জার্মানির গ্রামাঞ্চল: ইন্টারনেট এখনো যেখানে যন্ত্রণা
৩০ আগস্ট ২০২১
করোনার সংক্রমণ যখন ভয়াবহ পর্যায়ে জেনিফার শুলৎস তখনো ঘরে বসে কাজ করতে পারেননি৷ শিশুরা পারেনি ভিডিও কনফারেন্সে ক্লাস করতে৷ কারণ অতি মন্থর গতির ইন্টারনেট৷ এমন ইন্টারনেট সংযোগ ছড়িয়ে আছে সারা জার্মানিতে৷
জেনিফার শুলৎমেছবি: Janosch Delcker/DW
বিজ্ঞাপন
অথচ জেনিফার শুলৎসের বাড়ি রাজধানী বার্লিনের প্রাণকেন্দ্র থেকে রেলপথে মাত্র দু' ঘণ্টার দূরত্বে৷ তবে রাজধানীর এত কাছে হলেও জেনিফারের মোজে গ্রামে ইন্টারনেট আসলে থেকেও নেই৷ করোনার প্রকোপের সময় অফিস থেকে বলা হলো বাড়ি থেকে কাজ করতে৷ হোম অফিস করার জন্য পূর্ণ সহযোগিতাও করা হলো তাকে৷ ল্যাপটপ দেয়া হলো৷ কিন্তু ইন্টারনেটের এমন ধীর গতি যে কাজ করা সম্ভব হলো না৷ জীবনের ঝুঁকি নিয়েই যেতে হলো অফিসে৷
সে এক মহা আতঙ্কের সময়৷ প্রতিদিন মনে হতো নিজে সংক্রমিত হয়েছেন, তার মাধ্যমে বুঝি পরিবারের অন্যরাও সংক্রমিত হবে আর তাই একে একে সবাই মারা যাবেন করোনায় ভুগে ভুগে৷
ভাগ্যিস ৩০০ মানুষের গ্রামটিতে জেনিফারের মাধ্যমে করোনা আসেনি!
অতীতসরকারেরদায়
মোজে গ্রামে ইন্টারনেটের এই অবস্থার মূল কারণ ৩০ বছরের পুরোনো কপার ফোন অয়্যার৷
১৯৮০ সালের জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর হেলমুট শ্মিড্ট কপার ফোন অয়্যার ধীরে ধীরে সরিয়ে তার জায়গায় ফাইবার অপটিক ক্যাবল নিয়ে আসার ৩০ বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন৷ কিন্তু হেলমুক শ্মিড্টের পরের চ্যান্সেলর হেলমুট কোল ফাইবার অপটিকের জায়গায় শুরু করলেন টিভি ক্যাবল বাড়ানোর উদ্যোগ৷ তারপরে জার্মানির পুনরেকত্রীকরণ হলেও সারা দেশ থেকে কপার ফোন অয়্যার বিদায় করার কাজ আর গতি পায়নি৷ বরং ১৯৯৫ সালে টেলিকমিউনিকেশন খাত পুরোপুরি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ায় গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট সেবার আর উন্নতি হয়নি৷ টেলিকমিউনিকেশন খাত বেসরকারিকরণের ফলে এই খাতে কিছু ক্ষেত্রে সেবার চেয়ে ব্যবসাই হয়ে যায় মহাগুরুত্বপূর্ণ৷আর তাই শহর হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ, গ্রাম থেকে যায় অবহেলিত৷
ঘরে ইন্টারনেট নেই, তবুও চলছে লেখাপড়া
করোনাকালে বিশ্বের অনেক দেশেই চলছে অনলাইন ক্লাস৷ কিন্তু ফিলিপাইনসের কিছু জায়গায় ইন্টারনেট সংযোগের অবস্থা এমন যে লেখাপড়ার জন্য একরকম যুদ্ধেই নামতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Eloisa Lopez/REUTERS
ফিলিপাইনসের পরিস্থিতি
বিশ্বজুড়ে করোনা সংক্রমণ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক পড়াশোনার পরিস্থিতি কেড়ে নিয়েছে৷ অনলাইনে পড়াশোনার দিকে সবাই ঝুঁকলেও বিশ্বের বহু জায়গায় পর্যাপ্ত ইন্টারনেট পরিষেবা নেই৷ ফলে, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত অসংখ্য শিক্ষার্থী৷ ফিলিপাইনসের অবস্থাও অনেকটা এমনই৷
ছবি: Eloisa Lopez/REUTERS
ছাদে সংযোগ
দশ বছর বয়েসি ঝায় আর চালমার বাসার ভেতরে ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যায় না৷ তাই করোনাকালে পঞ্চম শ্রেণীর এই শিক্ষার্থীকে ছাদে উঠে চালের ওপর বসে বসেই করতে হয় অনলাইন ক্লাস৷ তার মা জানিয়েছেন, ‘‘মাঝে মাঝে আমরা সিমকার্ড পরিবর্তন করি যাতে আরেকটু ভালো সংযোগ পাওয়া যায়৷ কিন্তু সবসময় তা করার মতো টাকা হাতে থাকে না৷’’
