জার্মানিতে একটি শিশুর ওপর ধারাবাহিক যৌন নির্যাতনের ঘটনা তোলাপাড় তুলেছে৷ আর এর সাথে জড়িত থাকায় শিশুটির মা এবং তার প্রেমিকের বিচার শুরু হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
শিশু নির্যাতনের এই ঘটনায় কর্তৃপক্ষের যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ার ব্যাপারেও কেউ কেউ অভিযোগের আঙুল তুলেছেন৷
গেল সপ্তাহে জার্মানির আদালত তদন্তকারীদের হাতে আটক শিশুটির মা ও তার প্রেমিকের বিরুদ্ধে ৫৫টি ঘটনার ১০০ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র পড়ে শোনান৷ এর মধ্য দিয়ে ঘটনার জন্য দুই প্রধান অভিযুক্তের বিচার শুরু হলো৷
এ বছরের জানুয়ারিতে ইন্টারনেটের ডার্ক ওয়েবসাইটগুলোতে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে তদন্তে নামার পর জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রয়েরবুর্গ শহরের কাছে স্টাউফেন এলাকায় ৯ বছর বয়সি ওই বালকের ওপর যৌন নিপীড়নের ব্যাপারটির সত্যতা পান তদন্তকারীরা৷
অভিযোগপত্রে বলা হয়, শিশুটির ৪৮ বছর বয়সি মা বেরিন টি-র সহায়তা নিয়ে তার প্রেমিক ৩৯ বছর বয়সি ক্রিশ্চিয়ান ল যৌন নিপীড়ন চালিয়েছে শিশুটির ওপর৷ এর সাথে আরও বেশ কয়েক ব্যক্তিও জড়িত ছিল৷ এক পর্যায়ে ছেলে শিশুটিকে ধর্ষণ ও নিপীড়নের ভিডিও ডার্ক নেটে ছাড়া হয়৷
ডার্ক নেট হচ্ছে এমন এক ইন্টারনেট ব্যবস্থা, যাতে বিশেষ সফটওয়্যার ছাড়া ঢোকা সম্ভব নয়৷
যৌন হয়রানির হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবেন শিশুকে
শিশুরা বিকৃতকাম মানুষের সহজ শিকার৷ সারল্যের সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় তাদের৷ অনেক সময় শিশুরা বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না পিশাচের থাবা৷ আর বুঝলেও করতে পারে না প্রতিবাদ, প্রতিরোধ৷ শুধু একটা অস্বস্তি থেকে যায় সারাটা জীবন৷
ছবি: picture alliance/abaca
ভয়াবহ অবস্থা ভারতে
ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাচ্চা যৌন নিগ্রহের শিকার৷ তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হলো, নাবালিকা বা শিশুর ওপর যৌন হেনস্থার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারের মধ্যে, পরিবারেরই কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের হাতে৷ তাই সে সব ঘটনা পুলিশের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, হচ্ছে না কোনো ডাইরি অথবা মামলা৷
ছবি: Fotolia/Gina Sanders
হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব
এভাবে প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্তি শৈশব৷ অনেকক্ষেত্রেই শিশুরা বুঝে উঠতে পারছে না, বলে উঠতে পারছে না তাদের অমানবিক সেই সব অভিজ্ঞতার কথা৷ তাই শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত, বিকৃত মানুষগুলো থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে৷ সমাজবিদরা বলছেন, এ জন্য আগাম সতর্কতার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবক এবং স্কুলের৷ শিশুকে দিতে হবে তার প্রাপ্য শৈশব৷
