কিছুদিন আগেও মনে করা হতো, জার্মানিতে নিজস্ব গাড়ি না থাকলে ট্রেন ও প্লেনই একমাত্র ভরসা৷ যা বেশ খরচ সাপেক্ষও৷ ইদানীং দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার ব্যাপারে আরেকটি যানকেও পাওয়া যাচ্ছে, আর তা হলো বাস৷ কেমন সেই যাত্রা?
বিজ্ঞাপন
শুক্রবার, বার্লিনের প্রধান বাস স্টেশনের এক চিত্র: রংচঙে কয়েকটি বাস এসে থামছে, কয়েকটি ছেড়ে যাচ্ছে৷ যাত্রীরা দলে দলে বাক্সপ্যাটরা, রুকসাক নিয়ে বিভিন্ন প্লাটফর্মের দিকে যাচ্ছেন৷ কেউ কেউ নামছেন বাস থেকে৷ বাসগুলি যাচ্ছে হামবুর্গ, ড্যুসেলডর্ফ, মিউনিখ, সাউয়ারলান্ড কিংবা হারৎস-এর দিকে৷
রেলেরই ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য
দূর পাল্লার যাত্রার ক্ষেত্রে ৭০ বছরেরও বেশিদিন ধরে এয়ারলাইন্সগুলির পাশাপাশি জার্মান রেলেরই ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য৷ কিন্তু ২০১৩ সালের প্রথম দিকে রেলের একচেটিয়া বাজারটি হেলে পড়ে৷ এখন তো ছোট বড় নানা কোম্পানির বাস ১৭০ এর মতো রুটে চলাচল করছে৷ যাত্রীদের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ কেননা রেল ও বিমানের চেয়ে বাসের ভাড়া তুলনামূলক অনেক কম৷
ভাড়া কম হলেও বাসের সার্ভিস কিন্তু মন্দ নয়৷ সব কোম্পানিই বাসে স্ন্যাক্স, পানীয় ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখে৷ ট্রেনের মতো বাসেও রয়েছে টয়লেট৷ রয়েছে ইন্টারনেটের সংযোগ৷
আমাদের বাস চালক স্টেফান যাত্রা শুরু করলেন৷ সেই সাথে সাদর সম্ভাষণ জানালেন যাত্রীদের৷ আজ তাঁর মেজাজটা বেশ ফুরফুরে মনে হয়৷ ঠাট্টা করে বললেন, ‘‘ড্রিংক্স পাবেন সামনে আমার কাছে৷ টয়লেট রয়েছে বাসের পেছন দিকে৷ আর হ্যাঁ ‘অ্যালার্ম' লেখাটির ওপরে লাল বাতিটাকে কিন্তু ফ্ল্যাশ বলে ভুল করবেন না৷''
বাস ড্রাইভার স্টেফান হালকা হাসি ঠাট্টার মাধ্যমে যাত্রীদের কাছে টানার চেষ্টা করেন৷ ‘ফ্লেক্সিবুস' ও ‘মাইন ফ্যার্নবুস'-এর মতো বাস কোম্পানিগুলিতে নতুন এই ট্রেন্ড লক্ষ্য করা যায়৷
যেখানে যেতে ভালোবাসেন জার্মানরা
জার্মানরা অত্যন্ত ভ্রমণবিলাসী৷ আর কোনো জাতি এদের মতো দুনিয়া ঘোরে না৷ চলতি গ্রীষ্মে জার্মানরা তাহলে কোথায় কোথায় বেড়াতে যাচ্ছেন? আমাদের এই ছবিঘরে পাবেন উত্তর৷
ছবি: Fotolia/m.schuckart
নিজের উঠোন
নিজের দেশে অসংখ্য সুন্দর জায়গা থাকতে বিদেশে যেতে হবে কেন? প্রতি চারজনের একজন জার্মান এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন৷ ফলে জার্মানির মধ্যেই ছুটি কাটানোর ঠিকানা খোঁজেন তাঁরা৷ বাভারিয়ার পাহাড়ে চড়া, বাল্টিক এবং নর্থ সি’র সমুদ্র সৈকতে বিশ্রাম কিংবা রাতের বার্লিন উপভোগ – জার্মানদের সামনে সুযোগ অনেক৷
