বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গাড়ি নির্মাতা জার্মানির ফল্কসভাগেন৷ গতবছর কোম্পানিটি ৯০ লাখের বেশি গাড়ি বিক্রি করেছে৷ তবে ইলেকট্রিক গাড়ি খাতে কোম্পানিটি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে৷
দাম কম হওয়ায় চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারছে না ফল্কসভাগেনের মতো জার্মান গাড়ি প্রস্তুতকারক ব্র্যান্ডগুলোছবি: Jens Schlueter/AFP via Getty Images
বিজ্ঞাপন
এখনকার গাড়ি আর ১০ বছর আগের গাড়ির মতো নয়৷ দেখতে সুন্দর লাগার বিষয়টি এখন আর আগের মতো গুরুত্বপূর্ণ নয়৷
কম্বাশন ইঞ্জিনের পরিবর্তে ইলেকট্রিক মোটর ব্যবহারও এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয়৷
এখন যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে: ব্যাটারিটা কত ভালো?
সমস্যাটা সেখানেই, বলছেন গাড়িশিল্পের বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক পেড্রো পাচেকো৷ তিনি বলেন, ‘‘বিশ্বের ব্যাটারি বাজারের অনেকটা চীনের ব্যাটারি নির্মাতাদের দখলে৷ বিশেষ করে গাড়ি শিল্পের ব্যাটারির ক্ষেত্রে কথাটা প্রযোজ্য৷ ইলেকট্রিক গাড়ি ব্যবসায় সফল হওয়ার সবচেয়ে বড় উপায় দাম কমানো৷ এবং সেটা নিশ্চিত করতে হবে ব্যাটারির আকার ছোট করে এবং চার্জ থাকার মেয়াদ বাড়িয়ে৷''
ফল্কসভাগেনের একটি ইলেকট্রিক গাড়ি অ্যাওয়ার্ড জিতেছে৷ আইডি.৭ ব্যাটারি একবার চার্জ দেওয়ার পর ৭০০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলতে পারে৷ কিন্তু ইউরোপে এই গাড়ির দাম শুরু হয় ৫৫ হাজার ইউরো থেকে৷
চীনা নির্মাতারা শিগগিরই আরও কম দামি গাড়ি নিয়ে ইউরোপের বাজারে ঢুকতে পারে৷ আর এদিকে, দাম বেশি হওয়ায় চীনের বাজারে ঢুকতে সমস্যায় পড়ছে ফল্কসভাগেন৷
প্রযুক্তিখাতেও অনেক নতুন কিছু হচ্ছে: গাড়িগুলো চলন্ত কম্পিউটার হয়ে উঠছে৷ ভবিষ্যৎ হচ্ছে এসডিভি, যার অর্থ ‘সফটওয়্যার ডিফাইন্ড ভেহিক্যাল'৷ এটি গাড়ির ইলেকট্রনিক আর্কিটেকচারের উপর ফোকাস করে৷
পাচেকো বলেন, ‘‘ইদানিং সফটওয়্যারও বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, এবং ভবিষ্যতে এটা আরও বাড়বে৷ মোবাইল ফোন থেকে স্মার্টফোনে উত্তরণের সঙ্গে এর তুলনা করা যেতে পারে৷ মোবাইল ফোন খাতের চেয়ে গাড়ি শিল্পখাতে পরিবর্তন আসতে একটু বেশি সময় লাগে৷ তবে শেষ পর্যন্ত ফলাফলটা একই হবে বলা যায়৷''
এর অর্থ, কম্বাশন ইঞ্জিন নির্মাতাদের এখন আইটি কোম্পানি হয়ে উঠতে হচ্ছে৷ সে কারণে ফল্কসভাগেন একটি সফটওয়্যার সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠা করেছে- নাম ‘কারিয়াড'৷ এর পেছনে অনেক অর্থ খরচ করা হয়েছে, যদিও এখনও তেমন কাজে আসেনি৷
ইলেক্ট্রিক গাড়ির বাজার দখলের লড়াইয়ে ফল্কসভাগেন
04:33
This browser does not support the video element.
