ক্রমেই আরো বেশি বিদেশি ছাত্র পড়াশুনা শেষ করার পর জার্মানিতে থেকে যাচ্ছে৷ এবং তারা যে এখানে চাকরি পাচ্ছে, তার মূল কারণ হলো, জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে তাদের সংযোগ৷
বিজ্ঞাপন
কোলোন শহরের জার্মান অর্থনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইডাবলিউ-র একটি সাম্প্রতিক জরিপের ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে যে, যে সব বিদেশি-বহিরাগত জার্মানিতে পড়াশোনা করেছেন, তাদের ভালো বেতনের চাকরি পাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি৷ কেননা তথাকথিত ‘‘শিক্ষিত বিদেশি''-রা সাধারণত যে ধরনের বিষয় নিয়ে পড়াশুনা থাকেন, যে ধরনের কোয়ালিফিকেশন সংগ্রহ করেন, জার্মান কোম্পানিগুলি বিশেষ করে সেগুলির খোঁজে৷
ইঞ্জিনিয়ারিং, গণিতশাস্ত্র ও বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয় – জার্মানির মাঝারি মাপের শিল্পসংস্থাগুলি এই সব বিষয়ে দক্ষ কর্মীদেরই খোঁজ করে থাকে৷ জার্মানিতে সে ধরনের কর্মীদের চাহিদা যে ভাবে বেড়ে চলেছে, তার তুলনায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে স্নাতকের সরবরাহ পর্যাপ্ত নয়৷ এক্ষেত্রে যে সব বিদেশিরা এ দেশে পড়াশোনা সমাপ্ত করছেন, তারা একটা সমাধান হতে পারেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
জার্মান ভাষা জানার বিকল্প নেই
জার্মান ভাষা আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত৷ ভারত-বাংলাদেশের মতো বিশ্বের আরো অনেক দেশে এ ভাষা শেখার জন্য রয়েছে গ্যোটে ইন্সটিটিউট৷ তবে জার্মানিতে থেকে সে’ দেশের ভাষা না জানলে যে পদে পদে সমস্যা!
ছবি: POOSHdesign/Reza Alaeddini
যদি ভাষা জানেন, সুবিধা পাবেন
যে কোনো দেশে থাকতে হলে সে দেশের ভাষা জানা খুবই জরুরি৷ তা না হলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার তেমন কোনো সুযোগই থাকেনা৷ ভাষা না শেখার কারণে খালিদ, আইচো, শিরিয়া, আরিয়ানা বা রাইসার মতো অনেকেই নিজের দেশে চেয়ার টেবিলে বসে কাজ করলেও জার্মানিতে শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে৷
ছবি: Doc RaBe - Fotolia.com
সেবিকা থেকে ক্লিনার
শিরিয়া কসোভো থেকে বেশ কয়েকবছর আগে স্বামী, সন্তান নিয়ে জার্মানিতে এসেছে৷ নিজের দেশে একটি হাসপাতালে নার্স বা সেবিকা হিসেবে কাজ করতো৷ প্রথমে ভাষা শেখাটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি বলে আর শেখাও হয়নি৷ বেঁচে থাকার জন্য এখন তাকে অন্যের বাড়িতে ক্লিনারের কাজ করতে হচ্ছে৷ জার্মান ভাষা জানা থাকলে সহজেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে হয়তো আবারও সেবিকার কাজ পেতে পারতো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
খালিদের অনেক দুঃখ
খালিদ পোল্যান্ডের একটি কন্সট্রাকশন ফার্মে সুপারভাইজারের দায়িত্ব পালন করতো৷ ভাষা শেখেনি, তাই এখন নিজেকেই এ সব কাজে হাত লাগাতে হচ্ছে৷ ভাষা না শেখার কারণ জানতে চাইলে কিছুই বলেনা৷ তবে এখন বুঝতে পারছে সে ভাষা না শিখে ভুল করেছে এবং মানসিকভাবে অনেক কষ্টও পাচ্ছে৷ যদিও জার্মানিতে কম আয়ের বিদেশিদের জন্য বিনে পয়সায় ভাষা শিক্ষার কোর্স রয়েছে৷
ছবি: Kzenon - Fotolia.com
আরিয়ানা
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষিকা আরিয়ানা প্রায় দশ বছর আগে ইউক্রেন থেকে এসেছে৷ নিজের দেশে টুকটাক জার্মান ভাষা শিখেছিলো, তবে জার্মানিতে এসে আর শেখা হয়নি কোলে বাচ্চা থাকায়৷ তবে ওর স্বামীর জার্মান ভাষা মোটামুটি শেখাতে একটি চাকরি এবং জার্মানিতে থাকার অনুমতি পেয়েছে৷ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে আরিয়ানাকেও কাজ করতে হয়৷ স্বামীর সহায়তায় অগত্যা একটি সরকারি অফিসে মেঝে মোছার কাজই করছে সে এখন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বসনিয়ার মেয়ে মারিয়ম
১৫ বছর বয়সে বাবা মায়ের হাত ধরে জার্মানিতে এসেছে মারিয়ম৷ প্রথমদিকে কিছুটা অসুবিধা হলেও বাবা মায়ের উৎসাহে এবং নিজের মনোবলের কারণে ভালোভাবেই জার্মান ভাষা রপ্ত করতে পেরেছে৷ এখন সে নিজেই চাকরির জন্য অফিসে দরখাস্ত করছে৷ ওর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে৷
ছবি: Bilderbox
জব সেন্টারে ঘোরাঘুরি