ছবি: Fotolia/Kitty
যেভাবে বোঝাবেন বাচ্চাদের
সহজ ভাষায় খেলা বা গল্পচ্ছলে শিশুদের এ বিষয়ে একটা ধারণা গড়ে তোলা যেত পারে৷ বাচ্চাদের বলতে হবে যে, তাদের শরীরটা শুধুমাত্র তাদের৷ অর্থাৎ কেউ যেন তাদের ‘গোপন’ জায়গায় হাত না দেয়৷ তাই কোনো আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তির আচরণ অস্বস্তিকর ঠেকলে, কেউ তাদের জোর ঘরে কোনো ঘরে নিয়ে গেলে, খেলার ছলে চুমু দিলে বা শরীরের কোথাও হাত দিলে – তা যেন মা-বাবাকে জানায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিনিয়ে দিন যৌনাঙ্গ
অনেক বাবা-মা নিজ সন্তানের সঙ্গে যৌনাঙ্গ নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন৷ কিন্তু এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং খুব ছোটবেলাতেই ছবি এঁকে অথবা গল্পে-গানে বাচ্চাকে তার শরীরের অন্য সব অঙ্গের মতো যৌনাঙ্গ, লিঙ্গ ইত্যাদি চিনিয়ে দিতে হবে৷ এমনটা করলে কেউ যদি তাদের সঙ্গে পিশাচের মতো ব্যবহার করে, তাহলে শিশুরা সহজেই বলতে পারবে কে, কখন, কোথায় হাত দিয়েছিল৷
ছবি: DW/S.Rahman
শিশুর কথা শুনুন, তার পক্ষ নিন
শিশু যাতে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারে, বন্ধুর মতো সবকিছু খুলে বলতে পারে – সেটা নিশ্চিত করুন৷ আপনার বাচ্চা যদি পরিবারের কাউকে বা আপনার কোনো বন্ধুকে হঠাৎ করে এড়িয়ে যেতে শুরু করে অথবা আপনাকে খুলে বলে বিকৃত সেই মানুষের কৃতকর্মের কথা, তবে সময় নষ্ট না করে শিশুটির পক্ষ নিন আর তিরস্কার করে বাড়ি থেকে বার করে দিন ঐ ‘অসুস্থ’ লোকটাকে৷
ছবি: Fotolia/pegbes
স্কুলেরও দায়িত্ব আছে
বাচ্চারা দিনের অনেকটা সময় স্কুলে কাটায়৷ তাই যৌন শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলের একটা বড় দায়িত্ব থেকে যায়৷ তবে স্কুলের মধ্যে, বিদ্যালয় চত্বরেও ঘটতে পারে শিশু নির্যাতনের ঘটনা৷ তাই স্কুল থেকে ফেরার পর বাচ্চা যদি অতিরিক্ত চুপচাপ থাকে, একা একা সময় কাটায় বা পড়াশোনা করতে না চায়, তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলুন৷ জানতে চান কী হয়েছে, প্রয়োজনে স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানান৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
ছেলে-মেয়ে সমান!
আমাদের সমাজে ছোট থেকেই মেয়েদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়৷ মেয়ে হলেই হাতে একটা পুতুল আর ছেলে হলে ধরিয়ে দেয়া হয় বল বা খেলনার পিস্তল৷ ছেলের পাতে যখন তুলে দেয়া হয় মাছের বড় টুকরোটা, তখন মেয়েটির হয়ত এক গ্লাস দুধও জোটে না৷ এ বৈষম্য বন্ধ করুন৷ বাবা-মায়ের চোখে ছেলে-মেয়ে সমান – সেভাবেই বড় করুন তাদের৷ তা না হলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে কীভাবে? কীভাবে কমবে শিশু নির্যাতন?
