জার্মানির বড় বড় শহরে অভিবাসীরা প্রায়ই এক ধরনের অর্থলিপ্সু বাড়ির মালিকের কবলে পড়েন৷ স্থানীয় প্রশাসন এই সমস্যা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে৷ এক্ষেত্রে সাহায্যের আশ্বাস পাওয়া গিয়েছে নির্মাণবিষয়ক মন্ত্রী হেন্ডরিক্সের কাছ থেকে৷
বিজ্ঞাপন
ডর্টমুন্ড শহরের একটি হাউজিং কোম্পানি, ডোগেভো ২১-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্লাউস গ্রানিকি৷ এই ধরনের কোম্পানির ৯০ শতাংশ বাড়ি ডর্টমুন্ড নগর কর্তৃপক্ষের আওতাভুক্ত৷ বাকিগুলির মালিক স্পারকাসে (ব্যাংক)৷ গ্রানিকির কোম্পানিটি কিছুদিন আগেও ১২৬ ফ্ল্যাটসহ ১৫টি বাড়ি কিনে পুনর্গঠন করেছে৷ এর মধ্যে ছিল বেশ কিছু ভাঙাচোরা বাড়িঘরও৷ এগুলি অনেকদিন ধরেই খালি পড়ে ছিল৷
জরাজীর্ণ বাড়িঘর
এই ধরনের জরাজীর্ণ বাড়িঘর প্রসঙ্গে প্রায়ই অভিবাসীদের কথা উঠে আসে খবরে৷ বহু শহরে গলাকাটা ভাড়ায় অভিবাসীদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয় এই সব বাড়িঘর৷
জার্মানিতে বাড়ি সমস্যায় অভিবাসীরা
অভিবাসীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ তবে বাড়ির সমস্যাকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে ধরা যেতে পারে৷এ সমস্যা জার্মানিতে বসবসারত তুর্কিদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়৷ কারণ জার্মানিতে প্রায় ৪০ লাখ তুর্কি আছেন৷
ছবি: Suzheh.sub.ir
অভিবাসী তুর্কিদের সমস্যা বেশি
জার্মানিতে অভিবাসীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ এগুলোর মধ্যে বাড়ির সমস্যাকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে ধরা যেতে পারে৷ জার্মানিতে অভিবাসীদের মধ্যে তুর্কিদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪০ লাখ৷ কাজেই সমস্যাটাও ওদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শীতকালে ঠান্ডায় কষ্ট পায়
তুর্কিদের সাধারণত বাসা ভাড়া দেওয়া হয় পুরনো এলাকায় বহু বছরের পুরনো বাড়িগুলোয়৷ সেই সব বাড়িতে হয়ত দরজা ঠিকমতো বন্ধ হয় না বা জানালা দিয়ে বাতাস ঢোকে বা খানিকটা খোলা থাকে৷ অথবা শীতকালে হিটার কাজ করে না, অর্থাৎ ঠান্ডায় কাটাতে হয়৷ বাড়ির মালিককে কয়েকবার বলেও ঠিক করানো যায়নি৷ এভাবেই জানান তিন দশক আগে তুরস্ক থেকে জার্মানিতে আসা আহমেদ খালিফি৷
ছবি: DW/C. Ruta
বাড়ির অবস্থা অস্বাস্থ্যকর
আহমেদ খালিফির ছেলে আদেলের বাড়িতেও প্রায় একই সমস্যা৷ বাড়িটি ৪০ বছরের পুরনো হওয়ায় খুবই স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার এবং অস্বাস্থ্যকর৷ এ ব্যাপারে অবশ্য বাড়িওয়ালার মাথা ব্যথা নেই, কয়েকবার বলেও কোনো কাজ হয়নি৷
ছবি: DW/C. Ruta
অবশেষে নিজেই দায়িত্ব নেন
