জার্মানিতে আগাম নির্বাচন: কেমন হবে সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা?
১৫ নভেম্বর ২০২৪
মার্কিন নির্বাচনে ডনাল্ড ট্রাম্পের জয় ও আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি জার্মানিতে আগাম নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হওয়ার পর থেকেই দলীয় প্রচারে সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা কেমন হতে পারে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির ঐতিহ্যবাহী দলগুলোর নেতারা স্পষ্টতই ডানপন্থি দলগুলোর উত্থান নিয়ে উদ্বিগ্ন৷ জার্মানির উগ্র ডানপন্থি দল অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচলান্ড (এএফডি) সম্প্রতি টুরিঙ্গিয়া এবং স্যাক্সনির রাজ্য নির্বাচনে ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে৷ দলটি টিকটকের মাধ্যমে প্রথমবার ভোটার হওয়াদের আকৃষ্ট করতে পেরেছিল, যা তাদের নির্বাচনে বেশ বড় প্রভাব রেখেছে৷
অস্ট্রিয়ার ইন্সব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ ও মিডিয়া আইন বিশেষজ্ঞ ম্যাথিয়াস কেটম্যান বলেন, জনমত তৈরি ও গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় সামাজিক মাধ্যম কী ধরণের ভূমিকা রাখবে তা নির্ধারণ করা অসম্ভব৷
তবে, স্পষ্টত আরও বেশিসংখ্যক মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছেন এবং তাদের মধ্যে মেরুকরণের একটি সাধারণ প্রবণতাও রয়েছে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ডানপন্থি ও বামপন্থি দলগুলো সামাজিক মাধ্যমে অনেক ভালো কাজ করে, কারণ, তাদের কাছে বলার জন্য সহজ গল্প থাকে, যা এসকল মাধ্যমের অ্যালগরিদমের সাথে মিলে যাওয়ার প্রবণতাও বাড়ায়৷''
পর্যবেক্ষকরা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ও সামাজিক মাধ্যম এক্স-এর সিইও ইলন মাস্কের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সম্পর্কেও সতর্ক রয়েছেন৷ বিশেষত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় সহযোগী ছিলেন ইলন মাস্ক৷ ৬ নভেম্বর জার্মানির ক্ষমতাসীন জোট সরকারের পতনের পর ইলন মাস্ক বারবার জার্মানির মধ্য-বাম নেতাদের ‘বোকা' বলে সম্বোধন করেছেন৷
জার্মানিতে আগাম নির্বাচন?
01:01
সময় লাগতে পারে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে
জার্মানিতে আসন্ন ফেডারেল নির্বাচনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কেটম্যান বলেছেন, বিদেশি স্টেকহোল্ডাররা মিথ্যা তথ্য ব্যবহার করে, যেমন বট ফার্ম, টেলিগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো বার্তা প্রেরণের অ্যাপগুলো ব্যবহার করে প্রচারণায় প্রভাব ফেলতে পারে৷ জার্মানির উগ্র ডানপন্থি এএফডি ও বিএসডাব্লিউ রাশিয়াপন্থি রক্ষণশীল, অভিবাসনবিরোধী, জলবায়ু সুরক্ষা বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে৷
তিনি বলেন ‘‘উদাহরণস্বরূপ আমরা জানি যে রাশিয়া জার্মানির কিছু রাজনৈতিক দলকে অন্যদের চেয়ে বেশি পছন্দ করে৷ তারা জার্মান সমাজের মধ্যে মেরুকরণের প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে চায় এবং এটি এমন একটি হুমকি যা সম্পর্কে আমাদের বুন্ডেসটাগ (সংসদ) নির্বাচনের আগে গভীরভাবে সচেতন হতে হবে৷''
সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইতিমধ্যে ডিজিটাল পরিষেবা আইন (ডিএসএ) সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ডিজিটাল মার্কেট প্লেসের জন্য একটি বিস্তৃত নিয়মনীতি চালু করেছে৷ যার অন্যতম উদ্দেশ্য অনলাইনে ভুল তথ্যের অপপ্রচার ও বেআইনি কার্যক্রম ঠেকানো৷
জুলাইয়ে জারি করা প্রাথমিক অনুসন্ধানে ইইউ নিয়ন্ত্রকরা এক্স ডিএসএ লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ করেন৷
ম্যাথিয়াস কেটম্যান মনে করেন এ মুহূর্তে আইনটি বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন হবে এবং ফেব্রুয়ারিতে জার্মান ফেডারেল নির্বাচনের সময়ে তা কার্যকর হবে না৷ তিনি বলেন, ‘‘এক্স-এর মতো কিছু প্ল্যাটফর্ম ইইউ নিয়মের সঙ্গে কোনোরকম সহযোগিতা করছে বলে মনে হচ্ছে না৷ তাই এই প্ল্যাটফর্মটিকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং ইইউ নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্য করা বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে৷''
মার্কিন নীতি নির্ধারণে ইলন মাস্কের ভূমিকা বাড়তে থাকায় ভবিষ্যতে আরও কঠিন হতে পারে৷ এছাড়াও মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত জেডি ভ্যান্স ইইউ এক্সকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর জন্য সমর্থন প্রত্যাহার করবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন৷