ছবি: picture alliance/abaca
7 ছবি1 | 7
শিশুটির মা বেরিন এবং প্রেমিক ক্রিশ্চিয়ান ল কেবল শিশুটির ওপর নির্যাতনচালিয়েই থেমে যায়নি৷ ডার্ক নেটের মাধ্যমে যৌনাচার করতে আগ্রহীদের কাছেও অর্থের বিনিময়ে তারা শিশুটিকে যৌনসঙ্গী হতে বাধ্য করেছেন নানাভাবে৷
জার্মান পত্রিকা জুডডয়েচেস সাইটুং জানিয়েছে, এর আগেও ক্রিশ্চিয়ান ল ২০০৫ সালে তার কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনে শিশুদের পর্নোগ্রাফি থাকার কারণে এক বছরের সর্তকতামূলক শাস্তি পেয়েছিলেন৷ ২০১০ সাল ১৩ বছর বয়সি এক নাবালিকাকে যৌন হয়রানি করায় চার বছর জেল খাটতে হয় তাকে৷
দুই ক্ষেত্রেই ক্রিশ্চিয়ানকে মানসিক চিকিৎসা নেওয়ার কথা বলা হয় এবং সে তাতে রাজি হয়৷ ২০১৪ সালে ক্রিশ্চিয়ান যখন কারাগার থেকে ছাড়া পায়, তখনও সে মানসিক বিকারগ্রস্ত ছিল এবং তাকে আইন কর্তৃপক্ষ সতর্ক করেছিল শিশুদের সাথে মেলামেশার ব্যাপারে৷
বলা হয়েছিল, ক্রিশ্চিয়ান তখনই কোনও শিশুর সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবেন যখন ওই শিশুর বাবা-মা অথবা আইনগত অভিভাবক উপস্থিত থাকবে৷
২০১৭ সালের মার্চ মাসে একজন পুলিশ কর্মকর্তা যখন বলেন, ক্রিশ্চিয়ান যৌন নিপীড়নের শিকার ওই শিশুটির সাথে একই ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন, তখন শিশুটিকে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে নেওয়া হয়৷ কিন্তু শিশুটির মা বেরিন ওই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা করলে তাকে আবার রাষ্ট্রীয় হেফাজত থেকে বাড়িতে পাঠানো হয়৷ আদালতের আদেশ উপেক্ষা করেই ক্রিশ্চিয়ান ল ওই শিশুটির সাথে যোগাযোগ রাখতে শুরু করে৷
স্থানীয আদালত এবং ইউথ ওয়েলফেয়ার অফিসের বিরুদ্ধে এ জন্য দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আনা হয়েছে৷
জার্মানির মতো ধনী দেশে শিশুদের দরিদ্রতা হুমকির মুখে
জার্মানিতে সিঙ্গেল বা একক মা, বাবা এবং গরিব পরিবারের দরিদ্রতা আগের তুলনায় আরো বেশি হুমকির মুখে৷ নতুন পদ্ধতির ভিত্তিতে এক সমীক্ষায় এই বাস্তব চিত্রটি তুলে ধরা হয়েছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/C. Hager
সিঙ্গেল বা একক মা-বাবার পরিবার
জার্মানির ব্যার্টেলসমান ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, জার্মানির বহু পরিবারের দারিদ্রতা যা এতদিন ধারণা করা হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি৷ বিশেষ করে সিঙ্গেল বা একক মা-বাবার পরিবারের সন্তানদের ক্ষেত্রে এমনটা বেশি দেখা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Kusch
সমীক্ষার ফলাফল
জার্মানির বোখুম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা নতুন ও উন্নত পদ্ধতিতে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিলেন৷ এই সমীক্ষায় দেখা গেছে যে সিঙ্গেল বাবা-মা’দের দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাবার ঝুঁকি ৬৮ শতাংশ, অর্থাৎ যা কিনা আগের সমীক্ষার চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি৷
ছবি: picture-alliance/Beyond
দরিদ্রতার চালচিত্র
