জার্মানিতে এখন আলোচনার বড় বিষয় হলো ‘জনশক্তির অভাব'৷ ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতিটি কর্মীর অভাবে ভুগছে বলে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীরা হাহাকার করছেন৷ ইউরোপজুড়েই চলা এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য সুযোগ হতে পারে কি?
বিজ্ঞাপন
এই এক সপ্তাহ আগে জার্মানির অর্থমন্ত্রী রবার্ট হাবেক বললেন, তার দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কর্মীর অভাব৷ তার সরকার এ বছর অর্থনীতি ০.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশা করছে, যা আগের বছর ছিল ১.৩ শতাংশ৷ এর কারণ অবশ্য কয়েকটি৷ উৎপাদক দেশটির জন্য সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈশ্বিক চাহিদা হ্রাস, ভূরাজনীতির প্রভাব ও হার না মানা মূল্যস্ফীতি৷
কিন্তু পূর্বাভাসে এত কম প্রবৃদ্ধি হিসেবের আরেকটি কারণ কর্মী সংকট৷ জার্মানিতে এই মুহূর্তে সাত লাখ কর্মীর অভাব রয়েছে৷ নভেম্বরের শেষ দিকে জার্মান চেম্বার অফ কমার্সও বলছিল যে দেশের অর্ধেক সংখ্যক কোম্পানিতে কর্মী সংকট দেখা দিয়েছে৷ হাবেকের ব্যাখ্যায় সেদিন দেখা গেল, কর্মী সংকটের কারণে প্রবৃদ্ধি ০.৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.২ শতাংশ হিসেব করতে হচ্ছে৷
এই সাত লাখ সংখ্যাটি আর দশ বছরের মধ্যে ৭০ লাখে পরিণত হবে বলে জার্মান সরকারের ধারণা৷ অর্থাৎ, জার্মানির শ্রমবাজারে ২০৩৫ সাল নাগাদ ৭০ লাখ কর্মীর অভাব তৈরি হবে৷ এর বড় কারণ, এখানকার জনসংখ্যার একটা বড় অংশ বয়স্ক নাগরিক৷ তারা অবসরে যাবেন৷ তাই এই কর্মী সংকট যে শুধু দক্ষ কর্মীর, তা নয়৷ সে কারণেই হাবেকের হাহাকার ছিল এমন, ‘‘আমাদের হাত আর মাথা দরকার৷’’
জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টিফটুং ভিসেনশাফট উন্ড পলিটিক বা এসডাব্লিউপি'র হিসেবে, সামাজিক ও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সেবা, নির্মাণ, তথ্য প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত - এসব খাতে যেমন জনশক্তির ঘাটতি আছে, তেমনি আছে গৃহকর্মী ও অন্যান্য সহযোগী কর্মীর অভাবও৷
বাংলাদেশে বেকারত্ব ও ইন্টার্নশিপ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস বলছে, ২০২৩ সাল শেষে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ছিল সাড়ে ২৩ লাখ৷ তবে সম্প্রতি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দিতে ইন্টার্নশিপ নীতিমালা প্রকাশ করেছে সরকার৷
ছবি: Danko Natalya/Zoonar/picture alliance
বেকারত্বের সংজ্ঞা
বেকারত্বের সংজ্ঞাবাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, সাত দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টাও কোনো কাজ করেনি, কিন্তু কাজের জন্য প্রস্তুত ছিলেন, তাদেরই বেকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ এমনকি জরিপের আগে ৩০ দিন বেতন বা মজুরি বা মুনাফার বিনিময়ে কাজ খুঁজেছেন, তারাও বেকার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন৷
ছবি: Danko Natalya/Zoonar/picture alliance
বেকারের সংখ্যা
বিবিএস বলছে, ২০২৩ সাল শেষে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ছিল সাড়ে ২৩ লাখ৷ এর মধ্যে পুরুষ ১৫ লাখ ৭০ হাজার আর নারী ৭ লাখ ৮০ হাজার৷
ছবি: PantherMedia/picture alliance
পাঁচ বছরে বেকার স্নাতকের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ
গত অক্টোবরে বিবিএস প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ-২০২২ বলছে, স্নাতক ডিগ্রিধারীর হার ২০১৭ অর্থবছরের ১১.২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে৷ বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, পাঁচ বছরে বেকার স্নাতকের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, যা ২০১৭ অর্থবছরে প্রায় ৪ লাখ ছিল৷
ছবি: DW
উচ্চশিক্ষিত বেকার
বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, মাধ্যমিক পাস করেছেন এমন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকার ২.৮২ শতাংশ, উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন এমনদের মধ্যে ৪.৯৪ শতাংশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকারের হার এখন ১২ শতাংশ৷
ছবি: bdnews24.com
উচ্চশিক্ষার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন
অর্থনীতিবিদ ও জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল লেবার অফিসের কর্মসংস্থান বিভাগের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম বাংলাদেশে ডিডাব্লিউর কন্টেন্ট পার্টনার ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘‘এটি শ্রমবাজারের দৃষ্টিকোণ থেকে উচ্চশিক্ষার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে৷ শিক্ষাব্যবস্থা কেমন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে, যাদের যোগ্যতা চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসে না?’’
