এদেশে প্রতিটি বড় প্রতিষ্ঠানে ‘শ্রমিক পরিষদ' থাকে৷ সেই পরিষদ ও শেয়ারহোল্ডাররা প্রতিষ্ঠানের নীতি ‘সহ-নির্ধারণ' করতে পারেন, যার ফলে শিল্পক্ষেত্রে শান্তি বিরাজ করে, যা কিনা একটি দেশের আর্থ-সামাজিক সাফল্যের পূর্বশর্ত৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে শ্রমিক ধর্মঘট হয় বৈকি৷ খুবই ব্যাপকভাবে হয়৷ তবে ঘন ঘন নয়৷ এখানে শ্রমিক ধর্মঘট মানে মালিকপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করার একটি পন্থা৷ অপরদিকে শ্রমিক-মালিক দু'পক্ষই জানে যে, বিরোধটাকে সংঘাত হয়ে উঠতে দেওয়া চলবে না৷ তাই ধর্মঘট চলাকালীন দু'পক্ষের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কথাবার্তা চলে, দরকার হলে নামকরা মধ্যস্থতাকারীদের ডেকে আপোশের ব্যবস্থা করা হয়৷ মূল কথা হলো, দু'তরফেই এবং গোড়া থেকেই আপোশের প্রস্তুতি থাকে৷
প্রক্রিয়াটা চলে এইভাবে: প্রথমে আসে শ্রমিকপক্ষের দাবি ও মালিকপক্ষের মনোভাব৷ প্রাথমিক পরিস্থিতি হয় এই যে, যে কোনো শিল্পে শ্রমিকপক্ষ ও মালিকপক্ষের মধ্যে বেতনবৃদ্ধি ও অন্যান্য দাবি-দাওয়া নিয়ে দুই থেকে তিন বছরের জন্য একটি চুক্তি করা হয়৷ সেই চুক্তির মেয়াদ যখন শেষ হতে চলেছে, তখন আবার শ্রমিকপক্ষ, অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট শ্রমিক সংগঠন ও মালিকপক্ষের মধ্যে চুক্তির পরবর্তী মেয়াদ নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয় এবং স্বভাবতই নতুন দাবিদাওয়া উত্থাপিত হয়৷ এই পর্যায়ে সাময়িক বা স্বল্পমেয়াদি, এমনকি দীর্ঘমেয়াদি ধর্মঘট শ্রমিকপক্ষের হাতে অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে৷
ঐতিহাসিক কয়েকটি শ্রম আন্দোলন
মে দিবসের চেতনা শ্রমিকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে ১৮৯০ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মে দিবস পালনের সূচনা হয়৷ ছবিঘরে দেখে নিন বিশ্বের অন্যতম কয়েকটি শ্রম আন্দোলনের কথা৷
ছবি: picture alliance / Tass/dpa
হে মার্কেটের শ্রমিকদের আন্দোলন
১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা নেমেছিলেন তুমুল আন্দোলনে৷ তাঁদের দাবি ছিল, উপযুক্ত মজুরি এবং দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ নয়৷ মে মাসের প্রথম দিনেই শ্রমিকরা ধর্মঘটের আহ্বান জানায়৷ প্রায় তিন লাখ শ্রমিক যোগ দেয় সেই সমাবেশে৷ বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের রুখতে মিছিলে পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি চালায়৷ বহু শ্রমিক হতাহত হন৷
ছবি: picture-alliance/KPA/TopFoto
মে দিবস
পরে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় গ্রেপ্তারকৃত ছয় শ্রমিককে৷ কারাগারে বন্দিদশায় এক শ্রমিক নেতা আত্মহত্যাও করেন৷ পরের বছর প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে দিনটিকে মে দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস
বর্তমানে মে মাসের প্রথম দিনটিকে পুরো পৃথিবীতে পালন করা হয় ‘মে দিবস’ হিসেবে৷ পৃথিবীর সব শ্রমিকের লড়াই-সংগ্রাম-পরিশ্রমের প্রতি সম্মান জানানো হয় এই দিনে, শ্রদ্ধা জানানো হয় তাঁদের আত্মত্যাগের পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশ্যে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. U. Zaman
শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন
অ্যামেরিকা স্বাধীন হওয়ার আগে শ্রমজীবী মানুষের প্রথম সংগঠন গড়ে ওঠে ১৬৮৪ সালে৷ ঠেলাগাড়ির চালকরা প্রথম ঠেলা শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তোলেন৷ ১৮৪২ সালে অ্যামেরিকায় শ্রমিক শ্রেণি ট্রেড ইউনিয়ন ধর্মঘট করার অধিকার পায়৷ বিশ্বের প্রথম নারী শ্রমিকদের ধর্মঘট পালিত হয় অ্যামেরিকায় ১৮২৩ সালে৷ বিশ্বের শিল্প-কারখানাগুলোয় শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয় ১৮২৮ সালে৷
ছবি: M. Cardy/Getty Images
আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সংগঠন
ঊনবিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমিক শ্রেণি নিজ নিজ দেশে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলে৷ ১৮৬৪ সালে মার্কস- এঙ্গেলসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি৷ ইতিহাসে এটাই প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সংগঠন নামে খ্যাত৷
ছবি: AP
প্যারিস কমিউন
১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ প্যারিসের শ্রমিকরা শহর থেকে বুর্জোয়া শাসকদের হটিয়ে নিজেদের হাতে ক্ষমতা নিয়ে নেয়৷ দশ দিন পরে ২৮ মার্চ তারিখে শ্রমিকরা গঠন করেছিল পৃথিবীর প্রথম প্রলেতারিয়েত রাষ্ট্র প্যারিস কমিউন৷
অক্টোবর বিপ্লব
অক্টোবর বিপ্লবকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত অঞ্চলগুলোয় বলা হয় ‘মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’৷ ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ায় বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করে, শুরু হয় ‘লাল’ আর ‘সাদা’-দের মধ্যে গৃহযুদ্ধ৷ অক্টোবর বিপ্লবের বিজয় রাশিয়াকে রাজনৈতিকভাবে একটি অগ্রসর রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পুঁজিবাদী দাসত্ব থেকে মুক্তি
এই বিপ্লব জনগণকে পুঁজিবাদী দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছিল৷ এই বিপ্লব শ্রমিক শ্রেণি ও মেহনতি কৃষকের জন্য শুধু সামাজিক মুক্তিই আনেনি, রাশিয়ার গণতান্ত্রিক সমস্যাগুলোও সমাধান করতে সক্ষম হয়েছিল৷ লেনিন স্বয়ং ১৯২৪ সালে পরলোকগমন করেন, কিন্তু রুশ বিপ্লব, সোভিয়েত রাশিয়া বা কমিউনিজম, এ সবের সঙ্গে তাঁর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷
ছবি: picture-alliance/akg
তেভাগা আন্দোলন
১৯৩০ সালে বাংলার কয়েকটি জেলায় কৃষকরা তেভাগার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন৷ তেভাগা আন্দোলনের মূল দাবি ছিল, ভাগচাষিকে ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ দিতে হবে৷ এই আন্দোলনটি ছিল সম্পূর্ণ বর্ণ হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমান ও নমঃশূদ্র চাষিদের অসহযোগ আন্দোলন৷ এ আন্দোলনে জমিদারদের পাইক-বরকন্দাজদের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করতে হয়েছিল কৃষকদের৷ ১৯৪৬ সালেও আর এক দফা আন্দোলন হয়েছিল৷
ছবি: AFP/Getty Images/R. Gacad
দক্ষিণ আফ্রিকা
দক্ষিণ আফ্রিকার খনি শ্রমিকদের ওপর নানা নির্যাতন, মজুরি বৃদ্ধি, থাকা-খাওয়া ও জীবনমান উন্নয়ন ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং ১৯৪৬ সালে ৭০ হাজার শ্রমিকের অংশগ্রহণে ধর্মঘট পালিত হয় কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে৷ এএনসি এই আন্দোলনে যোগদানের বিষয়ে নীরব থাকলেও ম্যান্ডেলা পরিচিত কয়েকজনকে নিয়ে কমিউনিস্ট নেতা জেবি মার্কসের সঙ্গে দেখা করে এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন৷
