একটানা প্রায় ২৪ ঘণ্টা আলাপ-আলোচনার পর জার্মানির আগামী সরকার গড়ার পথ সুগম হয়েছে৷ দলীয় সম্মতি পেলে এবার এসপিডি ও ইউনিয়ন শিবির মহাজোট সরকার গড়ার লক্ষ্যে আলোচনা শুরু করতে পারে৷
বিজ্ঞাপন
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটিয়ে জার্মানিতে দ্রুত স্থিতিশীল সরকার গঠন করা কি আদৌ সম্ভব হবে কি না, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত সেই বিষয়টি অস্পষ্ট ছিল৷ ইউনিয়ন ও এসপিডি শিবিরের দীর্ঘ ও জটিল আলোচনার প্রেক্ষাপটে মহাজোট সরকার গঠনের সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় দেখা দিচ্ছিল৷ অবশেষে দুই পক্ষ মহাজোট সরকার গঠনের লক্ষ্যে আলোচনা শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ দুই শিবিরের ৩ শীর্ষ নেতা আনুষ্ঠানিকভাবে সবুজ সংকেত দিতে চলেছেন৷ তবে খুঁটিনাটি বিষয়গুলির নিষ্পত্তি করতে আরও কিছুটা সময় লাগবে বলে জানা যাচ্ছে৷
এক দিন প্রায় টানা দর কষাকষির পরেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মহাজোট গঠনের প্রশ্নে ঐকমত্যে আসতে পারেনি জার্মানির দুই রাজনৈতিক শিবির৷ বৃহস্পতিবার গভীর রাতে চূড়ান্ত ঘোষণার আশা করা হচ্ছিলো৷ কিন্তু কয়েকটি বিষয়ে মতবিরোধ দূর করা সম্ভব না হওয়ায় আলোচনা শেষ হচ্ছিল না৷ তবে শুক্রবারই এই প্রক্রিয়া শেষ করার জন্য প্রবল চাপ বজায় ছিল৷
আর্থিক কিছু বিষয় ও শরণার্থীদের প্রশ্নে এসপিডি ও ইউনিয়ন শিবিরের মধ্যে মতবিরোধ কাটছিল না বলে জানা গেছে৷ বিদায়ী সরকার বাজেট ঘাটতি দূর করে নতুন সরকারি ঋণ নেওয়া বন্ধ করতে পেরেছে৷ ইউনিয়ন শিবির ভবিষ্যতেও এই ভারসাম্য বজায় রেখে সরকারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে চায়৷ কিন্তু এসপিডি দলের বেশ কিছু দাবি কার্যকর করতে গেলে বাড়তি ব্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে৷
দুই পক্ষের মধ্যস্থতাকারীরা গোপনীয়তার বেড়াজালে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন বলে খুঁটিনাটি বিষয়গুলি জানা যাচ্ছিল না৷ ইউনিয়ন শিবির মহাজোট গড়তে বদ্ধপরিকর৷ অন্যদিকে এসপিডি কোনো পূর্বনির্ধারিত ফলাফলের আশা ছাড়াই আলোচনা শুরু করেছিল৷ অর্থাৎ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত মহাজোট গঠন করা সম্ভব না-ও হতে পারে৷ দলীয় সম্মেলনে সম্মতি পেলে তবেই এসপিডি জোট গড়ার পথে এগোতে পারবে৷
বৃহস্পতিবার এসপিডি, সিডিইউ ও সিএসইউ দলের শীর্ষ ও সংসদীয় নেতারা আলোচনার হাল ধরেছেন৷ যখনই কোনো বিষয় নিয়ে বিরোধ দেখা দিয়েছে, তাঁরা দলীয় বিশেষজ্ঞদের ডেকে নিয়েছেন৷ কিছু সময় পর পর দলের নেতৃত্বমণ্ডলীর সঙ্গে শলাপরামর্শও করেছেন তাঁরা৷ চূড়ান্ত ঐকমত্য যে কঠিন হবে, বৃহস্পতিবারই সেই আভাস দিয়েছিলেন সিডিইউ নেত্রী আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও এসপিডি নেতা মার্টিন শুলৎস৷
এমন প্রেক্ষাপটে ঐকমত্য সত্ত্বেও জার্মানিতে সরকার গঠনের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা বিফল হলে চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল গভীর সংকটে পড়তে পারেন৷ তাঁকে সংখ্যালঘু সরকার অথবা নতুন নির্বাচনের মধ্যে কোনো একটি কঠিন বিকল্প বেছে নিতে হবে৷ জার্মানিতে দ্রুত স্থিতিশীল সরকার গঠন করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রত্যাশা ও চাপও কাজ করছে৷
কী চায় জার্মানির এসপিডি দল?