আবদাল ১৫ বছর এ বাড়িতে আছেন, কিন্তু একবারও রঙ করা হয়নি৷ আর সেকথা বাড়ির মালিককে কয়েকবার বলায় তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, প্রয়োজনে তিনি যেন নিজেই এ কাজ করে নেন৷ তাই আবদাল এ কাজ ভালো না জানা সত্ত্বেও নিজেই করছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
শীতের কথা ভেবে ভীত
একটি মাত্র ঘর আর সেখানেই বাচ্চাদের নিয়ে থাকেন আলিয়া৷ ঘরে যেসব জিনিসের জায়গা হয় না, সেসব জিনিস স্থান পেয়েছে বাড়ির বারান্দায়৷ কিন্তু শীতের সময় এসব প্রয়োজনীয় জিনিসের কি হবে – তা ভেবে অস্থির আলিয়া৷ এই অবস্থা অবশ্য শুধু আলিয়ার একার নয়৷
ছবি: DW/C. Stefanescu
অভিবাসীদের বেশি সন্তান
অভিবাসীদের বাড়ির বড় সমস্যা৷ তার কারণ, তাঁরা বড় শহরগুলোর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করতে পছন্দ করেন৷ তাছাড়া জার্মানদের তুলনায় অভিবাসীরা কম রোজগার করেন এবং তাঁদের সন্তান সংখ্যা বেশি হওয়ায় বাড়ি পেতেও অসুবিধা হয়৷ এছাড়া একই ধরণের বাড়ির জন্য জার্মানদের তুলনায় তাঁদের কাছে বেশি ভাড়াও চাওয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZB
বাড়ির অবস্থা করুণ
অভিবাসীদের বাসস্থান সমস্যা অবশ্য নতুন সমস্যা নয়৷ অভিবাসীরা যেসব এলাকায় থাকেন সেই পুরনো বাড়িগুলোকে ঠিকঠাক না করানোয়, দিনদিন সেগুলি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছে৷ এই অবস্থা নিদিষ্ট কোনো শহরে নয়, প্রায় শহরেই এই একই অবস্থা৷
ছবি: Fars
আগুনে পরিবারের আট জনের মৃত্যু
প্রায় চার মাস আগে বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যার্গের বাকনাং শহরে একটি বাড়ির বৈদ্যুতিক লাইন ছিল বিপজ্জনক এবং একথা বারবার মালিককে বলার পরও তা ঠিক করা হয়নি৷ যার ফল হয় মর্মান্তিক৷ ঘর গরম বা পানি গরমের জন্য ব্যবহার করা হতো কাঠের চুল্লি৷ ঐ বাড়িতেই আগুন লেগে একজন তুর্কি মা তাঁর সাত সন্তানসহ মারা যান৷ ছবিতে বাকনাং শহরের কিশোর-কিশোরীরা মৃত পরিবারের প্রতি ফুল আর মোমবাতি দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাড়ি মালিকদের মত
বাড়িওয়ালাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, তুর্কি পরিবারগুলো অনেক বড়, সবসময় হৈচৈ লেগে থাকে এবং তেমন পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন নয়৷ আর সেজন্যই তাঁদের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে কিছুটা আপত্তি থাকে বাড়িওয়ালাদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তরুণদের ভিন্নমত
বয়স্ক অভিবাসীরা বাসস্থানের ব্যাপারে যতটা বৈষম্যের শিকার হন বলে মনে করেন, এই প্রজন্মের তুর্কিরা তেমনটা মনে করে না৷ সম্ভবত এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা জার্মান ভাষা ভালো জানার কারণেই এমনটা ঘটছে৷
ছবি: Suzheh.sub.ir
10 ছবি1 | 10