অনেকে প্রতি সপ্তাহেই চাকরির খোঁজে জব সেন্টারে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ ভাষা না জানার কারণে ওদের জন্য তেমন কোনো চাকরির সুখবরও থাকেনা৷ তবে এরা সরকার থেকে বেকার ভাতা বা সামাজিক ভাতা পায় নিয়মিত৷
ছবি: dpa
ভাষা শিখে স্বপ্ন পূরণ
লায়লা ছোটবেলা থেকেই বাচ্চা ভালোবাসে তার ইচ্ছে বাচ্চাদের সাথে কাজ করবে৷ লায়লার জন্য ভাষা শেখা কোনো সমস্যাই ছিলোনা৷ সাধারণ স্কুলের পাশাপাশি আলাদাভাবে জার্মান ভাষা শেখার ক্লাস সে করেছে৷ যার ব্যয়ভার জার্মান সরকার বহন করেছে৷ কিন্ডারগার্টেনের ট্রেনিং শেষে পছন্দের চাকরিও সে পেয়ে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বখাটে তরুণ
যারা জার্মান ভাষা শেখেনা, তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়৷ কোনো প্রয়োজনীয় চিঠিপত্র এলেও সেগুলো তারা পড়তে বা বুঝতে পারেনা৷ ফলে সবসময়ই অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়৷ ভাষা না জানা এই প্রজন্মের অনেক ছেলে মেয়েকে পয়সার জন্য অন্যায় পথে পা বাড়াতেও দেখা যায়৷ কেউ কেউ আবার অন্য বাড়ির দরজায় গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে৷
ছবি: fotolia/imageteam
জন্ম থেকে জার্মানিতে, জার্মান ভাষার প্রতি আগ্রহ নেই
জার্মানিতে প্রায় ৪০ লাখ তুর্কি রয়েছে৷ যাদের জন্ম জার্মানিতে, জার্মান স্কুলে পড়ে – তারপরও অনেকেই তেমন ভালো জার্মান ভাষা জানেনা৷ কারণ হিসেবে অনেক সময় বলা হয় জার্মান স্কুলের বাইরে অর্থাৎ নিজেদের মধ্য এরা সবসময়ই তুর্কি ভাষায় কথা বলে৷
ছবি: picture-alliance/ZB
নারীদের ভাষা শেখার আগ্রহ খুব কম
নিজ দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেকেই জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছেন৷ তাদের মধ্যে পুরুষরা কিছুটা জার্মান ভাষা শিখে বিভিন্ন দোকান, কারখানা, রেস্তোরাঁতে কাজ করছেন৷ এদেশে স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক বলে বাচ্চারাও স্কুলে যায়৷ তবে এসব পরিবারের খুব কম নারী জার্মান ভাষা শেখে৷ অনেক বছর থাকার পরও কথা বলতে পারেন না৷ যদিও এদেশে তুর্কি নারী সংখ্যা বেশি থাকায় তাদের জন্য আলাদাভাবে ভাষা শেখার ব্যবস্থা রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তিন বোন
পোল্যান্ড থেকে আসা এক পরিবারের তিনজন৷ ছোটবোন ভালো জার্মান ভাষা শিখেছে বলে মোটামুটি ভালো বেতনে দোকানে সেলস গার্লের চাকরি করছে৷ দ্বিতীয়জনের জার্মান ভাষার জ্ঞান আরো কম বলে সে একটি ফ্যাক্টরিতে জিনিসপত্র গোছানোর কাজ করে, যেখানে তাকে বেশি কথা বলতে হয়না৷ এবং স্বাভাবিকভাবেই বেতন বেশ কম৷ আর সবচেয়ে বড় বোন একদমই ভাষা জানেনা৷ তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোন বাড়িতে ক্লিনারের কাজও কেউ দিতে চায়না৷
ছবি: POOSHdesign/Reza Alaeddini
11 ছবি1 | 11
আনন্দের কথা, জার্মানির কলেজ-ইউনিভার্সিটিগুলি বিদেশি ছাত্রদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় – দৃশ্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের পরেই৷ এছাড়া বিদেশিরা যারা বিদেশ থেকে জার্মানিতে পড়াশুনা করতে আসেন, তারা এখানেই থাকতে চান৷ জার্মানিতে যারা পড়াশুনা করেছেন, এমন বিদেশিদের ৮০ শতাংশের জার্মানিতে থাকতে ও বাস করতে কোনো আপত্তি নেই – বরং সেটাই তাদের কাম্য৷ তাদের এক-তৃতীয়াংশ তিন বছর কিংবা তার বেশি সময়ের জন্য জার্মানিতে থেকে যাওয়ার কথা ভাবেন৷
যার ফলশ্রুতি বাস্তবেও পরিলক্ষণ করা যাচ্ছে৷ যে সব ‘শিক্ষিত বিদেশিরা' জার্মান কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, তাদের অর্ধেকেই এখানে থেকে যান৷ যে কারণে রাজ্য সরকারগুলিও এই সব বিদেশিদের স্থানীয় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার ফলে রাজ্যকে যে ব্যয় বহন করতে হচ্ছে, সে বিষয়ে উচ্চবাচ্য করে না৷ তবে সমস্যাও যে নেই, এমন নয়৷
যেমন বিদেশি ছাত্রদের মধ্যে পড়াশোনা সমাপ্ত না করার প্রবণতা কিছুটা বেশি, যার একটা কারণ জার্মান ভাষায় উপর তাদের অপর্যাপ্ত দখল হতে পারে৷ এছাড়া পড়াশোনা সমাপ্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেরই ভিসা শেষ হয়ে যায়৷ কাজেই তাদের শীঘ্র পড়াশোনা শেষ করার কোনো তাগিদ থাকে না৷