জার্মানি এবং তুরস্কের নেতাদের মধ্যে আলোচনার জন্য অসংখ্য বিষয় রয়েছে৷ তাসত্ত্বেও স্বৈরাচারী এই তুর্কি নেতার জন্য জার্মানিতে লাল গালিচা বিছিয়ে দেয়া হলে তা কারো কারো পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন হবে৷
বিজ্ঞাপন
তুর্কি প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ জার্মানিতে রাষ্ট্রীয় সফর করবেন বলে এক প্রতিবেদনে লিখেছে জার্মান পত্রিকা বিল্ড৷ এটা হবে গত চার বছরে দেশটিতে এর্দোয়ানের প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর৷ অবশ্য তুরস্ক এবং জার্মানির আনুষ্ঠানিক সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিল্ড সংবাদটি প্রকাশ করেছে দাবি করলেও কোনো দেশই আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো এই সফর নিশ্চিত করেনি৷
সেপ্টেম্বরের সফরে এর্দোয়ানের জন্য তাঁর সম্মানে সামরিক ‘গার্ড অফ অনার' এবং রাষ্ট্রীয় ভোজের আয়োজনও করা হবে বলে জানিয়েছে বিল্ড পত্রিকা৷ তবে এর্দোয়ানের জন্য এত আয়োজন জার্মানিতে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা৷ কেননা, ২০১৬ সালে তুরস্কে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর এর্দোয়ান যেভাবে তাঁর প্রকৃত এবং কাল্পনিক শত্রুদের উপর দমনপীড়ন শুরু করেন, তার সমালোচনায় মুখর হয় জার্মানি তথা গোটা ইউরোপ৷
তুরস্কের রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান কে?
ইসলামপন্থি তরুণ অ্যাক্টিভিস্ট থেকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট– রাজনীতিতে নিজের ক্যারিয়ার ভালোভাবেই গড়েছেন রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান৷ তবে রাজনৈতিক জীবনে বহুবার বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Morenatti
এর্দোয়ানের উত্থান
তুরস্কে এবং বিদেশে রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান সম্পর্কে নানা ধরনের মতামত রয়েছে৷ তাঁকে নব্য-অটোমান ‘সুলতান’ হিসেবে যেমন বিবেচনা করা হয়, তেমনি কারো কারো চোখে তিনি একজন স্বৈরাচারী নেতা৷ রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই ইসলামপন্থিদের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন তিনি৷ পাশাপাশি ন্যাটোতে তাঁর নেতৃত্বে বড় ধরনের অবদান রাখছে তুরস্ক৷ এর্দোয়ানের উত্থান নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Morenatti
ইস্তানবুলের কারাবন্দি মেয়র
তুরস্কে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দল ওয়েলফেয়ার পার্টিতে নিজের অবস্থান দ্রুতই পাকাপোক্ত করেছিলেন এর্দোয়ান৷ ১৯৯৪ সালে তিনি সেই দল থেকে ইস্তানবুলের মেয়রও নির্বাচিত হন৷ কিন্তু এর্দোয়ান মেয়র হওয়ার চার বছরের মাথায় সেই দলটিকে সে দেশের সরকার তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করে৷ এরপর জনসমক্ষে বিতর্কিত কবিতা আবৃত্তির দায়ে জেলে যান এর্দোয়ান৷ চার মাস জেল খাটেন৷
তুরস্কের একেপি পার্টির সহপ্রতিষ্ঠাতা এর্দোয়ান৷ ২০০২ সালের নির্বাচনে দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে৷ আর ২০০৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন৷ দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বছরগুলোতে এর্দোয়ান দেশবাসীকে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান, অর্থনীতির উন্নয়ন এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংস্কারের দিকে মনোযোগী হন৷ তবে কেউ কেউ এটাও মনে করেন যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাজনীতিতে ধর্মের মিশ্রণ ঘটানোয় ভূমিকা রেখেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Ozbilici
ইসলামপন্থিদের স্বার্থ রক্ষা