ছবি: Fotolia/Picturenick
স্পেনের সমুদ্র সৈকতে পার্টি
স্পেনের দ্বীপগুলো অনেক জার্মানের কাছেই প্রিয়৷ বিশেষ করে ভূ-মধ্যসাগরে অবস্থিত মায়োর্কা৷ ‘ফাউন্ডেশন ফর ফিউচার স্টাডিজ’-এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, চলতি বছর প্রায় আট শতাংশের মতো জার্মান স্পেন ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছেন৷ জার্মান পর্যটকদের ব্যাপক ভিড়ের কারণে অনেকে মজা করে মায়োর্কাকে জার্মানির সপ্তদশ রাজ্যও বলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তুরস্কে বিশ্রাম
তুর্কিদের বন্ধুভাবাপন্নতা জার্মানদের বিশেষ আকৃষ্ট করে৷ আর তাই এ বছর পাঁচ শতাংশের মতো জার্মান ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন তুরস্কে৷ দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সমুদ্র উপকূলের বালুর সৈকত জার্মানদের পছন্দ৷ মোটের উপর তুরস্কে ভ্রমণ খুব একটা ব্যয়বহুল নয় এবং জার্মানি থেকে সেদেশ খুব দূরেও নয়৷ সম্ভবত সেসব কারণেই গত বছরের তুলনায় এবার আরো বেশি সংখ্যক জার্মান যাচ্ছেন তুরস্কে৷
ছবি: picture alliance/Friedel Gierth
ইটালির সঙ্গে জার্মানদের প্রণয়
ভেনিস, ফ্লোরেন্স, রোমের মতো ঐতিহাসিক এবং সুন্দর শহরগুলো পর্যটকদের ইটালিতে টেনে নিয়ে যায়৷ জার্মানরা ইটালিয়ানদের সহজ জীবনযাপন পছন্দ করে৷ এ বছর পাঁচ শতাংশের কিছু কম জার্মান সেদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ক্রোয়েশিয়া: ইয়াখ্টিং, স্কুবা ডাইভিংসহ আরো কিছু
ক্রোয়েশিয়াকে কিছু জার্মান মনে করেন ‘‘সস্তা ইটালি’’৷ গত কয়েক বছরে পর্যটকদের গন্তব্যস্থান হিসেবে ক্রোয়েশিয়ার কদর বেশ বেড়েছে৷ ২০১৩ সালে ২.৪ শতাংশ জার্মান সেদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত৷ স্বচ্ছ সমুদ্রজলে স্কুবা ডাইভিং অথবা নৌকা-ভ্রমণ অনেকের প্রথম পছন্দ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অস্ট্রিয়ার মন জুড়ানো পাহাড়ি বাতাস
অস্ট্রিয়ায় কোনো সমুদ্র সৈকত না থাকলেও দুই শতাংশ জার্মান পর্যটক সেদেশ ভ্রমণ করতে চান৷ তাঁরা মূলত আল্পস পর্বতে চড়তে বা সাল্সবুর্গের মতো সুন্দর শহর ভ্রমণেই আগ্রহী৷ অস্ট্রিয়া শুধু জার্মানির প্রতিবেশি দেশই নয়, সেদেশের মানুষ জার্মান ভাষাতে কথাও বলেন৷ ফলে অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ জার্মান – যাঁরা কখনো ইংরেজি শেখেননি – ছুটি কাটাতে অস্ট্রিয়াকে বেছে নেন৷
ছবি: Fotolia/Jakob Radlgruber
ফ্রান্স – এই তো জীবন!
