অলটারনেটিভ ফর জার্মানি বা জার্মানির জন্য বিকল্প দল (এএফডি) প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৩ সালের এপ্রিলে৷ প্রতিষ্ঠার পাঁচ মাস পরের নির্বাচনেই প্রায় পাঁচ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পেয়ে সাড়া ফেলে দেয় এই দল৷
বিজ্ঞাপন
২০১৭ সালের নির্বাচনকে ঘিরে দলটি নিয়ে চলছে নানা আলোচনা৷ এই আলোচনার প্রধান ১০টি বিষয় এখানে উল্লেখ করা হলো৷
অভিবাসন বিরোধী
ডানপন্থি এই রাজনৈতিক দলটির প্রথম পরিচয় হচ্ছে, এরা অভিবাসন বিরোধী৷ ২০১৫ সালে জার্মানি যখন শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে শুরু করে, তখন এই দলটিও বিভিন্ন রাজ্য নির্বাচনে ভালো করতে থাকে৷ তারা ইউরোপের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে এবং জার্মানির সীমান্তে জাতীয়তা পরীক্ষার কঠোর ব্যবস্থা রাখতে চায়৷
যে দেশ থেকে মানুষ জার্মানি আসতে চায়, সেই মানুষদের সেখানেই আটকে দেয়ার পক্ষে তারা৷ কারো আশ্রয়ের আবেদন খারিজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ফেরত পাঠিয়ে দিতে চায় দলটি৷ জার্মানির ঐতিহ্যবাহী ভাষা ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বারোপের পাশাপাশি তারা মনে করে, ইসলাম জার্মান সমাজের অংশ নয়৷
এএফডি নেতাদের আপত্তিকর যত মন্তব্য
জার্মানির ডানপন্থি পপুলিস্ট পার্টি অল্টারনেটিভ ফর জার্মানির (এএফডি) নেতারা গত কয়েকমাস ধরে একের পর এক উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন৷ তাদের সেরকম কয়েকটি বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হলো৷
ছবি: picture alliance/ZB/H. Schmidt
ফ্রাউকে পেট্রি
‘অবৈধভাবে জার্মানিতে প্রবেশকারী শরণার্থীদের দিকে গুলি ছোড়া উচিত জার্মানির বর্ডার পুলিশের’, বলেছিলেন এএফডি’র কো-চেয়ার৷ ২০১৬ সালে জার্মানির একটি আঞ্চলিক পত্রিকাকে তিনি জানান, পুলিশ অফিসাররা সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে প্রয়োজনে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে পারে৷ সর্বশেষ সাবেক কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানির নেতা এরিক হ্যোনেকার এ ধরনের কথা বলেছেন৷
ছবি: Getty Images/T. Lohnes
বও্যর্ন হ্যোকে
জার্মানির থ্যুরিঙ্গা রাজ্যের এএফডির প্রধান বার্লিনের হলোকস্ট মেমোরিয়ালকে ‘মন্যুমেন্ট অফ শেইম’ আখ্যা দিয়ে জার্মানিতে নাৎসি অতীতের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন৷ গুরুত্বপূর্ণ এক নির্বাচনের বছরে এই মন্তব্য করায় তাকে বহিস্কার করার পথে যেতে বাধ্য হয়েছেন এএফডির সদস্যরা৷
ছবি: picture-alliance/Arifoto Ug/Candy Welz
আলেক্সান্ডার গাউলান্ড