ছবি: Jelena Djukic Pejic/DW
উচ্চশিক্ষার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন
অর্থনীতিবিদ ও জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল লেবার অফিসের কর্মসংস্থান বিভাগের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম বাংলাদেশে ডিডাব্লিউর কন্টেন্ট পার্টনার ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘‘এটি শ্রমবাজারের দৃষ্টিকোণ থেকে উচ্চশিক্ষার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে৷ শিক্ষাব্যবস্থা কেমন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে, যাদের যোগ্যতা চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসে না?’’
ছবি: Rubel Mahfuz
প্রত্যাশার ঘাটতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা ডেইলি স্টারকে বলেন, নিয়োগদাতা ও চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে প্রত্যাশার বিরাট ঘাটতি আছে৷ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞান ও দক্ষতা দিতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘তাই নিয়োগকারীরা দক্ষ কর্মী পাচ্ছেন না৷ অন্যদিকে প্রত্যাশার সঙ্গে না মেলায় বিপুল সংখ্যক গ্র্যাজুয়েট চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারেনি৷’’
ছবি: privat
ইন্টার্নশিপ নীতিমালা-২০২৩
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যুগোপযোগী ও অভিজ্ঞ মানবসম্পদ সৃষ্টি, পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞানের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতার সমন্বয় ঘটানোর সুযোগ রেখে সম্প্রতি ইন্টার্নশিপ নীতিমালা প্রকাশ করেছে সরকার৷ এই নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত কিংবা অন্য কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইন্টার্নশিপ প্রদান করতে পারবে৷
ছবি: Oliver Boehmer/Zoonar/picture alliance
আবেদনের যোগ্যতা
ইন্টার্নশিপ নীতিমালা-২০২৩ অনুসারে, ইন্টার্নশিপের আবেদন করার জন্য আগ্রহীকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে; প্রার্থীকে কমপক্ষে স্নাতক/সমমানের ডিগ্রিধারী হতে হবে (অবতীর্ণ প্রার্থীসহ); স্নাতক/স্নাতকোত্তর/সমমানের ডিগ্রি অর্জনের দুই বছরের মধ্যে আবেদন করতে হবে এবং একজন প্রার্থী একবার সরকারি অফিসে ইন্টার্নশিপ করতে পারবেন৷
ছবি: DW
মেয়াদ ও ভাতা
ইন্টার্নশিপের মেয়াদ সর্বনিম্ন তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত হতে পারবে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সময় নির্ধারণ করবে৷ নীতিমালা অনুযায়ী, ইন্টার্ন প্রতি মাসে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণ ভাতা প্রাপ্য হবেন৷ ভাতা ছাড়া ইন্টার্ন অন্য কোনো ভাতা বা সুবিধা প্রাপ্য হবেন না৷
ছবি: Syed Mahamudur Rahman/NurPhoto/IMAGO
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ইন্টার্নশিপ
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ৩ মাস মেয়াদে ১০ জনকে ইন্টার্নশিপ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে৷ ইন্টার্নশিপের সময় প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা ভাতা পাবেন শিক্ষার্থীরা৷ ১৫ মার্চের মধ্যে http://erecruitment.bcc.gov.bd ঠিকানায় আবেদন করা যাবে৷ সফলভাবে কোর্স সম্পন্ন করতে পারলে ইন্টার্নরা পাবেন সনদ৷