ছবি: dapd
জার্মানির শ্রমিক আন্দোলন
১৯৫৩ সালের ১৭ জুন তৎকালীন পূর্ব জার্মানির সরকারের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল শ্রমিকসহ সাধারণ জনগণ৷ বড় কোম্পানিগুলো জাতীয়করণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পূর্ব জার্মান সরকার, যার প্রতিবাদে ১৬ জুন থেকে আন্দোলন শুরু করেছিল কয়েকশ’ শ্রমিক৷ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ৭০০ শহরে৷ ১৭ জুন আন্দোলন থেকে সরকারের পদত্যাগ, স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠান ও দুই জার্মানির একত্রীকরণের দাবি ওঠে৷ সেনাদের গুলিতে নিহত হয় ৫০ জন৷
ছবি: Getty Images
শ্রমিক বিক্ষোভে উত্তাল ইউরোপ
স্পেন ও পর্তুগালে ২০১২ সালের ১৪ নভেম্বর বুধবার পালিত হয়েছিল সাধারণ ধর্মঘট৷ কর্মবিরতি পালন করেছিলেন গ্রিস ও ইটালির শ্রমিকরা৷ এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানায় বেলজিয়াম, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ডসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো৷ এতে বিভিন্ন দেশের শিল্প-কারখানা অচল হয়ে পড়ে৷ বাতিল হয় ইউরোপের অনেক ফ্লাইট৷ চার দেশে একযোগে ধর্মঘট পালনের ঘটনা ইউরোপে এটিই প্রথম৷
ছবি: Reuters
ফ্রান্সে শ্রমিক আন্দোলন ২০১৬
একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ফ্রান্সে সর্ববৃহৎ শ্রমিক বিদ্রোহ দেখা গিয়েছে ২০১৬ সালে৷ শ্রম আইন সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে অসন্তোষের জের ধরে জেনারেল কনফেডারেশন অব লেবার (সিজিটি) ইউনিয়নের ডাকে ধর্মঘটে ফ্রান্সের প্রায় সব বিভাগের শ্রমিকরাই অংশ নিয়েছিলেন৷ এ ধর্মঘটের একপর্যায়ে প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিক রাস্তায় নেমে আসেন৷ তাদের সঙ্গে শামিল হয় ছাত্র ও তরুণরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘট
হয়েছিল ১৯৮২ সালের ১৯শে জানুয়ারি সেই ধর্মঘট ছিল বৃহৎ, ঐতিহাসিক এবং সবদিক দিয়ে সফল৷ পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরালায় সর্বাত্মক বন্ধ পালিত হয়েছিল৷
ছবি: Reuters/D. Siddiqui
ভারতে শ্রমিক বিক্ষোভ
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ন্যূনতম মাসিক মজুরি ১৮ হাজার রুপি করা এবং শিল্প-কারখানার বেসরকারিকরণ ঠেকানোসহ ১৪ দফা দাবিতে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতজুড়ে সাধারণ ধর্মঘট পালন করেন সেবা খাতের লাখ লাখ শ্রমিক৷ ১৫ কোটির বেশি শ্রমিক এ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন বলে সংগঠনগুলোর দাবি৷
ছবি: AP
15 ছবি1 | 15
মনে রাখতে হবে, অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্রের মতো ধর্মঘটেরও খরচ আছে – যেমন ধর্মঘটীদের বেতন, শ্রমিক সংগঠন যা তাঁদের নিজেদের ‘ধর্মঘট তহবিল' থেকে বহণ করে৷ অপরদিকে কারখানা বন্ধ হলে মালিকপক্ষের লোকসান ছাড়া লাভ নেই, কাজেই কোনোপক্ষই বেশিদিন ধর্মঘট চালিয়ে যেতে আগ্রহী নয়৷ বাকি থাকলো সরকার আর ধর্মঘটের ভুক্তভোগী সাধারণ জনতা: তাঁদের কী কর্তব্য?