এএফডির ডেপুটি চেয়ারম্যান আলেক্সান্ডার গাউলান্ড গতবছর বলেন, জার্মানির জাতীয় ফুটবল দলের রক্ষণভাগের খেলোয়াড় জ্যেরম বোয়াটেংকে তাঁর পারফর্মেন্সের জন্য অনেকে প্রশংসা করলেও, তাঁর মতো কাউকে কেউ প্রতিবেশী হিসেবে চাইবে না৷ কৃষ্ণাঙ্গ বোয়াটেংকে নিয়ে এমন মন্তব্য সমালোচনার ঝড় তোলে জার্মানিতে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Murat
বিট্রিক্স ফন স্টর্চ
প্রাথমিকভাবে এএফডি ইউরো এবং বেইলআউটের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছিল৷ কিন্তু পরবর্তীতে দ্রুতই শরণার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় দলটি৷ ইউরোপের এই আইনপ্রণেতা বলেছেন, ‘‘যারা সীমান্তে আমাদের থামার নির্দেশ গ্রহণ করে না, তারা আক্রমণকারী৷ আর সেসব আক্রমণকারীকে প্রতিহত করতে হবে৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Murat
মার্কুস প্রেতজেল
এএফডির নর্থ রাইন-ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্যের চেয়ারম্যান মার্কুস প্রেতজেল৷ ফ্রাউকে পেট্রির নতুন স্বামীও তিনি৷ বার্লিনে গত বছর ক্রিসমাস মার্কেটে প্রাণঘাতি হামলার পর তার মন্তব্য, ‘‘ম্যার্কেলের কারণেই প্রাণ হারিয়েছে এরা৷’’
ছবি: picture alliance/dpa/M. Murat
আন্দ্রে ভেন্ডট
স্যাক্সনি রাজ্যের সাংসদ সম্প্রতি জানতে চেয়েছেন অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক শরণার্থীর পেছনে রাষ্ট্র কতটা খরচ বহন করবে৷ তাঁর এই বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা হয়েছে৷ গত বছরের জুলাই অবধি ৫২,০০০ অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক শরণার্থী জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছে৷
ছবি: picture alliance/ZB/H. Schmidt
6 ছবি1 | 6
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিরোধী
২০১৩ সালের নির্বাচনে গ্রিসের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঋণগ্রস্ত সদস্যদের বেইল-আউটের বিরোধিতা করে তারা আলোচনায় আসে৷ অবশ্য ওই নির্বাচনে সংসদে প্রতিনিধি পাঠানোর মতো ভোট তারা পায়নি৷ কিন্তু ২০১৪ সালের ইউরোপীয় সংসদ নির্বাচনে তারা ৭ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পেয়েছে৷ তারা ইউরোপীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারণার বিরোধিতা করে৷ একক মুদ্রা ইউরোও তারা রাখতে চায় না৷ এএফডির মতে, জাতীয় পর্যায়ে ফিরে গেলেই ইউরোপ শক্তিশালী হবে৷
ডানপন্থি রাজনীতি
যে ধারার প্রবণতার কারণে অ্যামেরিকায় ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন বা যুক্তরাজ্য বেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছে, সেই প্রবণতা থেকে জার্মানিতে এই দলটির উত্থান হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন৷ অরাজনৈতিক অবস্থান থেকে উদ্ভব হয়ে দলটি জার্মান রাজনীতিতে সবচেয়ে ডানপন্থি অবস্থান গ্রহণ করেছে৷ এদের, বিশেষ করে সাবেক পূর্ব জার্মানিতে জনপ্রিয়তা বেশি৷
বদলে যাচ্ছে রাজনীতির মানচিত্র
