ইউরোপের অনেক দেশেই বিদেশি-বিদ্বেষ বাড়ছে৷ তারা নাকি বাইরে থেকে এসে দেশের সম্পদে ভাগ বসাচ্ছে৷ একটি রিপোর্ট অনুযায়ী জার্মানির সামাজিক সুরক্ষা কাঠামোয় বিদেশি অভিবাসীরা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন৷
বিজ্ঞাপন
সাধারণ মানুষের ভুল ধারণা যে কোন মাত্রায় পৌঁছাতে পারে, তার একটি দৃষ্টান্ত এক সাম্প্রতিক জনমত সমীক্ষা৷ তাতে দেখা যাচ্ছে, যে জার্মানির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের মতে বিদেশিরা দেশের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার জন্য এক বোঝা৷ অথচ বেসরকারি ব্যার্টেলসমান ফাউন্ডেশন-এর উদ্যোগে প্রকাশিত এক রিপোর্ট ঠিক এর বিপরীত চিত্র তুলে ধরেছে৷
সেই রিপোর্ট অনুযায়ী জার্মানিতে বসবাসরত বিদেশিরা রাষ্ট্র থেকে যে সব আর্থিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেন, তার তুলনায় অনেক বেশি কর দেন৷ শুধু ২০১২ সালেই জার্মানিতে বসবাসরত প্রায় ৬৬ লক্ষ বিদেশি নাগরিক সামাজিক সুরক্ষা তহবিলে প্রায় ২,২০০ কোটি ইউরো জমা দিয়েছেন৷ অর্থাৎ রাষ্ট্রের কাছ থেকে তাঁরা যে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেন, সেই তুলনায় কর ও সামাজিক তহবিলে প্রদেয় অর্থ বাবদ তাঁরা মাথাপিছু প্রতি বছর প্রায় ৩,৩০০ ইউরো বেশি জমা দেন৷
জার্মানিতে বাড়ি সমস্যায় অভিবাসীরা
অভিবাসীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ তবে বাড়ির সমস্যাকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে ধরা যেতে পারে৷এ সমস্যা জার্মানিতে বসবসারত তুর্কিদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়৷ কারণ জার্মানিতে প্রায় ৪০ লাখ তুর্কি আছেন৷
ছবি: Suzheh.sub.ir
অভিবাসী তুর্কিদের সমস্যা বেশি
জার্মানিতে অভিবাসীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ এগুলোর মধ্যে বাড়ির সমস্যাকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে ধরা যেতে পারে৷ জার্মানিতে অভিবাসীদের মধ্যে তুর্কিদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪০ লাখ৷ কাজেই সমস্যাটাও ওদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শীতকালে ঠান্ডায় কষ্ট পায়
তুর্কিদের সাধারণত বাসা ভাড়া দেওয়া হয় পুরনো এলাকায় বহু বছরের পুরনো বাড়িগুলোয়৷ সেই সব বাড়িতে হয়ত দরজা ঠিকমতো বন্ধ হয় না বা জানালা দিয়ে বাতাস ঢোকে বা খানিকটা খোলা থাকে৷ অথবা শীতকালে হিটার কাজ করে না, অর্থাৎ ঠান্ডায় কাটাতে হয়৷ বাড়ির মালিককে কয়েকবার বলেও ঠিক করানো যায়নি৷ এভাবেই জানান তিন দশক আগে তুরস্ক থেকে জার্মানিতে আসা আহমেদ খালিফি৷
ছবি: DW/C. Ruta
বাড়ির অবস্থা অস্বাস্থ্যকর
আহমেদ খালিফির ছেলে আদেলের বাড়িতেও প্রায় একই সমস্যা৷ বাড়িটি ৪০ বছরের পুরনো হওয়ায় খুবই স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার এবং অস্বাস্থ্যকর৷ এ ব্যাপারে অবশ্য বাড়িওয়ালার মাথা ব্যথা নেই, কয়েকবার বলেও কোনো কাজ হয়নি৷
ছবি: DW/C. Ruta
অবশেষে নিজেই দায়িত্ব নেন
আবদাল ১৫ বছর এ বাড়িতে আছেন, কিন্তু একবারও রঙ করা হয়নি৷ আর সেকথা বাড়ির মালিককে কয়েকবার বলায় তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, প্রয়োজনে তিনি যেন নিজেই এ কাজ করে নেন৷ তাই আবদাল এ কাজ ভালো না জানা সত্ত্বেও নিজেই করছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
শীতের কথা ভেবে ভীত
একটি মাত্র ঘর আর সেখানেই বাচ্চাদের নিয়ে থাকেন আলিয়া৷ ঘরে যেসব জিনিসের জায়গা হয় না, সেসব জিনিস স্থান পেয়েছে বাড়ির বারান্দায়৷ কিন্তু শীতের সময় এসব প্রয়োজনীয় জিনিসের কি হবে – তা ভেবে অস্থির আলিয়া৷ এই অবস্থা অবশ্য শুধু আলিয়ার একার নয়৷
ছবি: DW/C. Stefanescu
অভিবাসীদের বেশি সন্তান