আপাতত জার্মানির সরকারি কর্মচারীরা বিভিন্ন শহরে, বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন সেবায় সীমিত মেয়াদের হুমকিমূলক ধর্মঘট করে তাঁদের ছয় শতাংশ বেতনবৃদ্ধির দাবিকে জানান দিচ্ছেন, কেননা সরকার, অর্থাৎ মালিকপক্ষ, দুই শতাংশের ওপরে উঠতে রাজি নন৷ ওদিকে শ্রমিক সংগঠন পেশ করেছে ছয় শতাংশ অথবা ন্যূনতম ২০০ ইউরো বেতনবৃদ্ধির দাবি৷ এসব ধর্মঘট কিন্তু ‘ওয়াইল্ডক্যাট' বা বুনোবেড়াল ধর্মঘট নয়, যে না-জানিয়ে না-শুনিয়ে ঘটবে৷ রীতিমতো নোটিশ দিয়ে ধর্মঘট৷ যদিও তাতে সাধারণ মানুষদের ভোগান্তি কিছু কম হয় না৷ অফিস যাবার সময় বাস বা লোকাল ট্রেন চলবে না জানা থাকলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যায়?
মজার কথা হলো এই যে, শ্রমিক-মালিক বিরোধে সরকারের নাক গলানোর উপায় নেই৷ যেমন, শ্রমিকদের রাজনৈতিক ধর্মঘট করার অধিকার নেই৷
মোদ্দা কথা, শ্রমিক পরিষদ ও সহনির্ধারণ নীতির মাধ্যমে কোম্পানির পরিচালনায় শ্রমিকপক্ষের ব্যাপক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে৷ জার্মানিতে কোম্পানিগুলির আবার একটি নয়, দু'টি করে ‘বোর্ড অফ ডাইরেক্টর্স' বা পরিচালকমণ্ডলী থাকে: তাদের একটি হলো তত্ত্বাবধায়ক, অন্যটি কার্যনির্বাহী৷ তত্ত্বাবধায়ক বোর্ডের অর্ধেকের কিছু কম সদস্য হন শ্রমিক প্রতিনিধি৷ ম্যানেজমেন্ট বা কার্যনির্বাহী বোর্ডেও একজন ‘শ্রম পরিচালক' নামের শ্রমিক প্রতিনিধি থাকেন৷
নাম সহনির্ধারণ হলেও, জার্মানিতে শিল্পক্ষেত্রে যে বস্তুটি কাজ করছে, তাকে স্বচ্ছন্দে সহযোগিতা বা সহযোগিতার সংস্কৃতি বলা চলে৷ যেমন, জার্মানিতে মালিকপক্ষ যে দক্ষ শ্রমিকদের কাছ থেকে কর্মপদ্ধতি বা উৎপাদন বাড়ানো সংক্রান্ত প্রস্তাব ও শলাপরামর্শ চেয়ে থাকেন, সেটা শুধু আইন করা আছে বলে নয়৷ এখানে মালিকপক্ষ জানেন যে, প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের জন্য শ্রমিকদের অবদান অপরিহার্য; অপরদিকে শ্রমিকরাও সব ধরনের কাঠামোগত সংস্কারের প্রস্তাবে বেঁকে বসেন না – এমনকি তাতে কিছু চাকরি ছাঁটাই হলেও নয়৷ দু'পক্ষেরই এই বাস্তববুদ্ধি আছে বলেই বারংবার কোনো না কোনো ধরনের ঐকমত্যে আসা সম্ভব হয়৷
যারা রেল বা বিমান চালান
বিষয়টি আলাদা করে উল্লেখ করার কারণ হলো, জিডিএল নামধারী ইঞ্জিন ড্রাইভারদের শ্রমিক সংগঠন ও সেই সঙ্গে ‘ককপিট' নামের বিমানচালক বা পাইলটদের শ্রমিক সংগঠন৷ জানি না কবে, সম্ভবত ২০১৪ সালের আশেপাশে, এই দু'টি বিশেষ পেশার কর্মীরা একের পর এক ধর্মঘট করে মালিকপক্ষ, সাধারণ মানুষ, এমনকি খোদ ফেডারাল সরকারকেও নাজেহাল করে তোলেন৷ বিপদে পড়ে একদিকে ‘ডয়চে বান' বা জার্মান রেল, অন্যদিকে লুফৎহানসার মতো সুবৃহৎ পরিবহণ সংস্থা৷