একটা সমীক্ষায় সম্ভাব্য ভোটারদের প্রশ্ন করা হয়, আগামী রোববার ভোট হলে কাকে ভোট দেবেন? সেখানে এএফডি ৮-১৫ শতাংশ ভোট পায়৷ অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করেন, এই দলটির সমর্থন অনেক বেড়ে যেতে পারে৷
আঞ্চলিক খেলোয়াড়
এরই মধ্যে জার্মানির বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁরা আঞ্চলিক রাজনীতির বড় খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছে৷ ১৬টি রাজ্যের মধ্যে ১৩টি রাজ্যের সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে৷ গত বছর জার্মানির উত্তর-পূর্বের রাজ্য মেকলেনবুর্গ ফোয়রপমার্নে ২০ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয় তারা৷ সাক্সনি রাজ্যে দলটি ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পায়৷ সেখানে সরকার গঠন করতে সিডিইউ-এসপিডি-গ্রিনকে জোট করতে হয়৷
নব্য নাৎসিদের নতুন আশ্রয়
আনুষ্ঠানিকভাবে দলটি যদিও সরাসরি গণতন্ত্র, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং আইনের শাসনের কথা বলছে, তথাপি এর স্বল্প ইতিহাস পর্যালোচনা করে অনেক সমালোচনাকারী বলছেন, এর সদস্যরা নব্য নাৎসি ধারণাগুলোকে এগিয়ে নিচ্ছেন এবং তাদের ভাষা ব্যবহার করছেন৷ নাৎসিবিরোধী ট্যাবুগুলো এই দলটি ভেঙে দিচ্ছে বলেও অনেকে অভিযোগ করেন৷
রাজনীতিবিদদের মুখে খাবার নিক্ষেপ নতুন নয়
জার্মানির এএফডি পার্টির বিয়াট্রিক্স ফন শ্টর্চই প্রথম রাজনীতিবিদ নয়, যার মুখে ‘পাই’, যা কিনা এক ধরনের নরম খাবার, ছুড়ে মারা হয়েছে৷ পাই ক্ষতিকর কিছু নয়, তার আঘাতে ব্যথাও লাগে না, তবে প্রতিবাদের এক শক্ত উপায় সেটা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
খাবার প্রতিবাদ
জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর হেলমুট ক্যোলকে লক্ষ্য করে একবার ‘ক্রিম কেক’ ছুঁড়ে মারা হয়েছিল৷ ২০০০ সালে বার্লিনে এক বইয়ের দোকানে একটি বইয়ে স্বাক্ষরের সময় সেই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়ের চ্যান্সেলর৷ বিরক্ত ক্যোল সে ঘটনার পর চেয়ারে বসেছিলেন, আর বলেছিলেন, ‘‘অনাকাঙ্খিত ব্যক্তিরা আজকাল সর্বত্র আছে মনে হচ্ছে৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Pilick
ভুল স্বাদ
দ্য হেগে ২০০০ সালে জলবায়ু চুক্তি সংক্রান্ত এক আলোচনায় এসে পাই হামলার শিকার হন তখনকার মার্কিন প্রধান সমঝোতাকারী ফ্রাংক ই. লয়৷ এক ক্ষুব্ধ নারী তাঁকে লক্ষ্য করে পাই ছুঁড়ে মারেন৷ তবে তাতে বিচলিত হননি ই. লয়৷ বরং পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে মজা করেছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/ PA/CHANNEL_4_NEWS
পাই পছন্দ করেননি গেটস
পাই ছুঁড়ে মেরে কুখ্যাত বেলজিয়ান লেখক, সমালোচক নোয়েল গোডিন ১৯৯৮ সালে বিল গেটসকে লক্ষ্য করে ‘পাই কেক’ নিক্ষেপ করেছিলেন, কেননা গেটসকে মাত্রাতিরিক্ত ‘অহংকারী’ মনে হয়েছিল তাঁর৷ জবাবে গেটস মজা করে বলেছিলেন, পাইটা তেমন ভালো ছিল না৷
