাড়িটা স্টার্ট করবে কি? ‘‘এই তো চলেছে! সব কিছু ঠিকঠাক৷''
ফ্লো গেজিনের মোটর গ্যারেজটা আসলে একটা পুরনো পেট্রোল স্টেশন – বলতে কি, গার্মিশ-পাটেনকিয়র্শনের প্রথম পেট্রোল স্টেশনগুলির মধ্যে এটি ছিল একটি৷ কাজেই ওল্ডটাইমাররা আর যাবে কোথায়?
ইয়ুরগেন নয়মান/এসি
জার্মানরা আজও যে সব গাড়ি নিয়ে পাগল...
এই সব মডেলের গাড়ি দেখে গাড়ি প্রেমিকদের চোখে আজও জল আসে৷ ফল্কসভাগেন থেকে বিএমডাব্লিউ, ওপেল থেকে মার্সিডিজ বেঞ্জ অবধি জার্মান গাড়ি নির্মাতারা নানা ‘কাল্ট মডেল’ তৈরি করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Kneffel
ফল্কসভাগেন বিটল (১৯৩৮)
এক কথায় ‘ওল্ড ফেইথফুল’৷ সর্বসাকুল্যে দু’কোটি দশ লাখের বেশি বিটল তৈরি হয়েছে৷ ফল্কসভাগেন বিটল সম্ভবত বিশ্বের প্রখ্যাততম মোটরগাড়ি৷ ১৯৩৮ থেকে ২০০৩ সাল অবধি বিটল-এর ডিজাইন বিশেষ বদলায়নি৷ ‘হার্বি’ ফিল্মটার কথা মনে করুন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফল্কসভাগেন টি-ওয়ান (১৯৫০)
...বলতে বোঝায় ফল্কসভাগেন ক্যাম্পার ভ্যান, যা হিপি আন্দোলনের সময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল৷ জার্মানরা এর নাম দিয়েছিলেন ‘বুলি’৷ সে-যাবৎ এক কোটির বেশি ফল্কসভাগেন বাস বিক্রি হয়েছে, যার মধ্যে টি-ওয়ান মডেলের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৮ লাখ৷
ছবি: DW/M. Reitz
মেসারস্মিট কেবিন স্কুটার (১৯৫৩)
মেসারস্মিট যে আদতে এয়ারোপ্লেন তৈরি করত, তিন চাকার এই এয়ায়োডাইনামিক গাড়িটির চেহারা দেখলেই তা বোঝা যায়৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিমান তৈরি বন্ধ হয়ে যায়, কাজেই মেসারস্মিট কিছুদিন ইঞ্জিনিয়ার ফ্রিটৎস ফেন্ড-এর সঙ্গে ‘ফ্লিটৎসার’ গাড়ির মডেলটি নিয়ে কাজ করে৷ তবে ১৯৫৬ সালের মধ্যেই মেসারস্মিট আবার বিমান উৎপাদনে ফেরে৷
ছবি: picture alliance/dpa/H. Galuschka
মার্সিডিজ ৩০০ এসএল (১৯৫৪)
গাড়িটার ডাকনাম হয়েছিল ‘গালউইং’ বা ‘গাঙচিলের পাখা’, কারণ দরজাগুলো ঠিক সেভাবেই ওপরের দিকে খুলত৷ ৩০০ এসএল সিলভার অ্যারো রেসিং কার-গুলো থেকেই মার্সিডিজ বেঞ্জ আবার মোটর রেসিং-এ ফেরে৷ লে মান্সের ২৪ ঘণ্টার মোটর দৌড় আর ক্যারেরা প্যানঅ্যামেরিকানা রেসিং ইভেন্টে জেতার পর ৩০০ এসএল গাড়ির একটি রাস্তায় চলা ও চালানোর মতো মডেল বার করা হয়৷
ছবি: Daimler AG
বিএমডাব্লিউ ইসেটা (১৯৫৫)