মনে আছে, ২০১৫ সালে লন্ডনের ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকা একটি প্রতিবেদনে লিখেছিল, ‘‘ব্রিটেনে শ্রমিক আন্দোলন, ফরাসি একগুঁয়েমি, গ্রিক আলসেমো আর ইটালিয়ান ডামাডোলের বিক্ষুব্ধ ইউরোপীয় সাগরে জার্মানিকে ঐকমত্যভিত্তিক, জনকল্যাণমুখী শ্রম সম্পর্কের অটল শিলা হিসেবে দেখানোটা বোধহয় আর ঠিক নয়৷''
জার্মান রেলে রেলচালকদের সংখ্যা যেমন অন্যান্য শ্রমিক-কর্মচারীদের তুলনায় নগণ্য, তেমনি লুফৎহানসার শ্রমিক-কর্মচারী মহলেও বিমানচালকদের সংখ্যা নগণ্য৷ কিন্তু তাঁদের গুরুত্ব কম নয়৷ ২০১০ সালে ফেডারাল শ্রম আদালত একটি ঐতিহাসিক রায়ে এ ধরনের বিশেষ পেশার শ্রমিকদের তাঁদের নিজস্ব শ্রমিক সংগঠন গঠন ও পরিচালনার অধিকার মেনে নেওয়ার পর, এই ছোট শ্রমিক সংগঠনগুলিরও বড় শ্রমিক সংগঠনগুলির মতো মালিকপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও দরকষাকষির মাধ্যমে নিজেদের সদস্যদের জন্য পৃথক শ্রম চুক্তি করার পথে আর কোনো বাধা থাকে না৷ ২০১৫ সালে ফেডারাল সরকার ‘একটি কোম্পানি, একটি ইউনিয়ন' আইন করার প্রচেষ্টা করে অসফল হয়৷ কাজেই যে বড় বড় শ্রমিক সংগঠন, সেইসব শ্রমিক সংগঠনের আরো বড় বড় সমিতি এবং মালিকপক্ষেও অনুরূপ বড় আকারের সমিতি থাকার ফলে জার্মানিতে বিভিন্ন শিল্পে চুক্তি করে শ্রমশান্তির ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছিল, ক্রমেই আরো বেশি বিশেষ স্বার্থের এই ছোটখাট শ্রমিকসংগঠনগুলি তা ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে৷
তাতেও বিশেষ কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না বলে আমার ধারণা৷ কেননা, একটি সমৃদ্ধ, শিল্পোন্নত দেশের প্রথম ও প্রধান লক্ষণ হলো আইনের শাসন৷ এদেশে শ্রমিক-মালিক-সমিতি-সংগঠন সকলেই চেষ্টা করে আইনের গণ্ডির মধ্যেই তাঁদের ঝগড়া-কাজিয়া-রেষারেষি মিটিয়ে ফেলতে৷ এই মনোভাবটা যতদিন থাকবে, সমাজ ও সমাজজীবনের অন্যান্য এলাকার মতো শ্রমক্ষেত্রেও তা কার্যকরি হবে৷
নিজেদের অধিকার সম্পর্কে শ্রমজীবী মানুষদের কথা
বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে খেটে খাওয়া মানুষরা পদে পদে বঞ্চিত হচ্ছেন শ্রম অধিকার থেকে৷ কয়েকটি ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকারসচেতনতা এবং এ প্রসঙ্গে তাঁদের মতামত জেনে নিন এই ছবিঘরে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
ঝর্ণা আক্তার, পোশাক শ্রমিক
শ্রম অধিকার বলতে আমার কাজের ন্যায্য পারিশ্রমিক পাওয়াকে বুঝি, কিন্তু সেটা আমি পাই না৷ মাসে বেতন পাই ছয় হাজার টাকা, ওভার টাইম নিয়ে সেটা নয় হাজার টাকার মতো হয়৷ এই টাকা দিয়ে বহু কষ্টে খেয়ে-পড়ে বেঁচে আছি৷ অনেক সময় বেতন বকেয়া রেখেই চাকরি থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মুকুলি বেগম, গৃহকর্মী
