ইসরায়েলের উপর হামাসের সন্ত্রাসী হামলা ও তারপর গাজায় ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলার খবর জার্মানির স্কুল শিক্ষার্থীরা দেখেছে৷ শিক্ষকরা একটি বিষয় স্পষ্ট করার উপায় খুঁজছেন৷ সেটি হচ্ছে, ইহুদিবিদ্বেষ সহ্য করা হবে না৷
বিজ্ঞাপন
বার্লিনের রাস্তায় ফিলিস্তিনপন্থি মিছিলের সময় কয়েকজনকে ইসরায়েলের সাধারণ নাগরিকদের উপর সন্ত্রাসী হামলা হওয়ায় আনন্দ প্রকাশ করতে দেখা গেছে৷ এই ঘটনায় দ্রুত ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জার্মানির রাজনীতিবিদেরা৷ জার্মানিতে সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেওয়া বা ঘৃণা উসকে দেওয়া বেআইনি৷ ইহুদিবিদ্বেষের অভিব্যক্তিসহ বর্ণবাদী শ্লোগান দেওয়া ফৌজদারি আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷
ইসরায়েল-হামাস সংঘাত নিয়ে বার্লিনের স্কুলগুলোতে যে উত্তেজনা বাড়ছে তাতে অবাক নন ‘ক্রয়েৎসব্যার্গ ইনিশিয়েটিভ অ্যাগেইনস্ট অ্যান্টিসেমিটিজমের' ডার্ভিস হিজার্সি৷ তিনি বলেন, ইহুদিবিদ্বেষসহ সবধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ার মূল চাবিকাঠি হচ্ছে প্রতিরোধ৷ ‘‘যারা ‘শান্তিপূর্ণ সময়ে' মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত বা ইসরায়েল সংক্রান্ত ইহুদিবিদ্বেষের মতো বিষয়গুলো নিয়ে ভাবে না, তারা সংকটের সময় এমন সংঘাতের ব্যাপারে ঠিকমতো প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে না,'' বলে মনে করেন তিনি৷
হিজার্সি বলেন, ইসরায়েলে সন্ত্রাসী হামলা এবং তারপর গাজায় প্রতিশোধমূলক হামলার পর তার ও তার দলের কাছে অনেকে প্রশ্ন করছেন, পরামর্শ চাইছেন৷ যেমন ‘কেউ বলছেন এক মিনিট নীরবতা পালন করা উচিত কিনা, ইহুদি স্কুল থেকে অতিথি শিক্ষকদের আমন্ত্রণ জানানো উচিত কিনা ইত্যাদি'৷
ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে লড়াই করা সাবেক শিক্ষক হিজার্সি বলেন, সবকিছুর জন্য একক কোনো উত্তর নেই৷ তবে তার পরামর্শ: ‘শান্ত থাকুন, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করুণ এবং শিক্ষাগতভাবে যেটা যুক্তিসঙ্গত মনে হয় সেভাবে আবেগকে ব্যবহার করুন'৷
জার্মানিতে ইহুদি উপাসনালয়ে যত হামলা
জার্মানির হালে শহরে বুধবার ইহুদিদের একটি উপাসনালয়ে হামলার চেষ্টা হয়েছে৷ তবে সিনাগগে ঢুকতে না পেরে দুইজন পথচারীকে হত্যা করেন এক জার্মান আততায়ী৷ ছবিঘরে কয়েকটি সিনাগগে হামলার ঘটনা তুলে ধরা হলো৷
ছবি: Imago Images/S. Schellhorn
কোলন, ১৯৫৯: স্বস্তিকা ও হেট স্পিচ
১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে ‘ডয়চে রাইশপার্টাই’ নামের একটি চরম ডানপন্থি দলের সদস্যরা কোলনের সিনাগগে স্বস্তিকা এঁকে দিয়েছিল৷ এছাড়া ‘জার্মানদের দাবি: ইহুদিরা চলে যাও’ শব্দগুলোও লিখে দেয় তারা৷ এরপর জার্মানির বিভিন্ন এলাকায়ও ইহুদিবিরোধী গ্রাফিতির দেখা পাওয়া গিয়েছিল৷ ঐ ঘটনায় জড়িতদের ধরা হয়েছিল এবং ভবিষ্যতে কেউ যেন ‘মানুষের উসকানিমূলক’ কিছু করতে না পারে সেজন্য সংসদে আইন পাস হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/Arco Images/Joko
ল্যুবেক, ১৯৯৪: অগ্নিসংযোগ
মার্চ মাসের এই ঘটনা সারা বিশ্বের মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল৷ চরম ডানপন্থি চার ব্যক্তি ল্যুবেকের সিনাগগে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল৷ এই ঘটনার এক বছর পর আবারও একই সিনাগগে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Büttner
এসেন, ২০০০: পাথর ছোড়া
লেবানন থেকে আসা ১০০-র বেশি ফিলিস্তিনি ২০০০ সালের অক্টোবরে এসেন শহরের পুরনো সিনাগগে পাথর ছুড়ে মেরেছিল৷ ‘মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত’-এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শেষে এই হামলা করা হয়৷ এই ঘটনায় একজন পুলিশ আহত হয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/B. Boensch