১৯৫৫ থেকে ১৯৬২ সাল অবধি ভালোই রোজগার করেছে বিএমডাব্লিউ এই ‘বাবল কার’ বা ‘বুদবুদ গাড়ি’-টি তৈরি করে৷ সস্তার কিন্তু কাজের এই মিনিগাড়িটিতে একটি মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন লাগানো ছিল৷ খুলতে হতো সামনে, ঠিক একটা ফ্রিজিডেয়ারের মতো৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Kneffel
পোর্শে নাইন-ইলেভেন (১৯৬৩)
ভাবলেই আশ্চর্য লাগে, পোর্শে ৯১১ স্পোর্টিং মডেলটি চলে আসছে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে! মোটরগাড়ির ইতিহাসে খুব কম মডেলই এতদিন ধরে চলে৷ তার উঁচু করা হেডলাইট আর পিছনদিকে নীচু বুট দেখলেই নাইন ইলেভেনকে চেনা যায়৷
ছবি: picture-alliance//HIP
মার্সিডিজ বেঞ্জ ৬০০ (১৯৬৪)
টেলিফোন, এয়ার কন্ডিশনিং আর ফ্রিজ লাগানো এই জার্মান লাক্সারি সেডানটি সত্তর আর আশির দশকে পোপ থেকে শুরু করে জন লেনন অবধি সেলিব্রিটিদের খুব প্রিয় ছিল৷ এমনকি ১৯৫৫ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ যখন রাষ্ট্রীয় সফরে জার্মানিতে আসেন, তখন জার্মান সরকার মাননীয় অতিথির জন্য একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ ৬০০ ভাড়া করেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ট্রাবান্ট ৬০১ (১৯৬৪)
ফল্কসভাগেন বিটল পশ্চিম জার্মানিতে যা ছিল, পূর্ব জার্মানিতে ট্রাবান্ট ৬০১ ছিল ঠিক তাই৷ প্লাস্টিকের বডি আর টু-স্ট্রোক ইঞ্জিন সংযুক্ত এই ‘ট্রাবি’ ছিল এক হিসেবে পূর্ব জার্মানির প্রতীক৷ আজও প্রায় ৩৩,০০০ ‘ট্রাবি’ জার্মানির পথেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷
ছবি: Imago/Sven Simon
ভার্টবুর্গ ৩৫৩ (১৯৬৬)
আইসেনাখ শহরের কাছে ভার্টবুর্গ দুর্গ, তারই নামে নাম রাখা হয়েছিল পূর্ব জার্মানির এই দ্বিতীয় আইকনিক গাড়িটির৷ তৈরি হতো প্রধানত রপ্তানির জন্য, যেমন হাঙ্গেরি অথবা ব্রিটেনে৷ তবে পশ্চিম জার্মানিতে ভার্টবুর্গ গাড়ির বিশেষ চাহিদা ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/ZB/J. Wolf
ওপেল মান্টা (১৯৭০)
সৃষ্টি হয়েছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য একটি স্পোর্টস মডেল হিসেবে – পরে সেটাই জার্মানির ‘ইয়ং ম্যান’-দের কাছে অভীপ্স বস্তু হয়ে দাঁড়ায়৷ মান্টা চালকদের নিয়ে জার্মানিতে অসংখ্য রসিকতা আছে: বিশেষ করে মান্টা চালকদের বুদ্ধি – অথবা তার অভাব নিয়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফল্কসভাগেন গল্ফ (১৯৭৪)
১৯৭৪ সালে ফল্কসভাগেন কোম্পানি তাদের প্রথম গল্ফ মডেল বার করে – সুবিখ্যাত বিটল গাড়ির উত্তরসূরি হিসেবে৷ কমপ্যাক্ট হলেও, গল্ফ ছিল বেশ ‘স্পোর্টি’ আর তেলও খেতো কম – যা সত্তরের দশকের ‘অয়েল ক্রাইসিসে’ খুবই কাজে লেগেছে৷