প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট বা পিসা'র জরিপে জার্মানির স্থান কিছুটা ওপরের দিকে উঠেছে৷ তবে এখনও শিক্ষার সাফল্য নির্ভর করে পরিবারের আর্থিক সামর্থ্যের ওপর৷
বিজ্ঞাপন
এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷ কেননা প্রতিটি শিশুকেই প্রয়োজন জার্মানির৷ প্রাথমিক স্কুলে মাইকে ও মুরাত, আইলিন ও আব্দুল কাদের, ইওনাস ও ইউলিয়া পাশাপাশি বসে৷ কিন্তু ‘গিমনাসিউম' বা হাইস্কুলে বিদেশি বংশোদ্ভূত খুব কম ছেলেমেয়েকেই দেখা যায়৷ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ভিনদেশি নামও খুব একটা শোনা যায় না৷ জার্মানির স্কুলগুলির স্বাভাবিক চিত্র এটা৷ শিক্ষিত ও বিত্তশালীদের ছেলেমেয়েরা তাদের মা-বাবার মতোই গিমনাসিউম বা হাইস্কুলে যায়, দেয় ফাইনাল পরীক্ষা ‘আবিট্যুর'৷ অসচ্ছল ও স্বল্প শিক্ষিত পরিবারের ছেলেমেয়েদের পক্ষে প্রায়ই হাইস্কুলে যাওয়া সম্ভব হয় না৷
বহু ছাত্রছাত্রী আগেই স্কুল ছেড়ে দেয়
অনেক ছাত্রছাত্রী ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়েই স্কুল ছাড়ে৷ পরিমাণটা ছয় থেকে সাত শতাংশ৷ এর মধ্যে অনেক ছেলেমেয়েই বিদেশি বংশোদ্ভূত৷ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সংখ্যাটা কম মনে হলেও জার্মানির মতো অর্থনৈতিক দিক দিয়ে শক্তিশালী একটি দেশের পক্ষে এই সংখ্যাটা অনেক বেশি৷
সব দেশেই শিক্ষার ধরণ আলাদা
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই শিক্ষকরা চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন – এ দৃশ্য তাই সবারই জানা৷ কিন্তু তারপরও দেশ ভেদে এর পার্থক্য রয়েছে, বিশেষকরে আজকের এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে৷
ছবি: Getty Images
সব স্কুল কি এক রকম?
সারা বিশ্বের ছাত্ররা একইভাবে পড়ালেখা শেখে? না, তবে প্রায় সব দেশেই শিক্ষকরা চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন – এ দৃশ্য তাই সবারই জানা৷ কিন্তু তারপরও দেশ ভেদে এর পার্থক্য রয়েছে৷ কোনো দেশে ছাত্র-ছাত্রীরা খোলা আকাশের নীচে মাটিতে পা মুড়ে বসে লেখাপড়া করে, কোথাও আবার স্কুল বেঞ্চে বসে৷ আবার কোনো কোনো দেশের ছাত্রদের রয়েছে নিজস্ব ল্যাপটপ৷
ছবি: AP
ডিজিটাল স্কুলের বই
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ডিজিটাল সিস্টেমে চলে৷ প্রতিটি ক্লাস রুমেই রয়েছে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট৷ সরকারের ইচ্ছে সব স্কুল বই পুরোপুরিই ই-বুকে রূপান্তরিত করার৷ ডিজিটাল সিস্টেমে লেখাপড়া করতে কোনো ছেলে-মেয়ের যেন অসুবিধা না হয় এবং ডিজিটাল বইয়ের অভাবে যেন কারো লেখাপড়া বন্ধ না হয়, সেজন্য সরকার বিনা মূল্যে তাদের ট্যাবলেট এবং কম্পিউটার দিয়ে থাকে৷
ছবি: AP
গ্রামের স্কুলে যাওয়ার অসুবিধা
অন্যভাবেও পড়াশোনা চলতে পারে৷ কোনোরকমে ঝুলানো একটি ব্ল্যাকবোর্ড এবং কয়েকটি কাঠের বেঞ্চই আফ্রিকার ঘানার এই স্কুলটির জন্য যথেষ্ট৷ এই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে লেখা পড়া করা যায়, যদিও কাগজে কলমে রয়েছে ক্লাস নাইন পর্যন্ত লেখপড়া বাধ্যতামূলক৷ পড়াশোনার মাধ্যম ইংরেজি হওয়ায় গ্রামের ছাত্রদের অনেকেরই লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হয়৷
ছবি: Fotolia/Living Legend
টাচপ্যাডের মাধ্যমে লেখা শেখা
তবে জার্মানির এই স্কুলটি ব্যতিক্রম৷ কাগজ, পেন্সিল ছাড়া ছাত্ররা পুরোপুরি স্মার্টবোর্ড এবং নেটবুকের মাধ্যমে লেখা শেখে৷ ডিজিটাল নেটওয়ার্কিং-এর ছাত্রদের যোগাযোগের কাজে সাহায্য করে এবং কর্মদক্ষতা বাড়ায়৷ জার্মানিতে এখনো দুই মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ লিখতে পড়তে পারেন না, যদিও পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে জার্মানির সবাই লেখাপড়া জানেন৷
ছবি: AP
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ছোটবেলা থেকেই সুবিধা