ড্যুসেলডর্ফ, ২০০০: অগ্নিসংযোগ ও পাথর নিক্ষেপ
ইহুদি ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধ’ নিতে ১৯ বছর বয়সি এক ফিলিস্তিন ও ২০ বছর বয়সি মরক্কোর এক নাগরিক আগুন ও পাথর দিয়ে ড্যুসেলডর্ফের নতুন সিনাগগে হামলা করেছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Weihrauch
মাইনৎস, ২০১০: মলটফ ককটেল হামলা
১৯৩৮ সালে নাৎসি বাহিনী মাইনৎসের একটি সিনাগগ পুড়িয়ে দিয়েছিল৷ সেখানে নতুন করে একটি সিনাগগ নির্মাণ করা হয়৷ তবে উদ্বোধনের কিছুক্ষণ পরই সেখানে মলটফ ককটেল হামলা চালানো হয়৷
ছবি: picture-alliance/akg/Bildarchiv Steffens
ভুপার্টাল, ২০১৪: অগ্নিসংযোগ
ফিলিস্তিনি তিন তরুণ ২০১৪ সালের জুলাই মাসে ভুপার্টালের সিনাগগের প্রবেশ দরজায় দাহ্য পদার্থ ছুড়ে মেরেছিল৷ তবে এই ঘটনায় ইহুদিবিদ্বেষের পক্ষে ‘প্রমাণ পাওয়া যায়নি’ বলে আদালত রায় দিয়েছিলেন৷ জার্মানির ইহুদি ও বিদেশি গণমাধ্যম এই রায়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Seidel
বার্লিন, ২০১৯: ছুরি নিয়ে হামলা
অক্টোবরের ৪ তারিখ শাবাতের পূর্বে বার্লিনের নতুন সিনাগগে স্থাপন করা একটি বেড়ায় ছুড়ি নিয়ে উঠে পড়েছিলেন এক ব্যক্তি৷ নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে ধরে ফেলেন৷ পরে ছেড়েও দেন৷ ইহুদি নেতারা পুলিশের এই সিদ্ধান্তকে বিচারব্যবস্থার ‘ব্যর্থতা’ বলে উল্লেখ করেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Avers
হালে, ২০১৯: গুলি
ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের জন্য বছরের সবচেয়ে পবিত্র দিন ‘ইয়ম কিপুর’ উপলক্ষ্যে ৯ অক্টোবর সিনাগগে উপস্থিত হয়েছিলেন ৭০-৮০ জন মানুষ৷ অস্ত্র নিয়ে সেই সিনাগগে ঢোকার চেষ্টা করেছিল ২৭ বছর বয়সি জার্মান আতাতয়ী৷ তবে নিরাপত্তারক্ষীদের বাধার মুখে সিনাগগে ঢুকতে না পেরে রেগে গিয়ে গুলি করে দুইজন পথচারীকে হত্যা করেন তিনি৷ জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হর্স্ট সেহোফার জানিয়েছেন, ইহুদি-বিদ্বেষের কারণেই তিনি হামলা চালিয়েছেন৷
ছবি: Imago Images/S. Schellhorn
8 ছবি1 | 8
হিজার্সির সংগঠন এখন শিক্ষক ও সমাজকর্মীদের জন্য পরামর্শ সেবা শুরু করেছেন৷ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ৪০ জনের বেশি আবেদন করেছেন৷ এই সংখ্যা প্রমাণ করছে বার্লিনের স্কুলগুলোতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, বলেন তিনি৷
জার্মানির চিত্র
ইহুদিবিদ্বেষ শুধু বার্লিনের স্কুলগুলোর জন্য সমস্যা নয়, গত মে মাসে সাক্সোনি রাজ্যের এক স্কুলের দুই শিক্ষার্থী আউশভিৎস কনসেনট্রেশন ক্যাম্প সফরের সময় হিটলার স্যালুট প্রদর্শন করেছিল৷
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, জার্মানির সব রাজনৈতিক শিবিরে ইহুদিবিদ্বেষ আছে৷
২০২২ সালে অ্যামেরিকান জিউয়িশ কমিটি এজিসির করা এক গবেষণা বলছে, জার্মানির মূলধারার সমাজে ইহুদিবিদ্বেষ ‘গভীরভাবে গেঁথে' রয়েছে৷
প্রোফেশনাল এসোসিয়েশন অফ জার্মান সাইকোলজিস্ট সংগঠনের ক্লাউস জাইফ্রিড ডয়চে ভেলেকে জানান, বার্লিনে মুসলিম পরিবার থেকে আসা বেশিরভাগ শিশু ও তরুণ জার্মান সমাজে ভালোভাবে মিশে গেছে৷ অনেক গবেষণা দেখা গেছে, ইহুদিবিদ্বেষ সাধারণত সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের তুলনায় অভিবাসনের ইতিহাস থাকা মানুষ ও মুসলমানদের মধ্যে বেশি বিস্তৃত নয়৷