যেহেতু আরও বেশিসংখ্যক ভোটার, বিশেষত তরুণ ভোটাররা সামাজিক মাধ্যমে রাজনীতি ও বিশ্ব বিষয়ক বিষয়ে নিজেদেরকে যুক্ত করছেন, তাই পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন ম্যাথিয়াস কেটম্যান৷
হেলেন ভিটেল/এসএইচ
জার্মান সংবিধানের ৭৫ বছর
১৯৪৯ সালে এই সংবিধান গ্রহণ করে পশ্চিম জার্মানি। এরপর এটি বহুবার সংশোধন করা হয়েছে, জার্মান সামরিক বাহিনী বুন্ডেসভেয়ার প্রতিষ্ঠার মতো কিছু বিতর্কিত সংযোজনও করা হয়েছে সংবিধানে।
ছবি: Maja Hitij/Getty Images
'মানুষের মর্যাদা অলঙ্ঘনীয়'
আনুষ্ঠানিকভাবে জার্মান সংবিধান পরিচিত বেসিক ল, বা মৌলিক আইন নামে। এর প্রথম অনুচ্ছেদ শুরু হয়েছে এই বাক্য দিয়ে - 'মানুষের মর্যাদা অলঙ্ঘনীয়'। নাৎসি জার্মানির নজিরবিহীন অপরাধের প্রতিক্রিয়া হিসাবে এই বাক্যটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং হলোকাস্টের জন্য দায়ী ছিল নাৎসি জার্মানি। জার্মানি এবং ইউরোপ জুড়ে ৬০ লাখ ইহুদি ছাড়াও আরো অনেককে হত্যা করেছিল নাৎসি বাহিনী।
ছবি: Maja Hitij/Getty Images
১৯৪৯: মৌলিক আইন গৃহীত হয়
মৌলিক আইন হিসাবে জার্মান সংবিধান গ্রহণ করা হয় ১৯৪৯ সালের ২৩ মে। তখন অবশ্য এটি শুধুমাত্র পশ্চিম জার্মানির জন্যই প্রযোজ্য ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ী পশ্চিমা শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স পশ্চিম জার্মানির তিনটি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে একই বছরের ৭ অক্টোবর জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Ohde
১৯৫৬: জার্মান সামরিক বাহিনী
মৌলিক আইন কয়েক দশকে অন্তত ৭০ বার সংশোধন করা হয়েছে। সামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা ছিল এসব পরিবর্তনের লক্ষ্য। এসব পরিবর্তনের মধ্যে বিশেষভাবে বিতর্কিত ছিল পুনঃসামরিকীকরণ। পশ্চিম জার্মানি ১৯৫৫ সালে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দেয়ার পর জার্মান সশস্ত্র বাহিনী বা বুন্ডেসভেয়ার প্রতিষ্ঠা করে। বাহিনীকে সাংবিধানিক কাঠামো দেয়ার জন্য ১৯৫৬ সালে সংবিধান সংশোধন করা হয়।
ছবি: Nana Ehlers/Bundeswehr/dpa/picture alliance
১৯৬৮: জরুরি অবস্থায় মৌলিক অধিকার সীমিত করা
১৯৬৮ সালে ‘জরুরি অবস্থা‘ সংশোধনীরও সুদূরপ্রসারী ফলাফল ছিল। এই সংশোধনের উদ্দেশ্য ছিল সংকটময় পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিদ্রোহ এবং যুদ্ধকালীন সময়ে রাষ্ট্রের কাজ করার ক্ষমতা নিশ্চিত করা। এই সংশোধনীর ফলে বুন্ডেসভেয়ারকে দেশের মধ্যে মোতায়েন, ব্যক্তিগত যোগাযোগে গোপন নজরদারি এবং জরুরি পরিস্থিতিতে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সীমাবদ্ধ করারও সুযোগ তৈরি হয়।
ছবি: Monika Skolimowska/dpa/picture alliance
১৯৯১: একত্রীকরণের পরও একই সংবিধান
মৌলিক আইন যখন প্রণয়ন করা হয় তখন সেটিকে সাময়িক হিসাবেই বিবেচনা করা হয়েছিল। দুই জার্মানি এক হলে নতুন এবং স্থায়ী সংবিধান তৈরি করা হবে, এমনটাই ছিল চিন্তা। কিন্তু দুই জার্মানিকে আলাদা করা বার্লিন দেয়ালের পতন এবং ১৯৯১ সালে জার্মানির পুনরেকত্রীকরণের পরও নতুন সংবিধান প্রণয়ন হয়নি, বরং মৌলিক আইনকেই পুরো জার্মানির জন্য প্রযোজ্য হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
পুনরেকত্রীকরণের তিন বছর পর ১৯৯৩ সালে জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদনের সংখ্যা ব্যাপক সংখ্যায় বৃদ্ধি পায়। এর ফলে মৌলিক আইনে শরণার্থীদের আশ্রয়ের অধিকারটিকে সীমাবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই সংস্কারের ফলে জার্মানির নাগরিকত্ব না থাকা ব্যক্তিদের তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর সুযোগ তৈরি হয়। তবে এর আগে সেই দেশকে নিরাপদ দেশের তালিকায় তালিকাবদ্ধ করতে হয়। তালিকায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন জর্জিয়া।
ছবি: Lisi Niesner/REUTERS
২০০৯: ঋণ সীমিতকরণ
সরকারি ঋণ সীমিত রাখার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে মৌলিক আইনে ‘ডেট ব্রেক‘ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর্থিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে প্রবর্তিত এই ব্যবস্থাটি আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ঋণ গ্রহণে সীমা নির্ধারণ করে দেয়। তবে অপ্রত্যাশিত সংকটের ক্ষেত্রে ঋণ সীমা তুলে নেওয়ার সুযোগও রয়েছে, যেমনটি কোভিড মহামারি চলাকালীন করা হয়েছিল। অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে অনেকে ২০২৪ সালেও ঋণ সীমা শিথিল করার আহ্বান জানাচ্ছেন।