ছবি: bdnews24.com
11 ছবি1 | 11
এই জনশক্তির অভাব স্থানীয়দের দিয়ে পূরণ সম্ভব হবে না বলে এরই মধ্যে বোঝা হয়ে গেছে সরকারের৷ তাই তাদের নির্ভর করতে হবে অভিবাসীদের ওপর৷ জার্মানিতে নাগরিকত্বের নিয়ম সহজ করা থেকে শুরু করে অন্য দেশ থেকে শিক্ষার্থী ও কর্মী আনার ব্যাপারে সরকার কট্টরপন্থিদের আপত্তি সত্ত্বেও নানা নীতি গ্রহণ করছে৷ বিশেষ করে জার্মানিসহ ইউরোপের সহযোগী দেশগুলো থেকে আরো বেশি কর্মী আনা এখন তাদের জন্য কৌশলগত গুরুত্বে অগ্রাধিকারে রয়েছে৷ সে কাজটি তারা খুব ভালোভাবে করতে পারছে, বললে ভুল হবে৷
তবে এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের মতো জনশক্তি রপ্তানি করে আয় করা দেশগুলোর জন্য একটা সুযোগ বলা যেতে পারে৷ দক্ষিণ এশিয়ার এই জনবহুল দেশটি ২০২৩ সালে রেকর্ড ১৩ লাখ জনশক্তি রপ্তানি করেছে (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ০৩ জানুয়ারি ২০২৪)৷ গত বছর তারা ১৩৭টি দেশে জনশক্তি রপ্তানি করেছে৷ এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এখনো বাংলাদেশের শ্রমশক্তির প্রধান গন্তব্য৷ অন্যদিকে, ইউরোপের দেশগুলোতে অনিয়মিত পথে সাগর পাড়ি দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশিরা আসার চেষ্টা করছেন৷ কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে বছরের পর বছর ধরে তারা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন৷
অথচ বাংলাদেশ যদি ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে একটা কৌশলগত অংশীদারিত্ব তৈরি করতে পারে এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এমন উদ্যোগ নেয়া যায় যে, ইউরোপের বাজারের জন্য দরকারি কাজগুলোর প্রশিক্ষণ দেয়া হবে এবং ভাষা শেখার পর তারা এখানে এসে কাজে যোগ দিতে পারবেন, তাহলে এসব প্রশিক্ষণে নিজ খরচেই আগ্রহীরা যোগ দিতে পারেন৷
এখন সেই সুযোগ কতটা ভালোভাবে কাজে লাগানো যায় তা বাংলাদেশের দায়িত্ব৷ ভারত ঠিকই তথ্যপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে নানাভাবে এই শ্রমবাজারে তাদের জায়গা তৈরি করে নিচ্ছে বা নিয়েছে৷ তাই অংশীদার হিসেবে জার্মানির কাছে বা ইউরোপের কাছে তাদের গুরুত্বও বেশি৷
দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাও দরকার৷ বাংলাদেশের কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে ইউরোপের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্ত করা দরকার৷ আবার স্কুল পর্যায়েই বিদেশি ভাষা শেখার সুযোগ রাখা দরকার৷ স্কুল-কলেজ পর্যায়ে কোনো একটি ভাষা শিখলে তা সার্বিক গ্রেড পয়েন্ট ফলাফলের ওপর যেন প্রভাব রাখে তেমন ব্যবস্থা রাখা দরকার৷
তবে সবার আগে প্রয়োজন এই মুহূর্তের চাহিদা মেটানো৷ জার্মানিতে এখন মাংস কাটার লোক থেকে শুরু করে ট্রাক ড্রাইভার, নার্স, ডাক্তার, গৃহকর্মী, কৃষক, তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী সবই দরকার৷ তাই এখন থেকে শুরু করে আগামী দশ বছরে যে কর্মশক্তির ঘাটতি তৈরি হবে এখানে, তাতে বাংলাদেশের মানুষ কীভাবে অবদান রাখতে পারেন তা দেখা দরকার৷