তবে ইসরায়েল সংক্রান্ত ইহুদিবিদ্বেষের ক্ষেত্রে মুসলমান ও অভিবাসনের ইতিহাস থাকা মানুষদের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষী মনোভাব প্রকাশের সংখ্যা বেশি৷ ২০২০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, জরিপে অংশ নেয়া ৪০.৫ শতাংশ মুসলমান (জার্মান নাগরিক এবং নাগরিক নন এমন মানুষও) ইসরায়েলকে নিয়ে করা ইহুদিবিদ্বেষমূলক বিবৃতির পক্ষে একমত প্রকাশ করেছেন৷ আর ৫.২ শতাংশ প্রোট্যাস্ট্যান্ট, ৭.১ শতাংশ ক্যাথলিক ও কোনো ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকা ৯.৪ শতাংশ মানুষ পক্ষে ছিলেন৷
স্কুলে ওয়ার্কশপ
‘গেজিস্ট সাইগেন' (আপনার মুখ দেখান) নামের একটি সংগঠন সহনশীলতার প্রতি জার্মান তরুণদের সংবেদনশীল করার কাজ করে৷ ইয়ান ক্রেবস ১৩ বছর ধরে সেখানে কাজ করছেন৷ জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করেন তারা৷
আলোচনায় তরুণদের সম্পৃক্ত করতে তারা অনেকসময় অপ্রত্যাশিত ও অদ্ভুত প্রশ্ন করে থাকেন৷ যেমন ‘‘নব্য-নাৎসিরা কি ড্যোনার কাবাব খায়?'' এতে কাজ হয় বলে জানান ক্রেবস৷
অভিভাবকদেরও প্রয়োজন
ক্লাউস জাইফ্রিড মনে করেন, শুধু স্কুলের পক্ষে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়৷ অভিভাবকদেরও প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি৷ ক্লাউস বলেন, সবার কাছে পৌঁছা সম্ভব নয়, কিন্তু অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করা স্কুলগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ৷
পুলিশও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বলে তাদের এক মুখপাত্র ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন৷
এক ছাদের নীচে মসজিদ, গির্জা আর সিনাগগ!
জার্মানির বার্লিনে এমনই এক উপাসনালয় তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ নাম – ‘হাউজ অফ ওয়ান’৷ আর এ জন্য ‘ক্রাউডফান্ডিং’-এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের কাজ চলছে৷
ছবি: Lia Darjes
এক ছাদের নীচে
জার্মানির বার্লিনে এমন একটি ভবন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হয়েছে যেখানে এক ছাদের নীচে ইসলাম, খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের প্রার্থনার জন্য আলাদা অংশ বরাদ্দ থাকবে৷ ‘হাউজ অফ ওয়ান’ নামের এই ভবনে থাকবে অন্য আরেকটি অংশ, যেখানে তিন ধর্মের অনুসারীরা একসঙ্গে মিলিত হয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে পারবেন৷
ছবি: KuehnMalvezzi
তিন উদ্যোক্তা
প্রোটেস্ট্যান্ট যাজক গ্রেগর হোব্যার্গ, রাব্বি টোফিয়া বেন-চোরিন ও ইমাম কাদির সানচির যৌথ উদ্যোগে পরিকল্পনাটি গ্রহণ করা হয়েছে৷ এ প্রসঙ্গে সানচি বলেন, ‘‘তিন ধর্মের চলার পথ আলাদা হলেও লক্ষ্য একই৷’’ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিন ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলা এর অন্যতম একটি উদ্দেশ্য৷
ছবি: Lia Darjes
গির্জার স্থানে
বার্লিনের যে স্থানে ভবনটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে সেখানে আগে ছিল একটি গির্জা৷ শীতল যুদ্ধের সময় সেটি ধ্বংস হয়ে যায়৷ তারপর থেকে জায়গাটি খালি পড়ে আছে৷
ছবি: Michel Koczy
শুরুতে মুসলিমদের আগ্রহ ছিল না
প্রকল্পের শুরুতে কোনো মুসলিম সম্প্রদায় এর সঙ্গে জড়িত হতে আগ্রহী ছিল না৷ পরে ‘ফোরাম ফর ইনটেলেকচুয়াল ডায়ালগ’ নামের তুর্কিভাষী সুন্নি মুসলিমদের একটি সংগঠন এর সঙ্গে যুক্ত হয়৷
ছবি: KuehnMalvezzi
খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের সমালোচনা
জার্মানির ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের নেতা মার্টিন মোসেবাখ বলেন, ভবনটির নকশায় ‘পবিত্র’ বিষয়টি নেই৷ নকশাটি দেখে ‘ফারাউনের কবর’-এর মতো আকারহীন মনে হয়৷ ইহুদিদের একটি অংশও এই পরিকল্পনার সমালোচনা করেছে বলে জানা যায়৷
ছবি: Lia Darjes
তহবিল সংগ্রহ
ভবনটি তৈরি করতে ৪৩ মিলিয়ন ইউরো প্রয়োজন৷ ক্রাউডফান্ডিং-এর মাধ্যমে সেই টাকা তোলার প্রক্রিয়া চলছে৷