যদিও তুরস্কের সংবিধান দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানকে সমর্থন করে, তারপরও এর্দোয়ান কট্টর ইসলামপন্থিদের মন জয়ের নানা চেষ্টা করেছেন৷ তুরস্কের এই শীর্ষনেতা একসময় বলেছিলেন যে, তাঁর লক্ষ্যগুলোর একটি হচ্ছে এক ‘ধার্মিক প্রজন্ম’ গড়ে তোলা৷ এর্দোয়ানের সমর্থকরা এই লক্ষ্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, কেননা, তাঁরা মনে করেন, ধর্মচর্চা করা মুসলমানরা তুরস্কে নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AA/C. Ozdel
ক্যু থেকে রক্ষা
২০১৬ সালের জুলাইয়ে এর্দোয়ানের বিরুদ্ধে সে দেশের সেনাবাহিনীর এক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়৷ তবে সেই ঘটনায় দু’শ’র বেশি বেসামরিক নাগরিক এবং সেনা সদস্য নিহত হন৷ সেই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর এর্দোয়ান আরো ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণার পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করেন৷
ছবি: picture-alliance/AA/K. Ozer
দেশজুড়ে অভিযান
ব্যর্থ সেই সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে অভিযান পরিচালনা করে তুর্কি কর্তৃপক্ষ৷ এতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, স্কুল এবং গণমাধ্যম থেকে পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এর্দোয়ান সেই সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ধর্মীয় নেতা এবং তাঁর প্রাক্তন সঙ্গী ফেতুল্লাহ গুলেনের হাত রয়েছে বলে দাবি করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Gurel
বিভেদ সৃষ্টিকারী রাজনীতিবিদ
যদিও নিজের দেশে এবং বিদেশে বসবাসরত তুর্কিদের একটি বড় অংশের সমর্থন রয়েছে এর্দোয়ানের প্রতি, তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর কঠোর নীতি এবং কুর্দিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোয় কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারিতে আফরিনে মারাত্মক আক্রমণ পরিচালনা করেন এর্দোয়ান, যার সমালোচনা করে মানবাধিকা সংস্থাগুলো৷
ছবি: picture- alliance/ZUMAPRESS/Brais G. Rouco
ব্যাপক ক্ষমতাধর
২০১৭ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে দেশটির সংবিধান সংশোধন করা হয়৷ সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় তুরস্ক৷ ২০১৮ সালের ২৪ জুন নতুন করে ৫ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি৷ দেশটির ইতিহাসে এতো ক্ষমতাবান প্রেসিডেন্ট এর আগে আসেননি৷ শপথ নেয়ার দিন নিজের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি- একেপির সদস্যদের এর্দোয়ান বলেন, ‘তুরস্ক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে’৷
ছবি: picture-alliance/abaca
8 ছবি1 | 8
জার্মানির সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে যখন একাধিক জার্মান সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেপ্তার করে তুরস্ক সরকার৷ দু'দেশ নানা ইস্যুতে একে অপরকে দোষারোপও শুরু করে৷ তুরস্কের অভিযোগ, এর্দোয়ান যাকে সেনা অভ্যুত্থানের মদদদাতা মনে করেন, সেই গুলেনের সমর্থকদের আশ্রয় দিয়েছে জার্মানি৷ পাশাপাশি, তুরস্কে অবৈধ ঘোষিত কুর্দিশ ওয়ার্কার্স পার্টিও (পিকেকে) জার্মানি থেকে কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ দিয়েছে বার্লিন৷
দু'দেশের সম্পর্ক অবশ্য কিছুটা শান্ত হয়, যখন গতবছরের অক্টোবর মাসে জার্মান মানবাধিকার কর্মী টার স্টয়েড্টনারকে মুক্তি দেয় তুরস্ক৷ চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে জার্মানির ডি ভেল্ট পত্রিকার সাংবাদিক ডেনিজ ইউচেলকেও ছেড়ে দেয় দেশটি৷
সম্প্রতি তুর্কি বংশোদ্ভূত জার্মান ফুটবলার মেসুত ও্যজিলের অবসর নিয়েও সরব রয়েছে দু'দেশের গণমাধ্যম৷ গত মে মাসে তুর্কি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে লন্ডনে এক ছবি তুলেছিলেন ও্যজিল, যার সমালোচনা করেছেন অনেকে৷ বিশ্বকাপে জার্মানির ভরাডুবির এক কারণ হিসেবেও কেউ কেউ ছবিটিকে সামনে তুলে আনেন৷ ফলশ্রুতিতে বর্ণবাদের অভিযোগ এনে জাতীয় দল থেকে অবসর নেন ও্যজিল৷