ছবি: Getty Images
নির্বাচনি প্রচারণায় হামলা
নেদারল্যান্ডসের এক রাজনীতিবিদকে লক্ষ্য করে ২০০২ সালে দু’টি ‘ক্রিম পাই’ ছুঁড়ে মারা হয়েছিল, যেগুলোতে মূত্র মাখানো ছিল৷ ডানপন্থি রাজনীতিবদ পিম ফর্টুন তখন অভিবাসন বিরোধী আন্দোলনের নের্তৃত্ব দিচ্ছিলেন৷ সেই ঘটনার কয়েকসপ্তাহ পর এক প্রাণী অধিকার প্রচারক তাঁকে হত্যা করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হামলার শিকার গ্যুটেনব্যার্গ
ইন্টারনেটে স্বাধীনতা নিয়ে বার্লিনের এক বারে এক সহকর্মীর সঙ্গে আলোচনা করছিলেন সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী কার্ল-টেয়োডোর সু গ্যুটেনব্যার্গ৷ হঠাৎ সেখানে হাজির হন ইন্টারনেটে পরিচিত ‘অ্যানিনিমাসের’ মাস্ক পরা এক ব্যক্তি, মুহূর্তের মধ্যে গ্যুটেনব্যার্গের দিকে ছুঁড়ে মারেন একটা ‘ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক’৷ ২০১২ সালের সেই ঘটনা অবশ্য হালকাভাবেই নিয়েছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘সিলি স্ট্যান্ট’
২০০২ সালে লন্ডনে কৃষকদের ইউনিয়নের এক সম্মেলন চলাকালে ব্রিটেনের কৃষিমন্ত্রী নিক ব্রাউনের উদ্দেশ্যে চকলেট ছুঁড়ে মারেন এক প্রতিবাদকারী৷ এই রাজনীতিবদও পরবর্তীতে বিষয়টিকে ‘সিলি স্ট্যান্ট’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
6 ছবি1 | 6
রক্ষা করতে চায় ঐতিহ্যগত পরিবার
দলটি জার্মানির ঐতিহ্যগত একক পরিবার প্রথাকে সংরক্ষণ করতে চায়৷ তারা গর্ভপাত বিরোধী৷ বিকল্প জীবনধারা চায় না তারা৷ পরিবার প্রথাকে ধরে রাখতে তারা নানা ধরনের অর্থনৈতিক প্রণোদনা দেয়ার পক্ষে৷
নেতৃত্বের লড়াই
নতুন এই দলে নেতৃত্ব নিয়ে সংঘাতও রয়েছে৷ মূল প্রতিষ্ঠাতারা আরেকটু উদার দল চেয়েছিলেন৷ কিন্তু তারা হয় দলের ভেতরেই কোণঠাসা হয়ে গেছেন বা দল ছেড়েছেন৷ এই পরিবর্তনে ২০১৫ সালের ৪ জুলাই'র কনভেনশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে৷ ওই সময় ফ্রাউকে পেট্রি, ইয়র্গ ময়টেন যৌথভাবে দলের মুখপাত্র হন৷ দলে কিছুটা উদার ও ডানপন্থিদের মধ্যকার এই লড়াই এখনো চলমান রয়েছে৷
পেগিডার সঙ্গে অস্বস্তিকর সম্পর্ক
মানুষ অনেক সময় ‘জার্মানির ইসলাম ও অভিবাসীবিরোধী গোষ্ঠী পেগিডা' আন্দোলনের সঙ্গে তাদেরকে মিলিয়ে ফেলেন৷ পূর্বাঞ্চলীয় শহর ড্রেসডেনে তারা নিয়মিত বিক্ষোভ করে থাকে৷ পেগিডা আন্দোলন কোনো দল নয়৷ এটা একটা নাগরিক উদ্যোগ৷ ২০১৬ সালে এএফডি এই আন্দোলনে না জড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেও পরে তারা সেখানে স্থির থাকেনি৷ সম্প্রতি তারা যৌথ কর্মসূচিও দিয়েছে৷
সংবাদ মাধ্যমের প্রত ‘বৈরী'
সংবাদ মাধ্যমের প্রতি তাদের আচরণ অনেকটা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বা বেক্সিট নেতা নাইজেল ফারাজের মতো৷ তথ্যের জন্য কেউ তাদের দপ্তরে ফোন করলে প্রায়ই পূর্বধারণকৃত ‘পরে ফোন করুন' বাক্যটি শুনিয়ে দেয়া হয়৷