বাংলাদেশ ও ভারতে নদীর দূষণ এক বড় সমস্যা৷ নানা কারণে নদীর দূষিত পানি গোটা জনপদের জন্য বিপদ হয়ে উঠতে পারে৷ জার্মানিতে অনেক নদী সংস্কার করা সম্ভব হলেও আজও চ্যালেঞ্জের অভাব নেই৷
বিজ্ঞাপন
নদী সংস্কার প্রকল্প
04:00
যেন পটে আঁকা ছবি! জার্মানির সুবিখ্যাত রুয়র শিল্পাঞ্চলের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে এমশার নদী৷ কিন্তু বাইরের দেখাটাই তো সব নয়৷ দূষণের দৃষ্টিকোণ থেকে এমশার নদী একটি দুঃস্বপ্ন বলা চলতে পারে৷ পানিতে নামার উপায় নেই: রাসায়নিক আর বর্জ্য পদার্থে নদীর পানি এমনই দূষিত যে, পানিতে নামলে মারাত্মক রোগ হবার বিপদ রয়েছে৷
ভাগ্যক্রমে বহু বছর আগেই নিষ্কাশনের কাজ শুরু হয়েছে৷ তবুও নদীর পানিতে আজও দুর্গন্ধ৷ এমশার সমবায়ের মুখপাত্র মিশায়েল স্টাইনবাখ বলেন, ‘‘আমাদের লক্ষ্য হল, এমশার আবার এমন একটি নদী হয়ে উঠবে, যার পানিতে মাছ খেলে বেড়াবে, তীরে গাছগাছালি, জীবজন্তু থাকবে – এমন একটা নদী, যেখানে মানুষজন বেড়াতে যেতে পারবে, থাকতে পারবে৷ মুক্ত প্রকৃতির কোলে একটি নদী৷''
রাইনে প্রকৃতি মিশেছে শিল্পের সাথে
জার্মানির দক্ষিণ থেকে উত্তরে বয়ে চলেছে রাইন নদী৷ নদীটি শিল্পী এবং প্রকৃতিবিদদের বরাবরই উৎসাহ জুগিয়ে আসছে৷ ১৮ ও ১৯ শতকে নদীর অনুপ্রেরণায় তাই কেউ ছবি এঁকেছেন, কেউ লিখেছেন কবিতা, কেউ আবিষ্কার করেছেন নদীতীরবর্তী অপরূপ দৃশ্য৷
ছবি: Museum Wiesbaden
প্রকৃত চিত্র
১৯ শতকে রাইন জনপ্রিয় স্থানের মর্যাদা অর্জন করে৷ চিত্রশিল্পী, কবি এবং প্রকৃতিবিদদের অনুপ্রেরণার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এটি৷ দুর্গ, উপত্যকা আর পাহাড়ে ঘেরা দু’পারের নৈসর্গিক দৃশ্য৷ আন্টন ডিটৎসলার ১৮২০ থেকে ১৮৩০ সালের মাঝামাঝি ‘ভিউ অফ নাসাও’ নামে এই ছবিটি আঁকেন৷
ছবি: Museum Wiesbaden
ডাচ শিল্পীর মডেল
রাইনকে নিয়ে আগ্রহ শুরু হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে৷ অর্থ উপার্জনের জন্য ডাচ শিল্পীরা রাইন সফর করেন সে সময়৷ আমস্টারডামভিত্তিক প্রকৃতিবিদরা রাইনের আশেপাশের প্রকৃত চিত্র তুলে আনতে তাঁদের পাঠিয়েছিলেন৷ এঁদের মধ্যে একজন শিল্পী ছিলেন হ্যারমান সাফটলেভেন৷ তিনি রাইনের প্রকৃত চিত্রের ছবি এঁকেছিলেন৷
ছবি: Ed Restle/Museum Wiesbaden
ভ্রমণ গাইড
রাইনের মধ্যাঞ্চলটি সর্বপ্রথম পর্যটন আর্কষণের কেন্দ্র হয়ে ওঠে৷ অনেক অভিজাত ব্যক্তিরা ১৮ শতাব্দীতে এই নদীতে ভ্রমণ বা ‘ক্রুজ’ করেন৷ ব্যারন ইওহান আইজ্যাক এই স্থানটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন তাঁর ভ্রমণ প্রতিবেদনের মাধ্যমে৷ রিপোর্টে মাইনৎস থেকে কোলন ভ্রমণের বর্ণনা ছিল, যা পরবর্তীতে ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ হয়৷
ছবি: Museum Wiesbaden
সংস্কৃতির ঘটনাপঞ্জি