শ্রম অধিকার কী জিনিস তা বুঝি না৷ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে যাই৷ সপ্তাহে কোনো ছুটির দিন নেই৷ ছোটখাট অসুখ-বিসুখ হলেও কাজে যেতে হয়৷ এর বাইরে পদে পদে খারাপ ব্যবহার পেতে হয় বাড়ির মালিকের কাছ থেকে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মোহাম্মদ রিপন, নির্মাণ শ্রমিক
শ্রম অধিকার বুঝি না৷ দিন শেষে পারিশ্রমিক পেলেই খুশি৷ সপ্তাহে সাতদিনই কাজ করি৷ কাজ করলে টাকা পাই, না করলে পাই না৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মোহাম্মদ নূরুদ্দিন, দিনমজুর
শ্রম অধিকার বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই৷ সারাদিন খেটে ৩০০-৪০০ টাকা পাই৷ এ টাকা একটু বাড়লে ভালো৷ এই বাজারে এই টাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
রাশেদ, বাস চালক
শ্রম অধিকার নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই৷ দিনে ১৬ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাই৷ মালিকের টার্গেট পূরণ হওয়ার পর যা পাই, সেটা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
জসিম উদ্দীন, বাসের হেলপার
শ্রম অধিকার হলো কাজের সঠিক পারিশ্রমিক পাওয়া৷ সেটা আমি পাই না৷ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটানা কাজ করি৷ সপ্তাহে একদিনও ছুটি পাই না৷ বাড়ি গেলে কাজ ছেড়ে যেতে হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
আসাদুল, রিকশা-ভ্যান চালক
শ্রম অধিকার কী বুঝি না৷ কাজ করলে টাকা পাই, না করলে পাই না৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মোহাম্মদ রাজু, অটো রিকশা চালক
শ্রম অধিকার হলো আমার কাজের ন্যায্য পারিশ্রমিক পাওয়া৷ আমি সেটা পাই না৷ গাড়ির মালিকের জমা, পুলিশের অযথা হয়রানি, পথে পথে যাত্রীদের দুর্ব্যবহার – এ সব নিয়েই দিন চলে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
সোহেল হাওলাদার, রিকশা চালক
আমাদের আবার অধিকার কী? মানুষ আমাদের মানুষই মনে করে না৷ সবাই ভাড়া কম দিতে চায়৷ অনেক যাত্রীই খারাপ ব্যবহার করে, অনেকে গায়ে হাত তোলে৷ কিন্তু আমাদের কথা বলার কোনো জায়গা নেই৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বাবলু মিয়া, রং মিস্ত্রী
শ্রম অধিকার কী জিনিস বুঝি না৷ কাজ শেষে টাকা পেলেই খুশি৷ সেটা পাইও৷ তবে অনেক ঝুঁকি নিয়ে বড় বড় বিল্ডিংয়ে কাজ করি৷ কোনো রকম দুর্ঘটনা হলে কোথাও থেকে কোনো সাহায্য পাই না৷ কাজ না থাকলে না খেয়ে থাকতে হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
10 ছবি1 | 10
এমন পরিস্থিতি কি বাংলাদেশে বা পশ্চিমবঙ্গে তৈরি করা সম্ভব? মতামত দিন নীচের ঘরে৷