নির্বাচনি সংস্কারের মাধ্যমে জার্মানির সংসদের সদস্যসংখ্যা কমানোর সরকারি উদ্যোগ নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে৷ দুটি বিরোধী দল প্রস্তাবিত আইন চ্যালেঞ্জ করে সাংবিধানিক আদালতের দ্বারস্থ হবার হুমকি দিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির জনসংখ্যা প্রায় আট কোটি ৩০ লাখ হলেও সে দেশের সংসদের নিম্ন কক্ষে বর্তমানে রেকর্ড ৭৩৬ জন সদস্য রয়েছেন৷ জটিল নির্বাচনি আইনের দৌলতে গত নির্বাচনের পর এত সংখ্যক জনপ্রতিনিধি চার বছরের জন্য বেতন ও নানা আর্থিক সুবিধা ভোগ করছেন৷ কোনো ঊর্দ্ধসীমা না থাকায় ভবিষ্যতে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷ রাজকোষের উপর চাপ কমাতে বেশ কিছুকাল ধরে জার্মানির নির্বাচনি আইন সংস্কারের উদ্যোগ সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ঐকমত্যের অভাবে এতকাল সাফল্য পাওয়া যায় নি৷ এবার চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের নেতৃত্বে তিন দলের জোট সরকার নিজস্ব সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সেই ‘সাহসি' পদক্ষেপ নিতে চলেছে৷
চলতি সপ্তাহে জার্মান সরকার যে আইন অনুমোদনের উদ্যোগ নিচ্ছে, তার আওতায় বুন্ডেসটাগের সর্বোচ্চ সদস্যসংখ্যা ৬৩০ অতিক্রম করতে পারবে না৷ গত জানুয়ারি মাসে সরকার যে খসড়া প্রস্তুত করেছিল, তাতে সেই সংখ্যা ৫৯৮ রাখা হয়েছিল৷ কিন্তু সে ক্ষেত্রে কিছু নির্বাচনি কেন্দ্র থেকে কোনো জনপ্রতিনিধি সংসদে প্রবেশ না করার আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় ঊর্ধ্বসীমা কিছুটা বাড়ানো হয়েছে৷
জার্মানির নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জটিলতার মূলে রয়েছে ভোটারপ্রতি দুটি করে ভোট৷ প্রথম ভোট যায় পছন্দের প্রার্থীর জন্য, দ্বিতীয়টি পছন্দের রাজনৈতিক দলের জন্য৷ সেই দ্বিতীয় ভোটের সংখ্যা অনুযায়ী প্রত্যেক রাজ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলি বাড়তি সংসদ সদস্য মনোনয়ন করতে পারে৷ তার উপর সরাসরি নির্বাচিত প্রার্থী ও তালিকার দৌলতে মনোনীত প্রার্থীর সংখ্যার মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে জটিল হিসেবের কারণে বাড়তি কিছু আসন সৃষ্টি হয়৷ এমন সব প্রচলিত নিয়মের কারণে সংসদের নিম্ন কক্ষ ফুলেফেঁপে ওঠে৷ আইনের বর্তমান খসড়া অনুযায়ী নির্বাচনি কেন্দ্রের সংখ্যা ২৯৯ রাখা হলেও রাজ্য তালিকায় ৩৩১টির বেশি আসন থাকবে না৷
বলা বাহুল্য জার্মানির বিরোধী দলগুলির মধ্যে এই সংস্কারকে কেন্দ্র করে তুমুল অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে৷ বিশেষ করে বাভেরিয়ার সিএসইউ দল এবং বামপন্থি দল ‘ডি লিংকে' সরকারের এই আইন বাতিল করার লক্ষ্যে সাংবিধানিক আদালতের দ্বারস্থ্য হবার হুমকি দিয়েছে৷ উল্লেখ্য, এই দুই দল বর্তমান নির্বাচনি নিয়মের কারণে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়ে এসেছে৷ বিশেষ করে বাম দল মাত্র তিনটি আসন সরাসরি জিতলেও দু-দুবার সংসদীয় দলের মর্যাদা ও বাড়তি আসন পেয়েছে৷
সংসদে প্রধান বিরোধী ইউনিয়ন শিবিরের সিডিইউ দল এই উদ্যোগের সমালোচনা করে বলেছে, নির্বাচনি আইনের সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের যে দস্তুর রয়েছে, বর্তমান সরকার তা অগ্রাহ্য করেছে৷ ফলে বর্তমান পরিকল্পনা জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে না বলে দলের সাধারণ সম্পাদক মারিও চায়া দাবি করেন৷ সিএসইউ দলের প্রধান ও বাভেরিয়ার মুখ্যমন্ত্রী মার্কুস স্যোডার সরকারের পদক্ষেপকে ‘গণতন্ত্রের উপর হামলা' হিসেবে বর্ণনা করেন৷ বাম দলের প্রধান জানিন ভিসলারও সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী পক্ষকে অবজ্ঞার অভিযোগ করে বলেন, এই পরিকল্পনার সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে৷
জার্মানিতে ব্যালট বাক্স থেকে সরকার গঠনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া