শিল্পোন্নত দেশ মানেই সে দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের অন্যদেশের চেয়ে লেখাপড়ায় অনেক বেশি এগিয়ে থাকা৷ এমনকি ছোট বাচ্চাদেরও সেভাবেই তৈরি করা হয়, যেমন অ্যামেরিকার এই স্কুলটিতে৷ শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ছোটবেলার শিক্ষাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং ৭০ শতাংশ বাচ্চাই প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার আগে অনেককিছু শিখে ফেলে৷ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ১০ জনের মধ্যে হয়ত তিনজন কিন্ডারগার্টেনে যাওয়ার সুযোগ পায়৷
ছবি: AP
যেখানে শিক্ষা অর্থের জন্য বাঁধাগ্রস্থ
কেনিয়াতে সব ছাত্রই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়তে পারে৷ তারপরও অনেকে তার আগেই স্কুল ছেড়ে দেয়৷ স্কুল ড্রেস, বই, খাতা, জুতো ইত্যাদি জোগাড় করা অনেক বাবা মায়ের জন্য কষ্টকর হয় দাঁড়ায়৷ সেখানে ছাত্রের সংখ্যা অনেক বেশি এবং পড়াশোনার মানও নিম্ন৷ যাঁদের সামর্থ রয়েছে সে রকম অনেক বাবা-মা তাঁদের বাচ্চাদের প্রাইভেট স্কুলে পাঠান৷
ছবি: DW/J.Bruck
স্কুল ড্রেস পরে লেখাপড়া
ইংল্যান্ডে স্কুল ড্রেস ছাড়া কেউ স্কুলে যায় না৷ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্কুল ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক৷ কারণ স্কুল ড্রেস যার যার স্কুলের পরিচয় বহন করে এবং পড়াশোনার প্রতি উৎসাহী করে৷ দরিদ্র পরিবাররের ছেলে-মেয়েরা স্কুল ড্রেসের জন্য স্কুল থেকে টাকা পেয়ে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
খোলা আকাশের নীচে ক্লাসরুম
একটি পাবলিক পার্কে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে পাকিস্তানের একটি স্কুলে৷ গরিব বাবা-মায়েরা পয়সার অভাবে এমন স্কুলেই তাঁদের সন্তানদের পাঠিয়ে থাকেন৷ পাকিস্তানে শিক্ষা খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে, কারণ সরকার শিক্ষার চেয়ে সামরিক খাতে বেশি খরচ করে৷ যা ছাত্ররাও বুঝতে পারছে৷
ছবি: AP
কমপক্ষে মৌলিক শিক্ষা থাকতে হবে
আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ ও নানা সমস্যার কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত৷ বিশেষকরে মেয়েদের ক্ষেত্রে একথাটি বেশি প্রযোজ্য৷ প্রতি দশজনের একজন লিখতে পড়তে পারে সেখানে৷ তবে এ হার পুরুষদের ক্ষেত্রে শতকরা ৪০ জন৷ তাছাড়া স্কুলগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট স্কুলও নেই, অভাব রয়েছে শিক্ষক এবং শিক্ষার সরঞ্জামেরও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত
আফগানিস্তানের মতো প্রায় একই অবস্থা দক্ষিণ সুদানেও৷ এদেশেও মেয়েদের প্রতি পাঁচজনের একজন লিখতে ও পড়তে পারে৷ সেজন্যই বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলো সুদানের মেয়েদের শিক্ষার দিকে বিশেষ নজর দিয়ে থাকে৷ বহু বছরের গৃহযুদ্ধ সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছে৷ অনেক স্কুলেই বই-খাতা এবং টেবিল-বেঞ্চও ঠিকমতো নেই৷
ছবি: dapd
কো-এডুকেশন পছন্দ নয়
কো-এডুকেশন? না, ইরানে সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়৷ ছেলে এবং মেয়ে আলাদাভাবে পড়াশোনা করে ইরানে৷ এমন কি এই ইহুদি স্কুলেও ইসলামিক স্কুল ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক৷ এখানে মেয়েরা যে ধর্মেরই হোক না কেন সবাইকেই চুল ঢেকে রাখতে হবে, অর্থাৎ হিজাব পরতে হবে৷
ছবি: AP
ধনী-গরিবের পার্থক্য
ব্রাজিলের গ্রামাঞ্চলের ছাত্রদের জন্য লেখাপড়া করা বেশ কঠিন৷ কারণ সেখানকার স্কুলগুলোতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই৷ যেমন মন্টে আলেগ্রের এই স্কুলটির মতো ৷ যদিও ব্রাজিল শিল্পোন্নত দেশগুলোর একটি, তারপরও এদেশে গরিব এবং ধনীদের মধ্যে অনেক পার্থক্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশের অবস্থা অনেকটা একই রকম
বাংলাদেশের গ্রামের স্কুল এবং রাজধানী ঢাকা শহরের স্কুলের মধ্যে বিশাল পার্থক্য৷ বড় শহরগুলোতে ছাত্ররা কম্পিউটার বা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে৷ আর গ্রামের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কম্পিউটার ব্যবহার করার ইচ্ছা – এখনো স্বপ্ন!