ছবি: Eloisa Lopez/REUTERS
সরকারের সাহায্য
ফিলিপাইনসের সরকার অন্যান্য দেশের মতোই শিক্ষার্থীদের এই পরিস্থিতিতে ট্যাব বা মোবাইল ফোন দিয়েছে, যার সাহায্যে তারা অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে পারে৷ কথা ছিল জানুয়ারি মাসেই স্কুল খুলবে৷ কিন্তু ফিলিপাইনসে বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আক্রান্ত৷ ফলে, আরো কিছু দিন অনলাইনেই চলবে পড়াশোনা৷
ছবি: Eloisa Lopez/REUTERS
পরিসংখ্যান যা বলছে
অনলাইন পড়াশোনায় উন্নত বিশ্বের দেশগুলি সাফল্য পেলেও ফিলিপাইনসে বাস্তবতা ভিন্ন৷ দশ কোটি আট লাখ মানুষের দেশটিতে মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগের হাতেই, অর্থাৎ মাত্র দুই কোটি মানুষের কাছে রয়েছে ইন্টারনেটের সুবিধা৷ এছাড়া আরো অনেক পরিবারেরই নেই মোবাইল কেনার সামর্থ্য৷ অন্যদিকে ইন্টারনেট না থাকায় স্কুলছুট হয়েছে সেদেশের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ, জানাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়৷
ছবি: Eloisa Lopez/REUTERS
পরিবারের ভূমিকা
এগারো বছরের লাভলি তার পরিবারের সাথে ম্যানিলার একটি কবরস্থানেই থাকে৷ মুরগি বেচে সংসার চালান তার বাবা-মা৷ বাসার মানুষের কাছ থেকে সে পড়াশোনায় সাহায্য না পেলেও তাদের পাশে, কবরের ওপরে বসেই, পড়ার কাজ শেষ করে৷ লাভলির মা জানেন, এই পরিস্থিতি পড়াশোনার জন্য অনুকূল নয়৷ তবে পরিস্তিতি মেনে নিয়েই তাকে বলতেহয়, ‘‘ব্যবসা না দেখলে ওকে খাওয়াবো কী? ও পড়াশোনা করে চাকরি পেলে তবেই আমরা এখান থেকে বেরোতে পারবো৷’’
ছবি: Eloisa Lopez/REUTERS
পড়ার জন্য পাহাড় চড়া
কলেজপড়ুয়া মার্ক ফিলিপাইনসের বাতাঙ্গাস অঞ্চলের বাসিন্দা৷ ইন্টারনেট সংযোগের জন্য তাকে কখনো জঙ্গলের ভেতর, কখনো পাহাড়ে চড়তে হয়৷ পড়ার জন্য প্রয়োজনীয় ইন্টারনেটের খরচ জোগাতে পার্ট-টাইম কাজও করে সে৷
ছবি: Eloisa Lopez/REUTERS
তবুও নাছোড়বান্দা যারা
হাজারো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও লক্ষ্যে অনড় মার্ক৷ তার বক্তব্য, ‘‘আমি জানি, আমরা ধনী নই, তাই পড়াশোনা শেষ করেই আমি বাবা-মায়ের ঋণ শোধ করতে চাই৷ হাল না ছেড়ে, ধৈর্যের সাথে এই কঠিন সময়েও আমি পড়ায় মন দিতে চাই৷ উন্নতি করতে চাই৷’’
ছবি: Eloisa Lopez/REUTERS
7 ছবি1 | 7
এ অবস্থা কাটানোর শত রকমের চেষ্টা করেছেন মোজে গ্রামের মেয়র মার্কো রোরমান৷কিছুতেই কাজ না হওয়ায় ২০১৩ সালে স্থানীয় রাজনীতিতে যোগ দেন৷ কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাক খাটিয়েও কোনো কাজ হয়নি৷ সেকারণে করোনাকালে মোজেস-এর বয়স্কদেরও দেখা গেছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শহরে কাজ করতে যেতে, অন্যদিকে স্কুলশিক্ষার্থীদের ঘরে বসে বসেই করতে হয়েছে সময়ের অপচয়, ধীর গতির ইন্টারনেটের কারণে তারা ক্লাস করতে পারেনি৷
তবে মোজে-র ভূমিপুত্র মার্কো রোরমান মনে করেন করোনা এসে গ্রামাঞ্চল ইন্টারনেট পরিষেবায় কতটা অবহেলিত তা দেখিয়ে দেয়ায় ভালোই হয়েছে৷ কারণ, দেরিতে হলেও অবশেষে প্রত্যেক নাগরিকের ইন্টারনেট প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য ‘রাইট টু ইন্টারনেট' আইন সব অঞ্চলে কার্যকর করতে শুরু করেছে জার্মানি৷ আশা করা যায়, ইন্টারনেট সেবা পেতে মানুষকে শহরে ছুটতে হয় এমন গ্রাম ভবিষ্যতে আর থাকবে না৷