সামান হাদ্দাদ তার নাম৷ ১৩ বছর বয়সে শরণার্থী হয়ে এসেছিলেন জার্মানিতে৷ এখন তিনি দেশটির সাবেক রাজধানী বনের একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব৷
বিজ্ঞাপন
সামান হাদ্দাদ একজন সঙ্গীত আয়োজক৷ তার দু'টো ব্যান্ড- ৩০-পিস কুলতুর্কলুঙ্গেল অর্কেস্ট্রা ও গোল্ডেন কাবাব৷ কিন্তু তিনি শুধু একজন মিউজিশিয়ান নন, তার চেয়েও বেশি কিছু৷
গেল কয়েক বছরে তিনি ভাসমান নৌকায় বা চলমান দ্বিতল বাসে কনসার্ট করেছেন৷ এছাড়াও বন শহরে আয়োজন করেছেন আন্তঃসাংস্কৃতিক নৈশ ভোজন৷ এছাড়া গ্যোয়েটে ইনস্টিটিউটের হয়ে নিজভূমি উত্তর ইরাকেও গিয়েছেন সাংস্কৃতিক বিনিময় করতে৷
এসবের পেছনে কাজ করে তার মানুষের প্রতি ভালবাসা৷ নিজেকে তিনি ‘সংস্কৃতির বাহক' বলে ব্যাখ্যা করেন৷ তাকে অন্যরা বলেন ‘সংস্কৃতির দূত'৷ কখনো নিজেকে ডাকেন মুস্তাফা মুস্টারমান বা সালভাদর আলী বলে৷
‘‘মধ্যপ্রাচ্যে আমরা যখন একসাথে হই, নিয়ম হল কিছু খেতে হবে- আমি সবাইকে সবসময় ছোট ছোট ডিশ খেতে দিতাম,'' শুরুর কথা বলছিলেন হাদ্দাদ৷ দশ বছর আগে তার এই ‘কালচারাল মিশন' শুরু হয় খাবারকে কেন্দ্র করে৷ তখন তার বাসায় অনেকে আসতেন৷ সেখানেই একটা পুরোনো গিটার বাজিয়ে সবার মনোরঞ্জন করতেন তিনি৷
তার কিচেন হয়ে উঠল একটি প্রতিষ্ঠান আর সঙ্গীতময়সমাবেশটি হতে থাকল নিয়মিত৷
‘‘বলকান অঞ্চলে একটি সুন্দর কথা প্রচলিত আছে- ক্ষুধার্ত ভালুক নাচতে পারে না৷ খুবই সহজ কথা৷ আপনাকে প্রথমে মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে হবে৷ এরপরই কেবল তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেন,'' বলেন তিনি৷
এভাবেই একটা সময় নতুন ও পেশাদার শিল্পীদের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন হাদ্দাদ৷ তার কিচেনের নাম দেন ‘ফিয়ারটেলবার'৷
শুধু নিজের কিচেনেই নয়, হাদ্দাদ বন শহরের কেন্দ্রীয় উদ্যান ও ‘টাউনশিপ' নামের একটি পার্টি জাহাজে নিয়মিত কনসার্ট আয়োজন করতে লাগলেন৷ তার সঙ্গে যোগ দিলেন অনেক প্রথিতযশা মিউজিশিয়ান৷
৮ তারকা যাঁরা একসময় শরণার্থী ছিলেন
সংগীত শিল্পী, অভিনেত্রী থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ - বিশ্বখ্যাত এমন অনেক তারকাকে নানা কারণে জীবনের একটি সময় শরণার্থীর জীবন বেছে নিতে হয়েছিল৷ ছবিঘরে থাকছে তাঁদের কয়েকজনের কথা৷
ছবি: Getty Images
মারলেনে ডিটরিশ
১৯০১ সালে জার্মানিতে জন্ম নেয়া ডিটরিশ গায়িকা ও অভিনেত্রী হিসেবে বেশ নাম কুড়িয়েছিলেন৷ ১৯৩০ সালে তিনি হলিউডে কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান৷ সেখানে থাকলেও নাৎসি আমলের সমালোচনায় মুখর ছিলেন তিনি৷ ১৯৩৯ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি মার্কিন বাহিনীর জন্য গান গেয়েছেন৷ নাৎসি সরকার জার্মানিতে তাঁর মুভি প্রদর্শনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হেনরি কিসিঞ্জার
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার জার্মানির বাভারিয়া রাজ্যে জন্মেছিলেন৷ নাৎসি সরকারের নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ১৯৩৮ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Schiefelbein
মেডেলিন অলব্রাইট
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অলব্রাইট চেক প্রজাতন্ত্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন৷ ১৯৪৮ সালে সে দেশে কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় গেলে তিনি তাঁর পরিবারসহ যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Loeb
