বাংলাদেশি-জার্মান চলচ্চিত্র নির্মাতা শাহীন দিল রিয়াজ৷ জার্মানির রুপালি জগতে এক পরিচিত মুখ তিনি৷ তাঁর তৈরি বেশ কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র জার্মানি তথা ইউরোপে টেলিভিশনে এবং বড় পর্দায় প্রদর্শিত হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির সঙ্গে শাহীনের সখ্য গড়ে উঠেছিল জার্মান ভাষার শেখার মধ্যে দিয়ে৷ ঢাকার গ্যোটে ইন্সটিটিউটে ভাষা শিখতে গিয়ে বৃত্তি নিয়ে জার্মানিতে আসার সুযোগ পান৷ সেটা নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকের কথা৷ জার্মানিতে সেই সফর দেশটির প্রতি তাঁকে আরো আকৃষ্ট করে তোলে৷ পরবর্তীতে চলচ্চিত্র নিয়ে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে জার্মানিতে চলে আসেন তিনি এবং বার্লিনের ফ্রেই ইউনিভার্সিটিতে আর্ট হিস্ট্রি শেষে করে এইচএফএফ কনার্ড-উলফ ফিল্ম স্কুলে সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে লেখাপড়া করেন৷
জার্মানিতে তথ্যচিত্রের ভালো বাজার রয়েছে বলে মনে করেন শাহীন দিল-রিয়াজ৷ বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তথ্যচিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করে৷ ফলে ভালো গল্প থাকলে অর্থের সংস্থান তেমন কঠিন ব্যাপার হয় না৷ আর বাংলাদেশ থেকে আসায় সেদেশ সম্পর্কিত তথ্যচিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব পান শাহীন৷ তবে বাংলাদেশে তথ্যচিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ এক বড় বাধা বলে মনে করেন শাহীন দিল-রিয়াজ৷
এখন পর্যন্ত আটটি ছবি নির্মাণ করেছেন এই বাঙালি পরিচালক৷ এর মধ্যে ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘লোহাখোর'-কে সবার ওপরে রাখতে চান তিনি৷ চট্টগ্রামের জাহাজভাঙা শিল্প নিয়ে তৈরি ছবিটি জার্মানিসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলেছিল৷ তবে শুধু বাংলাদেশ নয়, শাহীনের তৈরি তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে আফগানিস্তানে জার্মান সেনাদের কর্মকাণ্ডও৷
চট্টগ্রাম – জাহাজের কবরস্থান
প্রতিবছর এক হাজারের বেশি জাহাজ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়৷ এগুলোর অধিকাংশের শেষ ঠিকানা তখন হয় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের কোনো শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে৷ এই কাজ অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং প্রাণঘাতী৷
ছবি: DW/G. Ketels
শান্তিতে থাকুক?
চট্টগ্রামে কয়েক ডজন শিপব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে৷ দুই লাখের মতো শ্রমিক হাজার কোটি টাকার এই বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ বড় বড় জাহাজ টুকরা টুকরা করার কাজ অধিকাংশক্ষেত্রে করে খালি হাতে৷ তাই শারীরিক ক্ষতি এমনকি মৃত্যু সেখানে অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়৷
ছবি: DW/G. Ketels
আলমগীর – জাহাজের কবর খোঁড়েন যিনি
ডয়চে ভেলের লাইফ লিংকস অনুষ্ঠানের ‘#হেডএবাভওয়াটার’ পর্বের জন্য আমরা আলমগীরের সঙ্গে দেখা করতে চট্টগ্রাম যাই৷ সে দিনে ১৪ ঘণ্টার মতো কাজ করে৷ মজুরিও অনেক কম৷
ছবি: DW/G. Ketels
টুকরা টুকরা করে ফেলা হয়
একটি মালবাহী শিপ গড়ে ২৫ থেকে ৩০ বছর ব্যবহার করা যায়৷ এরপর সেটার ইন্সুরেন্স এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ এত বেড়ে যায় যে সেটি ব্যবহার আর লাভজনক থাকে না৷ ফলে অধিকাংশ জাহাজ তখন চলে যায় বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তানের কোনো শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে৷ এ সব ইয়ার্ডে মূলত অদক্ষ শ্রমিকরা জাহাজ ভাঙার কাজ করে৷
ছবি: DW/G. Ketels
বিপজ্জনক বিনাশ
একটি জাহাজের ভেতরের অংশ প্রথমে ভাঙা হয়৷ কাজটি অত্যন্ত কঠিন এবং বিপজ্জনক৷ কেননা জাহাজ তৈরি করা হয় এমনভাবে, যাতে সেটা প্রতিকূল আবহাওয়ার মোকাবিলা করতে পারে এবং ভেঙে না যায়৷ তাই সেই জাহাজ কার্যত খালি হাতে ভাঙতে গিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার শঙ্কায় থাকেন শ্রমিকরা৷
ছবি: DW/G. Ketels
ধীরে ধীরে মৃত্যু
