জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব জার্মানিতেও টের পাওয়া যাচ্ছে৷ বছরের পর বছর গ্রীষ্মের প্রখর রোদ ও অনাবৃষ্টির ফলে গাছপালা, বনজঙ্গলের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়ছে৷ নতুন এই চ্যালেঞ্জের মুখে বনবিভাগ দিশাহারা হয়ে পড়ছে৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির মধ্যভাগে মেলসুঙেনের অরণ্য এলাকার একটা অংশ প্রবল ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, অনেক গাছপালা উপড়ে গেছে৷ বার্ক বিটল পোকা বাকি গাছগুলি নষ্ট করে দিয়েছে৷ অথচ কয়েক মাস আগে পর্যন্ত সেখানে ঘন জঙ্গল ছিল৷ বনবিভাগের কর্মকর্তা পেট্রা ভেস্টফাল বলেন, ‘‘কয়েক দশক ধরে দেখাশোনার পর কোনো জঙ্গল কার্যত উধাও হয়ে গেলে, পোকায় গাছ খেয়ে নিলে বন বিভাগের কর্মী হিসেবে খুবই কষ্ট হয়৷’’
হেসে রাজ্যের সেই অরণ্যে প্রায় তিন লাখ গাছ নষ্ট হয়ে গেছে৷ সেগুলির মধ্যে বেশ কিছু প্রাচীন ও বিশাল গাছও ছিল৷ অন্যান্য জায়গায়ও এমন ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যাচ্ছে৷
শুধু ২০১৮ সালে জার্মানিতে প্রায় ছয় কোটি গাছ ঝড়ঝঞ্জা অথবা পোকার উপদ্রবে নষ্ট হয়ে গেছে৷ বছরের পর বছর ধরে এই সমস্যা দেখা যাচ্ছে৷ শুধু আবহাওয়ার অবস্থা অনুযায়ী কিছু পার্থক্য টের পাওয়া গেছে৷
জার্মানির বন-জঙ্গল
জার্মানরা বন-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন৷ এভাবে অবসর সময় কাটাতে আর হাঁটতেও ভালোবাসেন তাঁরা৷ চলুন সে রকমই জার্মানির কিছু বনানির সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক৷
ছবি: picture-alliance/Thomas Muncke
জাতীয় পার্ক ইয়াসমুন্ড
ইয়াসমুন্ডের এই পার্কটি জার্মানির জাতীয় পার্কগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ছোট পার্ক৷ বিখ্যাত ব়্যুগেন দ্বীপের একেবারে উত্তরে অবস্থিত এই পার্কের সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে, করে মুগ্ধ৷ ইউনেস্কো ২০১১ সালে ইয়াসমুন্ড পার্কটিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়৷
ছবি: Scoopshot/ac-images
এলবে নদীর নিসর্গ
প্রকৃতি সৃষ্ট নিসর্গের মধ্যে অন্যতম নদী পরিবেষ্টিত চরগুলি৷ নিয়মিত বন্যা হওয়ার কারণে এই সব চরে গাছপালা এবং পশুপাখিরা আনন্দে বেঁচে থাকে৷ যেমনটা এখানে, ব্রান্ডেনবুর্গের এলবে নদীতে৷ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য এলবে নদীর এই চরটিকে ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যর অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZB
হারৎস
জার্মানির মধ্যভাগে অবস্থিত হারৎসের পাহাড়ি অঞ্চল শুধু জার্মানির সবচেয়ে বড় বনভূমি নয়, জার্মানির সবচেয়ে জনপ্রিয় বনাঞ্চলও বটে৷ ১৮২৪ সালে অন্যতম জার্মান লেখক হাইনরিশ হাইনে তাঁর ভ্রমণ কাহিনিতে এই অঞ্চলকে তুলে ধরেন৷ যাঁরা হাঁটতে পছন্দ করেন তাঁদের কাছে জায়গাটি খুবই প্রিয়৷
ছবি: picture-alliance/ZB
হাইনিশ জাতীয় পার্ক
জার্মানির ট্যুরিঙ্গেন রাজ্যে রয়েছে ‘বুখেন’ বা বীচ গাছে ঘন জঙ্গল৷ এই বনের কয়েকটা গাছ আবার গত ৮০০ বছর ধরে এইভাবে একেবারে সাড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ এর জন্যই ইউনেস্কো ২০১১ সালে এই বনভূমিকে বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ এখানে বনবিড়ালের মতো অনেক বিরল প্রাণীও দেখা যায়৷
ছবি: DW/C. Hoffmann
স্পেসার্ট
জার্মানির দক্ষিণে অবস্থিত বাভারিয়া এবং হেসেন রাজ্যের মাঝামাঝি একটি পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত এই বনটি৷ আগে স্পেসার্ট ছিল ধনী ও বিশপদের শিকার করার জায়গা৷ শুধু তাই নয়, ঊনিশ শতকে এই জঙ্গলেই আস্তানা গড়েছিল জার্মানির কুখ্যাত ডাকাতরা৷ ১৮২৭ সাল থেকে ‘‘দাস ভির্টহাউস ইম স্পেসার্ট’’ নামে পরিচিতি লাভ করে এই ঘন বনাঞ্চল৷
ছবি: picture-alliance/Thomas Muncke
ব্ল্যাক ফরেস্ট
ব্ল্যাক ফরেস্ট বা কৃষ্ণ অরণ্য নিয়ে নানা রকম ভূতের গল্প প্রচলিত আছে জার্মানিতে৷ আছে এই জঙ্গলের নামে একটি কেক-ও৷ সে জন্যই হয়ত এই কৃষ্ণ অরণ্যের জাতীয় পার্কের মর্যাদা পাওয়া উচিত বলে মনে করেন অনেকে৷ আবার অন্যদের আশঙ্কা, জাতীয় পার্ক হলে এখান থেকে আর ফল সংগ্রহ বা গাছ কাটা যাবে না – জার্মানিতে পরিবেশ রক্ষা সত্যিই যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়!