মার্সেই, বর্দো অথবা প্যারিস – এ সব যেন এক-একটা আলোর শহর, জীবনের প্রতিভূ৷ এছাড়া, ফ্রান্সে সংস্কৃতি আর শিল্পকলার কোনো অভাব নেই৷ তারওপর ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলও অনেকের প্রিয়৷ তাই চলতি বছর দুই শতাংশের কিছু কম জার্মান সেদেশ সফরের পরিকল্পনা করছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার শেষ না হওয়া গ্রীষ্মের দিন
খুব বেশি ব্যয়বহুল না হলে সম্ভবত আরো অনেক বেশি জার্মান স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলো ভ্রমণ করতেন৷ তারপরও ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের অসাধারণ প্রকৃতি দেখতে খানিকটা বেশি টাকা খরচ করতে ১.৫ শতাংশ জার্মানের কোনো আপত্তি নেই৷
ছবি: Fotolia/World Images
গ্রিসের অসংখ্য দ্বীপ
গ্রিক দ্বীপে ছুটি কাটানোটা জার্মানদের জন্য বেশ কঠিন, কেননা এক হাজারেরও বেশি দ্বীপের মধ্য থেকে পছন্দেরটি বাছাই করা সহজ কথা নয়! তবে একটি বিষয় মাথায় রাখলে বিষয়টি সহজ৷ আর তা হচ্ছে, এসব দ্বীপের প্রায় সবকটিতে চমৎকার সৈকত রয়েছে৷ বর্তমানে অবশ্য আর্থিক মন্দার কারণে জার্মানিতে গ্রিকদের ভাবমূর্তি খানিকটা পড়তির দিকে৷ তারপরও এক শতাংশের কিছু কম জার্মান চলতি বছর গ্রিস সফরে আগ্রহী৷
ছবি: picture-alliance/Oliviero Oliv
আরো যা পছন্দ
আফ্রিকায় শিকার অভিযান, ক্যানাডায় ভালুক দেখা, দক্ষিণ অ্যামেরিকার রেনফরেস্ট কিংবা চীনের গ্রেট ওয়াল পরিদর্শন – চলতি বছর মাত্র আট শতাংশ জার্মান এরকম দূরের গন্তব্যে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন৷ স্বাভাবিকভাবেই, এ ধরনের ভ্রমণের খরচ নিজ দেশে ছুটি কাটানোর চেয়ে আড়াই গুন বেশি৷
ছবি: Fotolia/m.schuckart
10 ছবি1 | 10
তরুণদের কাছে টানাই মূল লক্ষ্য
আগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করার জন্য নানা ধরনের বাস ট্রিপের আয়োজন করতো৷ যাকে ‘কফি ট্রিপ' বলা হতো৷ সাধারণত অবসরভোগী প্রবীণ জনগোষ্ঠীই এই ধরনের ট্রিপে অংশগ্রহণ করতেন৷ আজকের বাসযাত্রা এই ইমেজটা দূর করতে চায়৷ বাস কোম্পানিগুলি এখন তরুণ ও ছাত্রছাত্রীদের কাছে টানতে চায়, যাদের চড়া মূল্যে টিকেট কেনার সামর্থ্য নেই৷ তার বদলে যাত্রার সময়টা দীর্ঘ হলেও মেনে নেয়৷ আর তাই এই তরুণ সম্প্রদায়ের মন মানসিকতা অনুযায়ী পরিবেশটাও তৈরি করার চেষ্টা করা হয়৷ সাধারণত বাসগুলি ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার পাড়ি দেয়৷ প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রেনের চাইতে নিঃসন্দেহে অনেক মন্থর৷ সপ্তাহান্তে ও স্কুলের ছুটিকালীন সময়ে যানজটের কবলেও পড়তে হয় এই যানগুলিকে৷ ‘গতি' হয়ে পড়ে আরো শ্লথ৷
দেরিতে হলেও ঠিক মতো পৌঁছানো
ওদিকে বাস চালক স্টেফান ধীরে ধীরে বাভারিয়ার রাজধানী মিউনিখে পৌঁছালেন৷ বাইরে তখন অন্ধকার নেমেছে৷ বেশিরভাগ যাত্রী ঘুমাচ্ছেন৷ ভেতরে গুমোট বাতাস৷ হঠাৎ শোনা গেল স্টেফানের কন্ঠ: ‘‘প্রিয় যাত্রীরা, আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই মিউনিখের প্রধান বাস স্টেশনে পৌঁছাচ্ছি৷ যারা এখনও ঘুমাচ্ছেন, তাঁদের সময় হয়েছে জেগে ওঠার৷''
স্টেফান ধীরেসুস্থে মোটরওয়ে থেকে বের হয়ে বাসটি স্টেশনের দিকে চালাতে চালাতে ঠাট্টার সুরে ঘুম ভাঙাতে চেষ্টা করলেন যাত্রীদের৷ এর কিছুক্ষণ পর ২১ মিনিট বিলম্বে বিশাল যানটি এসে থামলো নির্দষ্ট টার্মিনালে৷ প্রায় ৮ ঘণ্টার যাত্রা শেষ হলো৷ ভাড়া লেগেছে ১৭ ইউরো৷ যাঁরা ধৈর্যশীল ও বিলাসিতার জন্য আকুল নন, তাঁদের কাছে বাসের জুড়ি নেই৷ অন্তত ভাড়ার দিক দিয়ে তো বটেই৷