ছোট শরিক হয়েও জার্মানির বিদায়ী মহাজোট সরকারে যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গে অনেক দলীয় সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পেরেছে এসপিডি দল৷ তবে ভোটাররা তার স্বীকৃতি দেয়নি৷ আবার মহাজোটে যোগ দিলে অনেকগুলি শর্ত চাপাতে চায় এসপিডি৷
ছবি: picture-alliance/U. Baumgarten
‘আরও ইউরোপ’
বর্তমান সংকটগুলির সমাধানের লক্ষ্যে ব্রেক্সিটের পথে না গিয়ে ইইউ-কে আরও শক্তিশালী করে তুলতে চায় জার্মানির সামাজিক গণতন্ত্রী দল৷ ইউরোপীয় স্তরে ন্যূনতম মজুরি, তরুণদের বেকারত্বের মোকাবিলা, কোম্পানিগুলির উপর অভিন্ন কর চাপানো এবং ‘কর ফাঁকির মরুদ্যান’ বন্ধের দাবি জানাচ্ছেন দলের নেতা মার্টিন শুলৎস৷ ২০২৫ সালের মধ্যে ‘ইউরোপীয় যুক্তরাষ্ট্র’ স্থাপনের স্বপ্ন দেখছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এই প্রাক্তন স্পিকার৷
ছবি: Getty Images/AFP/F. Florin
শ্রমিকদের আরও অধিকার
জার্মানিতে শ্রমিক-কর্মীদের অধিকার বাড়াতে চিরকাল উদ্যোগ নিয়ে এসেছে সামাজিক গণতন্ত্রী দল৷ তবে সাম্প্রতিক কিছু সংস্কারের ফলে সেই ভাবমূর্তি বেশ ক্ষুণ্ণ হয়েছে৷ এবার বেতন ও মজুরি কাঠামো কার্যকর করা ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার দাবি জানাচ্ছে এসপিডি৷ তাছাড়া যারা পার্ট টাইম বা খন্ডকালীন কাজ করছে, তাদের ফুল টাইম বা পূর্ণ কাজের কাঠামোয় ফিরে যাবার অধিকারের স্বীকৃতি চায় এসপিডি৷
ছবি: picture-alliance/Ulrich Baumgarten
অবসর ভাতার আমূল পরিবর্তন
সমাজে সংহতির ভিত্তিতে জার্মানির অবসর ভাতা কাঠামোর আমূল পরিবর্তন চায় সামাজিক গণতন্ত্রী দল৷ বিশেষ করে সারা জীবন কাজ করেও শেষ বয়সে দারিদ্র্যের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চায় এসপিডি৷ অতএব সংহতির স্বার্থে অবসর ভাতার বিচ্ছিন্ন সব কাঠামোগুলিকে একত্র করার চেষ্টা চালাতে চায় তারা৷ অত্যন্ত জটিল এই ব্যবস্থার রাতারাতি পরিবর্তন যে কঠিন হবে, সে বিষয়ে অবশ্য তেমন সংশয় নেই৷
ছবি: picture-alliance/S. Gollnow
বিনামূল্যে শিক্ষা
জার্মানির শিক্ষাব্যবস্থার একটা বড় অংশই সরকারি ভরতুকিতে চলে৷ তবে অবকাঠামোর কিছু দুর্বলতার ফলে সমস্যা রয়েছে৷ বিশেষ করে শিক্ষা রাজ্য সরকারগুলির এক্তিয়ারে থাকায় এ ক্ষেত্রে সার্বিক উদ্যোগ নেওয়া কঠিন৷ এসপিডি দলের দাবি, সারা দেশে বিনামূল্যে কিন্ডারগার্টেন ও সেখানে সারাদিন বাচ্চা রাখার সুযোগকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে৷ এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির আধুনিকীকরণসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে আরও বিনিয়োগ চাই৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gambarini
স্বাস্থ্যবিমা ব্যবস্থার সংস্কার