সমীক্ষা থেকে আরও জানা গেছে যে এক সন্তানসহ দম্পতিরা শতকরা ১৩ শতাংশ গরিব, আর যাদের তিনটি সন্তান, তাদের ক্ষেত্রে দারিদ্র্যসীমার ঝুঁকি শতকরা ১৮ভাগ৷ আর প্রতি পাঁচজন শিশুর একজনই গরিব৷ তাছাড়াও ‘যে একবার গরীব সে দীর্ঘদিন গরিব থাকে’ – একথা জানা যায় গত বছর প্রকাশিত একটি সমীক্ষায়৷
ছবি: picture-alliance/Joker
পরিবর্তনের আহ্বান
জার্মানি অর্থনীতির দিক থেকে ইউরোপের শক্তিশালী দেশ হলেও এ দেশের সব শিশুরা ভালো নেই৷ তাই ফাউন্ডেশনটি জার্মনির পরিবার এবং সমাজকল্যাণ বিষয়ক নীতিতে পরিবর্তন আনার ডাক দিচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রতিটি শিশুর জন্য বাড়তি খরচ
গত ২৫ বছরে দেখা গেছে যে সিঙ্গেল বা একক মা-বাবার পরিবারের তুলনায় সন্তানহীন দম্পতির অর্থনৈতিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো ছিলো৷ যাদের সংসারে সন্তানের সংখ্যা যত বেশি, তাদের অর্থনেতিক অবস্থা তত খারাপ৷ সন্তানের সংখ্যা যত বাড়বে, পরিস্থিতি ততটাই খারাপ হবে বলে জানান বার্টেলসম্যান ফাউন্ডেশনের প্রধান ইয়র্গ ড্রেগার৷
ছবি: picture-alliance/U. Baumgarten
সরকারি সহায়তার আহ্বান
সরকার থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া সত্ত্বেও সন্তানসহ পরিবারের অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি৷ এই পরিস্থিতিতে জার্মানির এক শিশুকল্যাণ সংগঠন পরিবার কল্যাণের সরকারি কাঠামোয় আমূল সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
6 ছবি1 | 6
কিন্তু ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে যখন ফেডারেল পুলিশ অফিসের কাছে ৯ বছর বয়সি শিশুটিকে যৌন নিপীড়নের ব্যাপারে বেনামি একটি বার্তা আসে, তখন ক্রিশ্চিয়ান ল এবং বেরিন টিকে গ্রেপ্তার করে জোর তদন্তে নামা হয়৷
কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তারা নিপীড়কদের আরও ছয়জনকে শনাক্ত করে ফেলে৷ ফলে শিশুটির যৌন নিপীড়নকারীদের সংখ্যা দাঁড়ায় আট৷ তারা প্রত্যেকেই পৃথকভাবে শিশুটিকে যৌন নিপীড়ণন করেছেন বা সেই চেষ্টায় জড়িত ছিলেন৷ এদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন৷
৪১ বছর বয়সি এক জার্মানকে মধ্য এপ্রিলে ধর্ষণ এবং ওই শিশুটির ওপর নিদারুণ যৌন নিপীড়ন চালানোর অভিযোগে দশ বছরের জেল দেওয়া হয়৷
জার্মান সেনাবাহিনীর একজন ৫০ বছর বযসি সিপাহীকে ওই বালককে দুইবার ধর্ষণ এবং তার পর্নোগ্রাফিক ভিডিও অনলাইনে প্রকাশ করার অভিযোগে ৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়৷
এছাড়া অপর এক সুইস নাগরিক জুনের প্রথম সপ্তাহে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে অপরাধ স্বীকার করে বলেন, শিশুটির প্রতি মোট তিনবার যৌন নিপীড়ন চালিয়েছেন তিনি৷ আর এজন্য তার দিতে হয়েছে ৫০ ইউরো এবং শিশুটিকে একটি চিজ বার্গার এবং একটি ব্যবহৃত কম্পিউটার৷
গেল সোমবার ৪৪ বছর বয়সি আরও একজন জার্মান নাগরিকের বিচার শুরু হয়েছে৷ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ডার্ক নেটে ক্রিশ্চিয়ান ল-কে শিশুটিকে যৌন নিপীড়নের পর হত্যার প্রস্তাব দিয়েছিল সে৷
দুই বছর ধরে স্টাউফেনের ওই বালকের ওপর চলা নিপীড়ণের ভয়ঙ্কর সব তথ্য বেরিয়ে আসছে৷ আর এর মধ্য দিয়ে ওই বালকের নিরাপত্তার ফাটলগুলোও জনসমক্ষে আসছে৷