আইনি সীমাবদ্ধতা ও কর্মীর অভাব থাকার কারণে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে সামাল দিতে পারছেন না৷ তাই এখন জার্মান নির্মাণবিষয়ক মন্ত্রী বারবারা হেন্ড্রিকস এক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করেছেন৷ এই ধরনের বাড়িঘর ক্রয় ও পুনর্গঠনকে আরো সম্প্রসারিত করতে চান তিনি৷ এই খাতে ৪০ মিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ১৫০ মিলিয়ন ইউরো ধার্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মন্ত্রী হেন্ড্রিকস৷
নর্থরাইন ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যের কয়েকটি শহর যেমন ডুইসবুর্গ, গেলসেনকিয়র্খেন ও ডর্টমুন্ডে সমস্যাটা প্রবল৷ এই সব শহরের কিছু বিবেকহীন বাড়ির মালিক ক্ষয়ে পড়া বাড়িঘর থেকেই মোটা অঙ্কের ভাড়া তুলে নিতে তৎপর৷ আর তাঁদের সহজ শিকার হলেন অভিবাসীদের এক অংশ৷ উপায়ন্তর না দেখে অল্প একটু ঘুমানোর জায়গার জন্য চড়া ভাড়া দিতেও প্রস্তুত তাঁরা৷
ম্যাট্রেস ভাড়া
গ্রানিকি ডর্টমুন্ডের একটি বাড়ির দুরবস্থার কথা বর্ণনা করছিলেন৷ পাঁচ পরিবারের এই বাড়িটিতে ৭০-৮০টি ম্যাট্রেস দেখতে পেয়েছেন তিনি৷ এই সব ম্যাট্রেসে শোবার জায়গাও ভাড়া নেন অনেকে উঁচু মূল্যে৷
এই ধরনের বাড়িতে প্রায়ই বিল পরিশোধ না করায় গ্যাস, পানি কিংবা বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া হয়৷ ভাড়াটেদের অনেক সময় ঠান্ডার মধ্যেই দিন কাটাতে হয়৷ কিন্তু এই সব সমস্যার কথা কার কাছে জানাবেন তাঁরা? বাড়িওয়ালার দেখাই তো মেলে না৷
এই জাতীয় বাড়ির মালিকরা আসেন বেশির ক্ষেত্রেই যৌন ব্যবসা ও মাদকদ্রব্যের জগৎ থেকে৷ তবে একসময় ‘ম্যাট্রেস ভাড়া দেওয়ার' ব্যাপারটাও পাহাড় সমান হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের কাছে৷ তখন তাঁরা জরাজীর্ণ বাড়িগুলি ছেড়ে দিতে চান৷ কিন্তু আমাদের কাছে আসতে আসতে তিন বছর পর্যন্ত লেগে যায় তাঁদের, জানান ক্লাউস গ্রানিকি৷
দায়িত্ব নেওয়ার পর গ্রানিকি ও তাঁর সহকর্মীরা বাড়িগুলিকে বাসোপযোগী করে তোলেন৷ স্বাভাবিক একটা কাঠামো দেন৷ নতুন রূপ পাওয়া বাসস্থানেও অভিবাসীরা স্বাগত৷ ভাড়াটেদের বংশ পরিচয় এখানে নিতান্তই গৌণ ব্যাপার৷
ডর্টমুন্ট শহরের অবস্থা
২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী, ৫৭২.০৮৭ হাজারেরও বেশি মানুষ বাস করেন ডর্টমুন্ড শহরে৷ এর মধ্যে ৮১.০০০ জন বিদেশি৷ ৪৫০০ জন রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া থেকে এসেছেন৷ এই বছরের জানুয়ারি থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিমালা অনুযায়ী এই দুটি দেশে থেকে আসা মানুষরাও জার্মানিতে কাজ করতে পারবেন৷ এর ফলে বুলগেরিয়া ও রোমানিয়া থেকে যে জনস্রোতের আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা বাস্তবে লক্ষ্য করা যায়নি৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও দারিদ্র্যজনিত অভিবাসনের ভীতিটা জনমন থেকে দূর হয়নি৷