গাড়ি শিল্পের সহায়তায় গড়ে ওঠা ইনস্টিটিউটও বিষয়টি এভাবে দেখছে৷ সেন্টার ফর অটোমোটিভ রিসার্চের বেয়াট্রিক্স কাইম বলেন, ‘‘এটা পরিষ্কার যে ফল্কসভাগেন একটা গাড়ি কোম্পানি, আইটি কোম্পানি নয়৷ আর এটাই একটা দুর্বলতা৷ এছাড়া দক্ষ জনশক্তিরও অভাব আছে৷ তবে ভবিষ্যৎ যে এসডিভি, সফটওয়্যার ডিফাইন্ড ভেহিক্যাল, সেটা নিশ্চিত৷''
ফল্কসভাগেন তার সফটওয়্যারের জন্য পার্টনার খুঁজে নিয়েছে: যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের জন্য মার্কিন গাড়িনির্মাতা রিভিয়ান, আর চীনা বাজারের জন্য শাওপাং৷ তবে এতে ঝুঁকি দেখছেন বিশ্লেষকেরা৷
পাচেকো বলেন, ‘‘বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি গাড়িনির্মাতার অর্ধেকের বেশি চীনা ‘অরিজিনাল ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স' বা ওইএম-এর কাছ থেকে ভেহিক্যাল ইলেকট্রনিক প্ল্যাটফর্ম নিয়েছে৷ কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে সমস্যা হচ্ছে, হয় আপনাকে চীনা ওইএম এর চেয়ে ভালো প্ল্যাটফর্ম বানাতে হবে, নয়ত তাদের প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে৷''
অর্থাৎ ভবিষ্যতে একটি বড় ঝুঁকি তৈরি হতে পারে৷
তবে ফল্কসভাগেন এখন মারাত্মক সংকটে আছে৷ তারা পাঁচ বিলিয়ন ইউরো বাঁচাতে চায়৷
ইউরোপের গাড়িনির্মাতারা কি পরিবর্তনের সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারবে? নাকি তাদের ভাগ্য কোডাক ও নোকিয়ার মতো হবে? হয়ত তেমনটা হবে না, বলছেন পর্যবেক্ষকেরা৷ তবে বিপদ সম্পর্কে তাদের সচেতন হতে হবে৷
সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ হবে, সমস্যাটি পুরোপুরি স্বীকার করে নেওয়া৷
এই সব মডেলের গাড়ি দেখে গাড়ি প্রেমিকদের চোখে আজও জল আসে৷ ফল্কসভাগেন থেকে বিএমডাব্লিউ, ওপেল থেকে মার্সিডিজ বেঞ্জ অবধি জার্মান গাড়ি নির্মাতারা নানা ‘কাল্ট মডেল’ তৈরি করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Kneffel
ফল্কসভাগেন বিটল (১৯৩৮)
এক কথায় ‘ওল্ড ফেইথফুল’৷ সর্বসাকুল্যে দু’কোটি দশ লাখের বেশি বিটল তৈরি হয়েছে৷ ফল্কসভাগেন বিটল সম্ভবত বিশ্বের প্রখ্যাততম মোটরগাড়ি৷ ১৯৩৮ থেকে ২০০৩ সাল অবধি বিটল-এর ডিজাইন বিশেষ বদলায়নি৷ ‘হার্বি’ ফিল্মটার কথা মনে করুন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফল্কসভাগেন টি-ওয়ান (১৯৫০)
...বলতে বোঝায় ফল্কসভাগেন ক্যাম্পার ভ্যান, যা হিপি আন্দোলনের সময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল৷ জার্মানরা এর নাম দিয়েছিলেন ‘বুলি’৷ সে-যাবৎ এক কোটির বেশি ফল্কসভাগেন বাস বিক্রি হয়েছে, যার মধ্যে টি-ওয়ান মডেলের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৮ লাখ৷
ছবি: DW/M. Reitz
মেসারস্মিট কেবিন স্কুটার (১৯৫৩)
মেসারস্মিট যে আদতে এয়ারোপ্লেন তৈরি করত, তিন চাকার এই এয়ায়োডাইনামিক গাড়িটির চেহারা দেখলেই তা বোঝা যায়৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিমান তৈরি বন্ধ হয়ে যায়, কাজেই মেসারস্মিট কিছুদিন ইঞ্জিনিয়ার ফ্রিটৎস ফেন্ড-এর সঙ্গে ‘ফ্লিটৎসার’ গাড়ির মডেলটি নিয়ে কাজ করে৷ তবে ১৯৫৬ সালের মধ্যেই মেসারস্মিট আবার বিমান উৎপাদনে ফেরে৷
ছবি: picture alliance/dpa/H. Galuschka