ছবি: Getty Images
13 ছবি1 | 13
জার্মানিতে রয়েছে তিন ধরনের স্কুল
জার্মানির তিন ধরনের স্কুল সিস্টেমের কারণেই এই ধরনের বৈষম্যের সৃষ্টি হয়৷ জার্মানির প্রতিটি রাজ্যেই ছাত্রছাত্রীরা দশ বছর বয়সের মধ্যেই বাছাই হয়ে যায়৷ বিভিন্ন মানের স্কুলে যেতে হয় তাদের৷ ভাল স্কোর হলে ‘গিমনাসিউম'; মাঝারি হলে ‘রেয়ালশুলে'; আর বাদ বাকিদের জায়গা হয় ‘হাউপ্টশুলে'-তে৷
হাউপ্টশুলেতে ছেলেমেয়েদের ক্যারিয়ার করা বা কোনো ভাল পেশায় ঢোকার সুযোগ খুব কম৷ বৈষম্যমূলক এই বাছাইপর্বে অল্পবয়সেই বাচ্চাদের অনেকটা ‘ব্যর্থ' বলে চিহ্নিত করা হয়৷ বিষয়টা শুধু হৃদয়হীনই নয়, অর্থনৈতিক দিক দিয়েও অবিবেচনাপ্রসূত৷ কেননা আধুনিক অর্থনীতিতে প্রশিক্ষণ ছাড়া ভাল কাজ পাওয়া যায় না৷ এখন প্রয়োজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও শিক্ষিত কর্মী৷ সব ছেলেমেয়েকে যে আবিট্যুর দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই৷ তবে ফাইনাল না দিয়ে স্কুল ছাড়া ছেলেমেয়ের সংখ্যাটা যতটা কম হয়, ততই ভাল৷ কেননা জার্মানিতে জন্মের হার ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে৷ তাই বাচ্চাদের কাট-ছাঁট করে এক দলকে বাদ দেওয়ার সামর্থ্য জার্মানির নেই৷ শুধু মাত্র ধনী বাবা-মার সন্তান নয়, সব বাচ্চাকেই প্রয়োজন জার্মানির৷
সুশিক্ষার সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক
ইদানীং জার্মানিতে দামি বেসরকারি স্কুলের ধুম পড়েছে৷ সেখানে রয়েছে ছোট ছোট ক্লাস, ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধান, স্বনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা, উদ্যোগী শিক্ষক ইত্যাদি৷ বিত্তশালীদের ছেলেমেয়েরাই এই সব স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়৷
তবে সুশিক্ষা মানিব্যাগের ওপর নির্ভর করে চলতে পারে না৷ সব স্কুলেরই এমন হওয়া উচিত, যেখানে বাচ্চারা তাদের যোগ্যতার বিকাশ ঘটাতে পারে, পরস্পরের কাছে থেকে শিখতে পারে, যেখানে শিক্ষক ও ছাত্ররা পরস্পরের প্রতি সম্মান দেখান৷
তাই বলা যায় পিসা-জরিপে কিছুটা ভাল ফলাফল নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না সংশ্লিষ্টদের৷ শিক্ষাক্ষেত্রে সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চিন্তাভাবনা করতে হবে৷