বর্তমানে জার্মানিতে সার্বজনীন ও বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমা চালু রয়েছে৷ ডাক্তারখানা ও হাসপাতালে বেসরকারি স্বাস্থ্য বিমাকারীদের বিশেষ খাতির করা হয়, অন্যদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়৷ এই বিভাজন ঘুঁচিয়ে সবাইকে নিয়ে এক ‘নাগরিক স্বাস্থবিমা’ চালু করতে চায় সামাজিক গণতন্ত্রীরা৷ তবে এই প্রস্তাবের জোরালো বিরোধিতা করছে বেশ কিছু মহল৷ তাদের আশঙ্কা, এর ফলে স্বাস্থ্য অবকাঠামোর মানের ক্ষতি হবে৷
ছবি: Colourbox
শরণার্থী নীতি
২০১৫ সালে বিশাল সংখ্যক শরণার্থীর ঢলের কারণে জার্মানির রাজনীতি জগত উত্তাল হয়ে উঠেছে৷ চ্যান্সেলর ম্যার্কেল তাঁর উদার মনোভাবের জন্য প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছেন৷ এসপিডি গোটা অভিবাসন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের দাবি জানাচ্ছে, যাতে আইনি পথে বিদেশিরা জার্মানিতে এসে কাজের সুযোগ পায়৷ তবে রাজনৈতিক আশ্রয়ের অধিকার সঙ্কুচিত করার বিরোধী এই দল৷ আশ্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো ঊর্ধসীমাও মানতে নারাজ তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Jensen
জোরদার নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সন্ত্রাসী হামলা ও অপরাধ দমন করতে প্রায়ই হিমশিম খায় জার্মানির পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ৷ ফলে মানুষের মনে অসন্তোষ দেখা যায়৷ এই সমস্যার মোকাবিলা করতে এসপিডি দল আরও পুলিশকর্মী নিয়োগের দাবি জানাচ্ছে৷ সেইসঙ্গে অপরাধ প্রতিরোধ করার জোরালো উদ্যোগ চায় তারা৷ তাদের মতে, দাগী অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে গোটা ব্যবস্থায় আরও দক্ষতার ছাপ আনতে হবে৷
ছবি: Picture-Alliance/dpa/B. Marks
পরিবেশ সংরক্ষণ
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রে এককালে জার্মানি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে৷ বিকল্প জ্বালানির বিকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্যও এসেছে৷ কিন্তু কয়লার লাগাতার ব্যবহার, ডিজেল গাড়ি নিয়ে বিতর্কের মতো কারণে এ ক্ষেত্রে জার্মানির ভাবমূর্তি বেশ ধাক্কা খাচ্ছে৷ এমন প্রেক্ষাপটে এসপিডি বিকল্প জ্বালানির আরও ব্যবহারের উপর জোর দিতে চায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নারী-পুরুষের সমানাধিকার
শিল্পোন্নত দেশগুলিতেও কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বেতন বৈষম্য বাস্তব সমস্যা৷ এই তালিকায় জার্মানির অবস্থান ভালো নয়৷ একাধিক সরকার এই বৈষম্য দূর করতে শিল্প-বাণিজ্য জগতের সঙ্গে বোঝাপড়ার চেষ্টা করেও বিফল হয়েছে৷ এবার এসপিডি দল চায়, আলাপ-আলোচনার বদলে আইন করে তাদের এই বৈষম্য দূর করতে বাধ্য করা হোক৷