মার্সিডিজ ৩০০ এসএল (১৯৫৪)
গাড়িটার ডাকনাম হয়েছিল ‘গালউইং’ বা ‘গাঙচিলের পাখা’, কারণ দরজাগুলো ঠিক সেভাবেই ওপরের দিকে খুলত৷ ৩০০ এসএল সিলভার অ্যারো রেসিং কার-গুলো থেকেই মার্সিডিজ বেঞ্জ আবার মোটর রেসিং-এ ফেরে৷ লে মান্সের ২৪ ঘণ্টার মোটর দৌড় আর ক্যারেরা প্যানঅ্যামেরিকানা রেসিং ইভেন্টে জেতার পর ৩০০ এসএল গাড়ির একটি রাস্তায় চলা ও চালানোর মতো মডেল বার করা হয়৷
ছবি: Daimler AG
বিএমডাব্লিউ ইসেটা (১৯৫৫)
১৯৫৫ থেকে ১৯৬২ সাল অবধি ভালোই রোজগার করেছে বিএমডাব্লিউ এই ‘বাবল কার’ বা ‘বুদবুদ গাড়ি’-টি তৈরি করে৷ সস্তার কিন্তু কাজের এই মিনিগাড়িটিতে একটি মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন লাগানো ছিল৷ খুলতে হতো সামনে, ঠিক একটা ফ্রিজিডেয়ারের মতো৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Kneffel
পোর্শে নাইন-ইলেভেন (১৯৬৩)
ভাবলেই আশ্চর্য লাগে, পোর্শে ৯১১ স্পোর্টিং মডেলটি চলে আসছে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে! মোটরগাড়ির ইতিহাসে খুব কম মডেলই এতদিন ধরে চলে৷ তার উঁচু করা হেডলাইট আর পিছনদিকে নীচু বুট দেখলেই নাইন ইলেভেনকে চেনা যায়৷
ছবি: picture-alliance//HIP
মার্সিডিজ বেঞ্জ ৬০০ (১৯৬৪)
টেলিফোন, এয়ার কন্ডিশনিং আর ফ্রিজ লাগানো এই জার্মান লাক্সারি সেডানটি সত্তর আর আশির দশকে পোপ থেকে শুরু করে জন লেনন অবধি সেলিব্রিটিদের খুব প্রিয় ছিল৷ এমনকি ১৯৫৫ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ যখন রাষ্ট্রীয় সফরে জার্মানিতে আসেন, তখন জার্মান সরকার মাননীয় অতিথির জন্য একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ ৬০০ ভাড়া করেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ট্রাবান্ট ৬০১ (১৯৬৪)
ফল্কসভাগেন বিটল পশ্চিম জার্মানিতে যা ছিল, পূর্ব জার্মানিতে ট্রাবান্ট ৬০১ ছিল ঠিক তাই৷ প্লাস্টিকের বডি আর টু-স্ট্রোক ইঞ্জিন সংযুক্ত এই ‘ট্রাবি’ ছিল এক হিসেবে পূর্ব জার্মানির প্রতীক৷ আজও প্রায় ৩৩,০০০ ‘ট্রাবি’ জার্মানির পথেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷
ছবি: Imago/Sven Simon
ভার্টবুর্গ ৩৫৩ (১৯৬৬)
আইসেনাখ শহরের কাছে ভার্টবুর্গ দুর্গ, তারই নামে নাম রাখা হয়েছিল পূর্ব জার্মানির এই দ্বিতীয় আইকনিক গাড়িটির৷ তৈরি হতো প্রধানত রপ্তানির জন্য, যেমন হাঙ্গেরি অথবা ব্রিটেনে৷ তবে পশ্চিম জার্মানিতে ভার্টবুর্গ গাড়ির বিশেষ চাহিদা ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/ZB/J. Wolf
ওপেল মান্টা (১৯৭০)
সৃষ্টি হয়েছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য একটি স্পোর্টস মডেল হিসেবে – পরে সেটাই জার্মানির ‘ইয়ং ম্যান’-দের কাছে অভীপ্স বস্তু হয়ে দাঁড়ায়৷ মান্টা চালকদের নিয়ে জার্মানিতে অসংখ্য রসিকতা আছে: বিশেষ করে মান্টা চালকদের বুদ্ধি – অথবা তার অভাব নিয়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফল্কসভাগেন গল্ফ (১৯৭৪)
১৯৭৪ সালে ফল্কসভাগেন কোম্পানি তাদের প্রথম গল্ফ মডেল বার করে – সুবিখ্যাত বিটল গাড়ির উত্তরসূরি হিসেবে৷ কমপ্যাক্ট হলেও, গল্ফ ছিল বেশ ‘স্পোর্টি’ আর তেলও খেতো কম – যা সত্তরের দশকের ‘অয়েল ক্রাইসিসে’ খুবই কাজে লেগেছে৷