জনগণের ইচ্ছার ন্যায্য প্রতিফলন ঘটাতে গিয়ে জার্মানির নির্বাচন প্রক্রিয়া বেশ জটিল হয়ে উঠেছে৷ অনেক নাগরিকেরও সব খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে ধারণা নেই৷ এমনই কিছু বৈশিষ্ট্যের দিকে নজর দেওয়া যাক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Kalker
নেই আলাদা ভোটার তালিকা
জার্মানিতে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী সব মানুষকেই পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে নাম নিবন্ধন করতে হয়৷ তাই সেই তালিকা থেকে শুধু জার্মান নাগরিকদের বেছে নিয়ে ডাকযোগে ভোট দেবার আমন্ত্রণ পাঠানো হয়৷ জাতীয় পরিচয়পত্র ও সেই আমন্ত্রণপত্র নিয়ে নির্ধারিত ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে গেলেই ভোট দেওয়া যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Güttler
ডাকযোগে ভোট দেবার সুযোগ
ভোটার হিসেবে আমন্ত্রণপত্র পেলে সশরীরে ভোট না দিলেও চলবে৷ কোনো কারণ না দেখিয়ে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে আগেভাগেই ভোট দেওয়া সম্ভব৷ যে সব জার্মান নাগরিক বিদেশে থাকেন, তারাও জার্মানিতে তাদের সর্বশেষ বাসস্থানের পৌরসভার মাধ্যমে পোস্টাল ব্যালট সংগ্রহ করতে পারেন৷
ছবি: Jens Krick/Flashpic/picture alliance
নাগরিকদের দুটি করে ভোট
জার্মানির সংসদ নির্বাচনে ভোটাররা দুটি করে ভোট দেবার সুযোগ পান৷ প্রথমটি নির্বাচনি কেন্দ্রে সরাসরি প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য, দ্বিতীয়টি পছন্দের কোনো দলের জন্য৷ প্রার্থী ও দল ভিন্ন হলেও চলবে৷ দ্বিতীয় তালিকায় দলীয় সমর্থনের অনুপাতের ভিত্তিতে সংসদে অর্ধেক আসনে প্রার্থী স্থির করা হয়৷
ছবি: C. Ohde/blickwinkel/McPHOTO/picture alliance
‘বোনাস’ ভোটের জটিল হিসেব
ভোটারদের দেওয়া প্রথম ভোটের ভিত্তিতে ২৯৯ জন স্থানীয় প্রার্থীর সরাসরি এবং দ্বিতীয় ভোটের ভিত্তিতে বাকি ২৯৯ জনের দলীয় মনোনয়ন অনুযায়ী সংসদে আসন পাওয়ার কথা৷ কিন্তু বাস্তবে সংসদে সদস্যসংখ্যা ৫৯৮ ছাপিয়ে যায়৷ কোনো দল যদি শতকরা হিসেবে দ্বিতীয় ভোটের তুলনায় বেশি মাত্রায় প্রথম ভোট পায়, তখন জটিল এক নিয়মের ভিত্তিতে সেই দল সংসদে কিছু বাড়তি আসন লাভ করে৷ তখন ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে বাকি দলগুলিকেও বেশি আসন দিতে হয়৷
সব দল সংসদে স্থান পায় না
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানির গণতন্ত্রের দুর্বলতা কাটাতে সংবিধান প্রণেতারা অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলির ক্ষমতা সঙ্কুচিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন৷ দ্বিতীয় ভোটের কমপক্ষে পাঁচ শতাংশ না পেলে কোনো দল সংসদের নিম্ন কক্ষ বুন্ডেসটাগে স্থান পায় না৷ তবে নির্বাচনি কেন্দ্রে কমপক্ষে তিনটি আসন পেলেও সংসদীয় দলের মর্যাদা পাওয়া সম্ভব৷
ছবি: Tim Brakemeier/dpa/picture alliance
ভোটগ্রহণের দিন রোববার
জার্মানিতে ভোটগ্রহণের জন্য সাধারণত রোববারের দিনটিকেই বেছে নেওয়া হয়৷ নাগরিকেরা ছুটির দিনে নির্বিঘ্নে ভোট দেবার সুযোগ পান৷ সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে ভোটগ্রহণ শেষ হলে গণনা শুরু হয়৷ শিল্পোন্নত দেশ হয়েও জার্মানি নিরাপত্তার খাতিরে এখনো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার করে না৷ কাগজের ব্যালট গণনার পর দ্রুত ফলাফল জানতে অবশ্য প্রযুক্তির প্রয়োগ বাড়ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J.Stratenschulte
ভোটের ফল প্রকাশের পর জনগণ ‘ক্ষমতাহীন’
নির্বাচনি প্রচারের শেষে ভোট দেবার সময় পর্যন্ত ভোটাররা পছন্দের প্রার্থী ও দলকে বেছে নিতে পারেন৷ তবে জার্মানিতে সাধারণত জোট সরকার ক্ষমতা গড়ে৷ নির্বাচনের পর আসনসংখ্যার বিচারে সবচেয়ে শক্তিশালী দল জোট গড়ার উদ্যোগ শুরু করে৷ সাধারণত প্রাথমিক আলাপ-আলোচনার পর নির্দিষ্ট শরিক দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের প্রক্রিয়া শুরু হয়৷ দলীয় কর্মসূচি নিয়ে দরকষাকষির পর জোট সরকারের ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচি স্থির হয়৷