ছবি: picture-alliance/Ronald Wittek
বাভারিয়ার জাতীয় পার্ক
রাখেল লেক বাভারিয়ার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ হ্রদের মধ্যে একটি৷ লেকটি ঘিরে প্রায় ১০৭০ মিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত এই বন, যেখানে গত কয়েক দশকে একটি গাছও কাটা হয়নি৷ খুবই নিরিবিলি ও শান্ত পরিবেশ এখানে৷ তাই হাঁটার জন্যও খুব উপযোগী এই অঞ্চল৷ ১৯৭০ সালে এই পার্কটিকে জার্মানির প্রথম জাতীয় পার্ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জাতীয় পার্ক ব্যার্শটেসগাডেন
এটা আলপস পর্বতমালায় অবস্থিত জার্মানির একমাত্র জাতীয় পার্ক৷ পার্কটি উচ্চ পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থানের কারণে পর্যটকরা এখানে এলে বিরল প্রাণীর দেখা পান৷ তাই তো পক্ষীপ্রেমী আর বন্যপ্রাণী গবেষকদের জন্য এটা দারুণ একটা জায়গা৷
ছবি: picture-alliance/Thomas Muncke
8 ছবি1 | 8
এই মুহূর্তে বার্ক বিটল পোকা পেট্রা ভেস্টফালের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ৷ মাত্র দুই থেকে চার মিলিমিটার দীর্ঘ এই পোকা জঙ্গলে ঝড়ে বিধ্বস্ত মৃত গাছ খেয়ে থাকে৷ তবে বিশেষ করে খরার কারণে মুমূর্ষু গাছও এই পোকার হামলার শিকার হয়৷
জার্মানিতে ২০১৮ সালের গ্রীষ্মকাল ছিল অস্বাভাবিক রকম গরম ও শুষ্ক৷ সে বছর শীতে বৃষ্টি কম হওয়ায় মাটি শুকিয়ে যায়৷ সেই ধাক্কা এখনো সামলানো সম্ভব হয় নি৷ অনেক এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বহু বছর ধরে নেমে চলেছে৷
চেপটা শিকড়ের কারণে স্প্রুস গাছ সাধারণত ভূগর্ভস্থ পানির নাগাল পায় না৷ সে কারণে খরা দেখা দিলে এমন গাছ চাপের মুখে পড়ে৷ তখন বার্ক বিটলের মতো পোকা প্রতিরোধের ক্ষমতাও কমে যায়৷ পেট্রা ভেস্টফাল বলেন, ‘‘বিটল বাইরে থেকে গাছের বাকল ভেদ করে ঢুকে গেছে৷ ভেতরে প্রবেশ করে এই পোকা কাঠ চিবিয়ে উপর ও নীচের দিকে সুড়ঙ্গ খোঁড়ে৷ মাদি পোকাই এমন সুড়ঙ্গ তৈরি করে পাশের অংশে ডিম পাড়ে৷ জন্মের পর গুটিপোকা সেই সুড়ঙ্গের নরম কাঠ খেয়ে নেয়৷ এই পোকা গাছের পুষ্টির জোগান নষ্ট করে দেয়৷’’
ডিম থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠতে বিটলের মাত্র চার থেকে ছয় সপ্তাহ সময় লাগে৷ ডিম ফুটে গুটিপোকা বেরিয়ে দ্রুত পূর্ণতা পায়৷ একটি মাদি পোকা পঞ্চাশটির মতো সন্তান জন্ম দেয়৷ তার মধ্যে ২৫টি মাদি হলে এবং সেগুলি বংশবৃদ্ধি চালিয়ে গেলে তৃতীয় প্রজন্মে মোট ৩১ হাজার ২৫০টি পোকা সৃষ্টি হতে পারে৷ একশো পোকাই একটি স্প্রুস গাছ মেরে ফেলতে পারে৷
পোকার হামলা হলে একটি অ্যাপের মাধ্যমে প্রত্যেকটি গাছ চিহ্নিত ও নথিভুক্ত করা হয়৷ অনেক কচি গাছ কয়েক দশক ধরে বেড়ে উঠতে পারতো৷ কিন্তু বাধ্য হয়ে সেগুলি কেটে ফেলতে হয়৷ বার্ক বিটলের হামলার পর গাছ কাটার হার প্রায় চার গুণ বেড়ে গেছে৷