অভিবাসীদের বাড়ির বড় সমস্যা৷ তার কারণ, তাঁরা বড় শহরগুলোর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করতে পছন্দ করেন৷ তাছাড়া জার্মানদের তুলনায় অভিবাসীরা কম রোজগার করেন এবং তাঁদের সন্তান সংখ্যা বেশি হওয়ায় বাড়ি পেতেও অসুবিধা হয়৷ এছাড়া একই ধরণের বাড়ির জন্য জার্মানদের তুলনায় তাঁদের কাছে বেশি ভাড়াও চাওয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZB
বাড়ির অবস্থা করুণ
অভিবাসীদের বাসস্থান সমস্যা অবশ্য নতুন সমস্যা নয়৷ অভিবাসীরা যেসব এলাকায় থাকেন সেই পুরনো বাড়িগুলোকে ঠিকঠাক না করানোয়, দিনদিন সেগুলি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছে৷ এই অবস্থা নিদিষ্ট কোনো শহরে নয়, প্রায় শহরেই এই একই অবস্থা৷
ছবি: Fars
আগুনে পরিবারের আট জনের মৃত্যু
প্রায় চার মাস আগে বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যার্গের বাকনাং শহরে একটি বাড়ির বৈদ্যুতিক লাইন ছিল বিপজ্জনক এবং একথা বারবার মালিককে বলার পরও তা ঠিক করা হয়নি৷ যার ফল হয় মর্মান্তিক৷ ঘর গরম বা পানি গরমের জন্য ব্যবহার করা হতো কাঠের চুল্লি৷ ঐ বাড়িতেই আগুন লেগে একজন তুর্কি মা তাঁর সাত সন্তানসহ মারা যান৷ ছবিতে বাকনাং শহরের কিশোর-কিশোরীরা মৃত পরিবারের প্রতি ফুল আর মোমবাতি দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাড়ি মালিকদের মত
বাড়িওয়ালাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, তুর্কি পরিবারগুলো অনেক বড়, সবসময় হৈচৈ লেগে থাকে এবং তেমন পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন নয়৷ আর সেজন্যই তাঁদের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে কিছুটা আপত্তি থাকে বাড়িওয়ালাদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তরুণদের ভিন্নমত
বয়স্ক অভিবাসীরা বাসস্থানের ব্যাপারে যতটা বৈষম্যের শিকার হন বলে মনে করেন, এই প্রজন্মের তুর্কিরা তেমনটা মনে করে না৷ সম্ভবত এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা জার্মান ভাষা ভালো জানার কারণেই এমনটা ঘটছে৷
ছবি: Suzheh.sub.ir
10 ছবি1 | 10
শুধু তাই নয়, গত এক দশকে এই ফারাক প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে৷ ফলে বর্তমানে দেনা-পাওনার এই দাঁড়িপাল্লায় বিদেশি ও জার্মান নাগরিকদের মধ্যে ফারাকও বেড়ে চলেছে৷ বিদেশিরা ৬৭ শতাংশ বেশি অবদান রাখছেন৷ জার্মানদের ক্ষেত্রে এই মাত্রা ৬০ শতাংশ৷
তথ্য-পরিসংখ্যানের এই হিসাব-নিকাশ বিশ্লেষণ করে গবেষকরা আরও একটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন৷ জার্মানিতে বসবাসরত বিদেশিদের শিক্ষাগত যোগ্যতা জার্মানদের তুলনায় কম, যদিও তা আগের তুলনায় বেড়ে চলেছে৷ তা সত্ত্বেও তাঁদের আর্থিক অবদান বেশি৷ ভবিষ্যতে বিদেশিদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রবণতা বাড়লে তাঁরা আরও বেশি বেতনের চাকুরি করতে পারবেন৷ সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় তাদের আর্থিক অবদানও বাড়বে৷ তাই ভালো শিক্ষা নীতিকেই অভিবাসন নীতির মূলমন্ত্র করে তোলা উচিত বলে গবেষকরা মনে করেন৷
এ তো গেল জার্মানিতে বসবাসরত সেই সব মানুষদের কথা, যাদের বিদেশি পাসপোর্ট রয়েছে৷ ভবিষ্যতে জার্মানির জন্য অভিবাসনের গুরুত্ব কতটা? গবেষকদের মতে, প্রতি বছর যদি ২ লক্ষ করে বিদেশি জার্মানিতে থাকতে আসেন, সে ক্ষেত্রে জার্মানির প্রত্যেক বাসিন্দাকে সরকারি কোষাগারে ৪০০ ইউরো কম জমা দিতে হবে৷ তাই উচ্চশিক্ষিত ও দক্ষ বিদেশিদের জার্মানিতে আসতে আরও উৎসাহ দেওয়া উচিত বলে তাঁরা মনে করেন৷ তবে এমন অভিবাসীদের জন্য জার্মানি বর্তমানে মোটেই তেমন আকর্ষণীয় নয়৷ ইউরোপের দক্ষিণের অনেক দেশে সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে উচ্চশিক্ষিত মানুষ জার্মানিতে এসে বসবাস করছেন বটে, কিন্তু সংকট কেটে গেলে তাঁদের স্বদেশে ফিরে যাবার সম্ভাবনা বেশি৷ তাই সেরা মগজ আকর্ষণ করার প্রতিযোগিতায় জার্মানিকে আরও উদ্যোগ নিতে হবে৷