আলবার্ট আইনস্টাইন
জার্মান ইহুদি এই নোবেল বিজয়ী যখন ১৯৩৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সফরে ছিলেন তখনই বুঝতে পারেন যে, তাঁর পক্ষে আর জার্মানি ফেরা সম্ভব নয়৷ কারণ ঐ বছরই হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হন৷ ফলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৯৪০ সালে সে দেশের নাগরিকত্বও গ্রহণ করেন৷
ছবি: Imago/United Archives International
গেওর্গ ভাইডেনফেল্ড
ইহুদি এই মানুষটির জন্ম অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়, ১৯১৯ সালে৷ নাৎসিরা যখন অস্ট্রিয়া দখল করে নিলে তিনি লন্ডনে পাড়ি জমান৷ সেখানে তিনি একটি প্রকাশনা সংস্থা চালু করেন৷ ইসরায়েলের প্রথম প্রেসিডেন্টের ‘চিফ অফ স্টাফ’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/N.Bachmann
বেলা বার্টোক
হাঙ্গেরির কম্পোজার, পিয়ানোবাদক ও লোক সংগীত সংগ্রাহক বার্টোক ইহুদি ছিলেন না৷ কিন্তু নাৎসিদের হাতে ইহুদিদের নিপীড়িত হওয়ার বিষয়টির ঘোর সমালোচক ছিলেন তিনি৷ ফলে ১৯৪০ সালে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে হয়৷
ছবি: Getty Images
ইসাবেল আলেন্দে
১৯৭৩ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চিলির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সালভেদর আলেন্দেকে হটিয়ে দেয়া হয় এবং সেই সময়ই তাঁর মৃত্যু হয়৷ এরপর একসময় আলেন্দের এক কাজিনের মেয়ে ইসাবেলকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়৷ তা থেকে বাঁচতে প্রথমে ভেনেজুয়েলায়, তারপর যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান ইসাবেল৷ তাঁর লেখা কয়েকটি উপন্যাস আন্তর্জাতিকভাবে বেশ প্রশংসিত হয়েছে৷
ছবি: Koen van Weel/AFP/Getty Images
মিরিয়াম মাকেবা
‘মামা আফ্রিকা’ নামে পরিচিত দক্ষিণ আফ্রিকার সংগীত শিল্পী মাকেবা একবার গান গাইতে যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলেন৷ সেই সময় দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার বর্ণবাদবিরোধিতার অভিযোগে তাঁর পাসপোর্ট বাতিল করে দেয়৷ ফলে তিনি আর দেশে ফিরতে পারেননি৷ কয়েক দশক পর অবস্থার পরিবর্তন হলে দেশে ফিরে যান মাকেবা৷
ছবি: Getty Images
8 ছবি1 | 8
হাদ্দাদ আয়োজিত ৪০টি কনসার্টের প্রথমগুলো ছিল বুড়োদের জন্য এবং শরণার্থীদের জন্য৷ এগুলোতে ছিল নানান সংস্কৃতির সঙ্গীতের মিশেল৷ তিনি শিশুদের জন্য বাসে কনসার্ট করেছেন৷
‘‘শিশুরা কখনো এই কনসার্ট ভুলতে পারবে না৷ আমার খুশি ছিলাম, তাদের আনন্দে,'' বলেন হাদ্দাদ৷
হাদ্দাদের বেশিরভাগ ইভেন্টই স্বেচ্ছাসেবা৷ তিনি বন ইনস্টিটিউট ফর মাইগ্রেশন রিসার্চ অ্যান্ড ইন্টারকালচারাল লার্নিং নামের একটি সংস্থার বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন৷
বাগদাদে একটি কুর্দিশপরিবারে আরব ও ভারতীয় বংশোদ্ভুত বাবামায়ের ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন হাদ্দাদ৷ ইরাকে বিরুদ্ধ পক্ষকে সমর্থন করায় তার বাবাকে গ্রেফতার করে সাদ্দাম হোসেনের সরকার৷ নির্যাতিত হয়ে পরে জার্মানিতে চিকিৎসার জন্য আসেন তিনি৷ সে সূত্রেই হাদ্দাদ ও তার পরিবারের বাকি সদস্যরা জার্মানি আসেন৷