জার্মানিতে সরকার বদলালেও প্রশাসন বদলায় না
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯এক কথায় বলা যায়, জার্মানিতে সরকারি চাকুরিজীবীদের দলীয়করণের চেষ্টা করা হয় না৷ গুরুত্বপূর্ণ কোনো নিয়োগে দলীয় পরিচয় জার্মানিতে মুখ্য নয়৷
বাংলাদেশে একটি বিষয় বেশ স্পষ্টভাবে দেখা যায়৷ সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রশাসনে প্রতক্ষ্যভাবে ব্যাপক রদবদল হয়৷ বিষয়টি এমন যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দলটির সমর্থক সরকারি চাকুরিজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ পদে যাবেন, দ্রুত পদোন্নতি পাবেন৷ সরকারি চাকুরিতে নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রেও সেই দলের সদস্য, শুভানুধ্যায়ীরা প্রাধান্য পাবেন৷ শুধু তাই নয়, যারা দলটির সমর্থক নন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, এমন মানুষদের কেউ কেউ হন ওএসডি, কেউবা অবসরে যেতে বাধ্য হন৷
বলছি না শুধু আওয়ামী লীগই এমনটা করে৷ বিএনপির মধ্যেও এই চর্চা আছে৷ এমনকি অতীতে সামরিক সরকারের মধ্যেও এমন প্রবণতা দেখা গেছে৷ আর ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, দেশের সাধারণ মানুষও এই বিষয়টি প্রকারান্তরে মেনে নেন বলেই মনে হয়৷
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দ্বিতীয় মেয়াদে আমরা দেখেছি, বিচার বিভাগেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে৷ বাংলাদেশের একজন প্রধান বিচারপতির দেয়া কিছু সিদ্ধান্ত ক্ষমতাসীন দলের পছন্দ না হওয়ায় রাতারাতি তাঁর বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ গণমাধ্যমে, রাজনীতিবিদদের কথায় উঠে এসেছে৷ ফলশ্রুতিতে একপর্যায়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি৷ এমনকি ইতোমধ্যে দু'টো দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়েরও প্রার্থনা করেছেন সেই বিচারপতি৷ শুধু তাই নয়, তিনি একটি বইও লিখেছেন, যেখানে বিচার বিভাগের উপর সরকারের হস্তক্ষেপের নানা উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে৷
বাংলাদেশে সবকিছু দলীয়করণের এই চেষ্টা জার্মানিতেও হয় কিনা তা নিয়ে লেখার দায়িত্ব পড়েছে আমার উপর৷ তো, শুরুতে ডয়চে ভেলের আর্কাইভ ঘেঁটে তেমন কিছু পেলাম না৷ এরপর যোগাযোগ করি ডয়চে ভেলের রাজনীতি বিষয়ক ডেস্কের সঙ্গে৷ সেখানে কর্মরত একাধিক জার্মান সাংবাদিক সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলে যা জানলাম তা হচ্ছে, জার্মানিতে জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ কিংবা সামরিক বাহিনী - কোথাও দলীয়করণের চেষ্টার নজির তেমন একটা নেই৷ রাজনীতিবিদদের মধ্যে এ ধরনের কোনো চেষ্টাও নেই৷
এক্ষেত্রে জার্মানিতে একযুগ বসবাসের অভিজ্ঞতা থেকেও কিছু কথা বলতে পারি৷ আমার কাছে মনে হয়েছে, জার্মানির রাজনৈতিক দলগুলো পুরোপুরি জনসমর্থন নির্ভর৷ দেশটিতে বর্তমানে টানা চতুর্থ মেয়াদে চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করছেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ তবে, এসব মেয়াদে ম্যার্কেলের দল সিডিইউ একক দল হিসেবে নয়, বরং অন্যান্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট গড়েই সরকার গঠন করেছেন৷ এটা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, জার্মানিতে বর্তমান মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চিরশত্রুতা বলে কোনো ব্যাপার নেই৷ বরং সবচেয়ে বড় দুই দল জনগণের স্বার্থে একত্রে সরকার গঠন করতেও দ্বিধা করছে না৷
দলগুলোর জনসম্পৃক্ততা বোঝার আরেকটি বড় উদাহরণ ম্যার্কেলের শরণার্থী নীতি৷ ২০১৫ সালের শরণার্থী সংকটের সময় ১০ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয় জার্মান সরকার৷ ম্যার্কেল শক্তভাবে শরণার্থীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তখন৷ কিন্তু তাঁর এই অবস্থান জার্মানির ভোটারদের একাংশ পছন্দ করেননি৷ ফলে, ক্রমশ ভোটার হারাতে থাকে তাঁর দল৷
ভোটারদের মনের এই অবস্থা বুঝতে পেরে ম্যার্কেল তাঁর নীতিথেকে সরে না এলেও সরকারে কিছু পরিবর্তন এনেছেন৷ তিনি এমন একজন রাজনীতিবিদকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছেন, যিনি শরণার্থীবিরোধী হিসেবে পরিচিত৷ পাশাপাশি যেসব শরণার্থীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াও ত্বরান্বিত করেছেন৷ অবৈধ শরণার্থীদের ধরতে পুলিশের অভিযান দৃশ্যমানভাবে বাড়িয়েছেন৷ মোটের উপর জার্মানদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে, শরণার্থীদের সম্পর্কে যত নেতিবাচক কথা ছড়ানো হচ্ছে, তার একটা বড় অংশই গুজব৷
এখানে শিক্ষণীয় হচ্ছে, ম্যার্কেল কিন্তু জনসমর্থনের চিন্তা বাদ দিয়ে জনপ্রশাসন কিংবা বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাচ্ছেন না৷ বরং যেসব ভোটার তাঁর সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর দলকে বাদ দিয়ে অন্য দলকে ভোট দিয়েছে, সেসব ভোটারকে তিনি নানাভাবে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন৷ এটাই গণতন্ত্র৷ আর গণতন্ত্রের এমন চর্চা যত বাড়বে, ততই মঙ্গল৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলতে চান? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