জলরঙের শিল্পী ক্রিস্টিয়ান গেয়র্গ শ্যুটৎস জুনিয়রের আঁকা ছবিগুলো ভ্রমণচিত্র হিসেবে বিখ্যাত৷ তিনি গ্যার্নিংস-এর ছবি এঁকেছিলেন৷ ১৮ শতকের প্রথমদিকে এই ছবিগুলো আঁকা৷ রাইনের তীরবর্তী প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং ভবনগুলোর প্রকৃত চিত্র ফুটিয়ে তোলায় জোর দেন তিনি৷ রাইনের ধারে একমাত্র দুর্গটি তাঁর কাজের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়৷
ছবি: Museum Wiesbaden
দেখার পরের দৃশ্য
ক্রিস্টিয়ান গেয়র্গ শ্যুটৎস সিনিয়রকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ডাচ শিল্পী সাফটলেভেনের স্টাইলের অনুকরণ করার৷ তাই ফ্রাংকফুর্টের এই চিত্রশিল্পী রাইনের রোম্যান্টিক চিত্র ফুটিয়ে তুললেন তাঁর ছবিতে৷ ল্যান্ডস্কেপগুলোতে উষ্ণ, ঘনিষ্ট এবং পার্থিবতা ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Museum Wiesbaden
এল্টভিল গ্রাম
রাইনগাও ওয়াইন এলাকায়, নদীর পাশেই এল্টভিল গ্রামের অবস্থান৷ ১৭৭৪ সালে ক্রিস্টিয়ান গেয়র্গ শ্যুটৎস সিনিয়র এই ছবিটি যখন এঁকেছিলেন, তখন স্থানটি বেশ জনপ্রিয় ছিল৷ যেসব অভিজাত ব্যক্তি ঐ এলাকাটি সফর করতেন তাঁরা জায়গাটির ছবি আঁকার দায়িত্ব দিতেন৷ তাই চাহিদা যত বাড়লো, পরিবারের বাকি সদস্যেরও কাজে লাগিয়ে দিলেন শ্যুটৎস৷
ছবি: Museum Wiesbaden
শিল্পীদের পরিবার
ফ্রাঞ্জ শ্যুটৎসও এমন একজন শিল্পী, যিনি রাইনের ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন৷ ‘স্ট্রুম উন্ড দ্রাং’ মুভমেন্টের প্রতিনিধিও ছিলেন তিনি, যিনি নিজের শিল্প সত্ত্বাকে কল্পনাবিলাসী পথে নিয়ে গেছেন৷ এই ছবিতে ঝড়ের পূর্বে রাইনের ছিত্র ফুটে উঠেছে৷ তাঁর কাজের অন্যতম অনুরাগী ছিলেন ইওহান ভল্ফগাং ফন গ্যোটে৷
ছবি: Museum Wiesbaden
বিলুপ্তি গ্রহণযোগ্য নয়
রাইন নদীকে শুধুমাত্র মানুষের প্রয়োজনে চওড়া করার ফলে এর জলে পরিবেশগত প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়৷ যেমন, ১৮৪০ সালে বিরল প্রজাতির একটি অতিব মাছ নদী থেকে তোলা হয়েছিল৷ এটা ছিল ১০ ফিট লম্বা এবং ৩০০ কেজি ওজনের৷ অথচ বর্তমানে, এমন বহু বিরল প্রজাতির প্রাণীরই বিলুপ্তি ঘটেছে রাইনে৷
ছবি: Museum Wiesbaden
ফনা উৎসব
স্বপ্নবাদী এবং চিন্তাবিদদের মনের খোরাক বরাবর জুগিয়েছে রাইন৷ বিঙ্গেন এবং কোবলেনৎস-এর মাঝামাঝি মধ্য রাইনের সুন্দর আবহাওয়াই এর জন্য দায়ী৷ এ কারণে মধ্য ইউরোপের সর্ববৃহৎ ‘বায়োডাইভার্সিটি’ এখানে অবস্থিত৷ অনেক বন এবং পাথুরে পাহাড় এখানকার প্রাণীদের রক্ষার জন্য খুবই উপযোগী৷
ছবি: Museum Wiesbaden
ভিসবাডেনের সংগ্রহ
ইওহান ভল্ফগাং গ্যোটের উপদেশ অনুযায়ী, ইওহান আইজ্যাক ফন গ্যার্নিং-এর পরিবার তাঁদের কাছে থাকা ঐ শিল্পীর চিত্রকলাসহ সংরক্ষিত নানা বস্তু দান করে৷ পরবর্তীতে ভিসবাডেন শহরে একটি জাদুঘর তৈরি হয়, যেখানে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাইনের ধারে পাওয়া নানা প্রাকৃতিক বস্তু এবং শিল্পকলা স্থান পেয়েছে৷
ছবি: Museum Wiesbaden
10 ছবি1 | 10
সংস্কারের প্রচেষ্টা