অধিকাংশ শ্রমিককে কাজ করার সময় ‘প্রটেকটিভ গিয়ার’ দেয়া হয়না৷ তারা জাহাজ ভাঙেন খালি হাতে ‘এসেটিলিন টর্চ’ ব্যবহার করেন৷ অদক্ষ এই শ্রমিকরা কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনা বা বিস্ফোরণে আহত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন৷
ছবি: DW/G. Ketels
বিপজ্জনক অবস্থা
জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকরা কাজ করার সময় বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে আসেন যা ফুসফুসে সমস্যা, এমনকি ক্যানসারেরও কারণ হতে পারে৷ আরা যাঁরা কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁদের পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে না ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ৷ এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণও দেয়া হয় না৷
ছবি: DW/G. Ketels
স্টিলের উৎস
বেসরকারি উন্নয়নসংস্থা শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর দু’শ-র মতো জাহাজ চট্টগ্রামে ভাঙা হয়৷ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে স্টিলের যে চাহিদা রয়েছে, তার অধিকাংশই জোগাড় হয় জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে৷ চট্টগ্রামের উত্তরে সীতাকুণ্ড হচ্ছে এই শিল্পের রাজধানী৷ সেখানে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সৈকতে আট মাইল এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে এই শিল্প৷
ছবি: DW/G. Ketels
১৯৬৯ সালে শুরু
চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা শুরু হয় ১৯৬৯ সালের দিকে৷ একটি স্টিল কোম্পানি সেসময় একটি অকেজো জাহাজ সেখানে নিয়ে যায় এবং ভাঙতে শুরু করে৷ কয়েক বছর লেগেছিল সেটি ভাঙতে৷ চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা শিল্পের শুরুটা এভাবেই৷
ছবি: DW/G. Ketels
শিশুরাও কাজ করছে
জাহাজ ভাঙা শিল্পে শিশুশ্রম সাধারণ ব্যাপার৷ বাংলাদেশের মোট কর্মশক্তির এক পঞ্চমাংশের বয়স ১৫ বছরের নীচে৷ ধারণা করা হয় জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের অর্ধেকের বয়স ২২ বছরের নীচে৷ অল্প বয়সি শিশুরা গ্যাস কাটারদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে এবং মালামাল বহন করে৷ এসব শিশু লেখাপড়ার সুযোগ পাওয়া না এবং বিরূপ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হয়৷
ছবি: DW/G. Ketels
পণ্য বিক্রি
জাহাজের মধ্যে পাওয়া বিভিন্ন পণ্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করেন শ্রমিকরা৷ এ সবের মধ্যে আসবাবপত্র এবং ‘শো পিস’ ছাড়াও রয়েছে মালিকদের জাহাজে ফেলে যাওয়া বিভিন্ন সামগ্রী৷
ছবি: DW/G. Ketels
দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ
সীতাকুণ্ডের সমুদ্র সৈকত একসময় পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এক স্থান ছিল৷ কিন্তু এখন জাহাজ ভাঙা শিল্পের কারণে সেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ৷ শিপিং ইয়ার্ড থেকে বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে৷ বাংলাদেশ সরকার এক্ষেত্রে বেশ উদাসীন৷
ছবি: DW/G. Ketels
11 ছবি1 | 11
এখন অবধি নির্মিত ছবিগুলোর জন্য ১০টি শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কারসহ অন্তত ১৯টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করেছেন এই চলচ্চিত্র নির্মাতা৷ এর মধ্যে জার্মান নির্মাতাদের জন্য সবচেয়ে সম্মানজনক ‘আডল্ফ গ্রিমে' পুরস্কার রয়েছে দু'টি৷ ২০১০ সালে লোহাখোর এবং ২০১৩ সালে ‘প্রজেকশনিস্ট' ছবির জন্য এই পুরস্কার জয় করেন তিনি৷
শাহীনের জীবনকাহিনি নিয়ে এক সুইস নাট্য পরিচালক একটি নাটকও তৈরি করেছেন, যা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মঞ্চস্থ হয়েছে৷ চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবেও কাজ করেন তিনি৷
বর্তমানে বাংলাদেশের বাঁশকাটা শিল্পের একটি দিক নিয়ে কাজ করছেন শাহীন দিল-রিয়াজ৷ ইতোমধ্যে চিত্রায়নের কাজ সম্পন্ন হয়েছে, এখন চলছে সম্পাদনা৷ সব কিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরই ছবিটি ইউরোপে মুক্তি পেতে পারে৷ তবে জার্মানি এবং ইউরোপে প্রামাণ্যচিত্র দিয়ে ব্যাপক পরিচিতি পেলেও ফিকশন নির্মাণে আগ্রহী শাহীন৷ অদূর ভবিষ্যতে সেদিকে মনোযোগী হবেন বলে জানিয়েছেন এই বাঙালি তথ্যচিত্র নির্মাতা৷