শক্তিশালী পাম্প দিয়ে নদীর পানি একটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে পাম্প করে, যান্ত্রিক ও জৈবিক পন্থায় সেই পানি পরিশোধন করা হচ্ছে৷ ফিল্টার প্রক্রিয়া শুরু হবার আগে পানি থেকে ঘন বর্জ্য পদার্থ বার করে নিয়ে তা প্ল্যান্টের নিজস্ব ইনসিনারেটরে পুড়িয়ে ফেলা হয়৷ এমশার সমবায়ের ইঞ্জিনিয়ার মানফ্রেড ব়্যুটার বলেন, ‘‘ময়লা পানি দু'টি ধাপে পরিশোধন করা হয়৷ প্রথমত যান্ত্রিক ভাবে, দ্বিতীয়ত জৈবিক পদ্ধতিতে৷ যান্ত্রিক উপায় বলতে প্রথমে ময়লা ইত্যাদি সরিয়ে ফেলা হয়৷ যান্ত্রিক পরিশোধনের দ্বিতীয় পর্যায়ে সরানো হয় বালি, পাথরকুচি ইত্যাদি; আর তৃতীয় পর্যায়ে সেডিমেন্টেশন করে পানির চেয়ে যা কিছু ভারি, তা তলা থেকে সরানো হয়৷''
বট্রপ শহরটি অতীতে ভারিশিল্পের জন্য খ্যাত ছিল৷ বট্রপের এই ময়লা পানি পরিশোধনের প্ল্যান্টটির বড় বড় চৌবাচ্চাগুলোতে দিনে সাত লাখ ঘনমিটার অবধি পানি পরিষ্কার করা হয়৷ খুবই জটিল একটি প্রক্রিয়া, যার উপর প্রতি পদে কম্পিউটার দিয়ে নজর রাখা হয়৷ এমশার সমবায়ের মার্কুস ক্রেমার বলেন, ‘‘প্ল্যান্টের কোথায় কী ঘটছে জানার জন্য আমরা এই মনিটরগুলো ব্যবহার করি৷ এছাড়া প্ল্যান্টের বিভিন্ন জায়গায় মাপার যন্ত্র বসানো থাকায় কোথাও কোনো গোলমাল ঘটলে আমরা তা জানতে পারি এবং এখান থেকে টেলিফোন করে কর্মীদের জানিয়ে দিতে পারি, যাতে তারা মেরামতি করতে পারে৷''
একটি চৌবাচ্চা থেকে আরেকটি চৌবাচ্চায় যাবার সময় প্রতিবার পানি পরিষ্কার করা হয়৷ চৌবাচ্চার নীচে যে ময়লা জমা হয়, সেটাকে চারটি বড় আধারে শুকিয়ে নিয়ে পরে পুড়িয়ে ফেলা হয়৷ ময়লা পোড়ানোর চুল্লির সঙ্গে যুক্ত একটি জেনারেটর থেকে আবার প্ল্যান্ট চালানোর ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে৷ মার্কুস ক্রেমার বলেন, ‘‘শেষমেষ শুধু এই শুদ্ধ পানি পড়ে থাকে, যা পুকুর বা নদীর পানির মতো স্নান করার উপযুক্ত৷ সেই পরিশুদ্ধ পানি গিয়ে পড়ে এমশার নদীতে৷''
প্রকল্পের অর্থায়ন
গোটা প্রকল্পটিতে খরচ পড়বে ৪৫০ কোটি ইউরো৷ স্থানীয় বাসিন্দাদের যে পানির বিল দিতে হয়, তা থেকেই এই প্রকল্পের অর্থসংস্থান হয়৷ এমশার সমবায়ের মুখপাত্র মিশায়েল স্টাইনবাখ বলেন, ‘‘২০১৭-১৮ সালের মধ্যে আমরা ময়লা পানি মুক্ত হব, অর্থাৎ এমশার নদীতে যে পানি গিয়ে পড়বে, তার প্রতিটি বিন্দু পরিশোধিত হবে৷''
আজ কয়েক প্রজন্ম পরে এমশারে আবার বিশুদ্ধ পানির স্বপ্ন একটা সুবিশাল প্রগতি বৈকি৷ একজন বললেন, ‘আমাদের তো এখানে থাকতে হবে৷ কাজেই এই সিউয়েজ প্ল্যান্ট দিয়ে পরিবেশটাকে আবার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা তো ভালোই৷'' আরেক জন বললেন, ‘প্রকৃতির তো এটাই ভবিষ্যৎ, শিশুদের ভবিষ্যৎ৷ যেমন বলা হয়, আমরা তো পৃথিবীটা শুধু ধার করেছি৷''
পানির উৎকর্ষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্যপ্রাণীরাও আবার ফিরে আসছে৷ এছাড়া এমশার নদীর পানি পরিষ্কার হওয়ার অর্থ রাইন নদীর পানিও আরো কিছুটা পরিষ্কার হবে, যে রাইন নদী জার্মানদের কাছে এতো প্রিয়, বিদেশিদের কাছে এতো রোম্যান্টিক৷
বিশেষ ঘোষণা: এই সপ্তাহের অন্বেষণ কুইজে অংশ নিতে ক্লিক করুন এখানে