বাজেট নিয়ে বড় ধরনের জটিলতায় পড়েছে জার্মানির সরকার৷ মহামারির তহবিলের অর্থ জলবায়ু খাতে ব্যয় করাকে আদালত অবৈধ ঘোষণার পর এবার চলতি বছরের বাকি সময়ের বাজেট ব্যয় স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিলো অর্থ মন্ত্রণালয়৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়ান লিন্ডনার সোমবার সন্ধ্যায় সরকারের নতুন নীতি ঘোষণা করেন৷ সে অনুযায়ী, ২০২৩ সালের বাকি সময়ে সরকারের প্রায় পুরো বাজেট ব্যয় স্থগিত করা হয়েছে৷ কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটের সার্বিক পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে এমন কঠোর সিদ্ধান্ত বলে জানান তিনি৷ প্রকৃতপক্ষে জার্মানির সর্বোচ্চ আদালতের নাটকীয় এক রায়ের প্রেক্ষিতে এমন পদক্ষেপ নিতে হলো সরকারকে৷
সংকটের শুরু যেখান থেকে
জার্মানির জোট সরকার কোভিড মোকাবিলায় বিপুল অর্থ বরাদ্দ করেছিল৷ সেখান থেকে খরচ না হওয়া ৬০ বিলিয়ন ইউরো তারাজলবায়ু খাতে ব্যয় করতে চেয়েছিল৷ বিশেষ করে বিদ্যুৎচালিত পরিবহণ ও ভবনগুলোকে জ্বালানি সাশ্রয়ী করতে এই অর্থ ব্যয়ের কথা ছিল৷ কিন্তু আদালত এই সিদ্ধান্ত আটকে দিয়েছে৷ তাই এই ধরনের তহবিলের ক্ষেত্রে ঋণের সাধারণ নিয়মই কার্যকর হবে৷ ১৫ নভেম্বরের দেয়া রায়ে আদালত বলেছে, কোনো একটি বছরের জন্য বরাদ্দ অর্থ সরকার পরবর্তী বছরে অন্য খাতে ব্যয় করতে পারে না৷ আদালতের এই রায় চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস ও তার সরকারের জন্য বড় আঘাত বলে বিবেচনা করা হচ্ছে৷
জার্মানি থেকে মানুষদের ফেরত পাঠানো সহজ করবে যে আইন
03:19
২০০৮-০৯ সালে ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দার পর জার্মানির তৎকালীন চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল সতর্কতা হিসেবে ঋণ সীমার নিয়ম চালু করেন৷ সে অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট ঘাটতি বা নতুন ঋণের পরিমাণ জিডিপির দশমিক তিন-পাঁচ শতাংশের বেশি হতে পারবে না৷ কিন্তু কোভিড মহামারির সময় সংকটকালীন পরিস্থিতি দেখিয়ে এই নিয়মের ব্যতিক্রম করা হয়েছিল৷ জলবায়ু পরিবর্তনকে অনেকে সংকট হিসেবে বিবেচনা করলেও সরকারিভাবে তা ঘোষিত নয়৷
জোটে দ্বন্দ্ব
এই রায়ের ফলে রাজনৈতিকভাবেও সংকটে পড়েছে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এসপিডির নেতৃত্বাধীন জোট৷ তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সিডিইউ এর আবেদনের প্রেক্ষিতেই আদালত এই রায় দিয়েছে৷ নির্বাচনের দুই বছর আগে জোট সরকারের জন্য এটি বড় রাজনৈতিক পরাজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে৷
কীভাবে সরকার আগামী বছরের ব্যয় সামাল দিবে তা নিয়ে জোটের সদস্যদের মধ্যেও রয়েছে মতবিরোধ৷ এসপিডি চায় কর বাড়াতে৷ পাশাপাশি ২০২৪ সালকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ঋণসীমা বাড়ানোরও মত দিচ্ছেন দলটির কোনো কোনো নেতা৷
অন্যদিকে শরিক দল এফডিপি কর বৃদ্ধির বিপক্ষে৷ তারা বরং সরকারের বিভিন্ন খাতে বাজেট কমানোর পক্ষে৷ আর জোটের তৃতীয় সঙ্গী গ্রিন পার্টি সামাজিক ও জলবায়ু খাতের ব্যয় কমানোর ঘোরতর বিরোধী৷ তবে শেষ পর্যন্ত এফডিপি ও বিরোধী দল সিডিইউ-এর চাপে কর না বাড়িয়ে ব্যয় কমানোর দিকেই সরকারকে হাঁটতে হতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা৷ গ্রিন পার্টির মন্ত্রীদেরকে সেক্ষেত্রে দলটির নেতা-কর্মীদের জবাবদিহিতার মধ্যে পড়তে হবে, যা সরকারের জোটেও চিড় ধরাতে পারে৷
সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে জোটের সদস্যদের এই স্পষ্ট মতবিরোধ সত্ত্বেও তা থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে বলে পার্লামেন্টে আশা প্রকাশ করেছেন চ্যান্সেলর শলৎস৷ এমন বাস্তবতায় জনগণের কাছে সরকারের অনুমোদনের রেটিং তলানীতে এসে ঠেকেছে - নতুন নির্বাচনের ক্ষেত্রে যা জোটের তিন সদস্যের জন্য চিন্তার বিষয়৷
ইয়েন্স থুরাউ/এফএস
জার্মানি : ধনী দেশের গরিবেরা যেমন
করোনা মহামারির সময় ধনী আর গরিবের ব্যবধান বাড়তে না দেয়ার উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও জার্মানিতে এ ব্যবধান বেড়েছে৷ এ দেশের মানদণ্ডে গরিবদের আরো গরিব হওয়ার নমুনা দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Markus C. Hurek/dpa/picture alliance
ধনী দেশে পথের পাশে দরিদ্র মানুষ
বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ জার্মানি৷ এ দেশেও আছে গৃহহীন মানুষ৷ করোনা মহামারির সময় গৃহহীনের সংখ্যা বেড়েছে৷
ছবি: Rupert Oberhäuser/picture alliance
ব্যয় কমিয়ে বাঁচার চেষ্টা
করোনার পর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় জ্বালানি এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে৷ সন্তানের মুখে আহার তুলে দিতে জার্মানির অনেক মা এখন নিজে একবেলা না খেয়ে থাকেন বা খেলেও কম খান৷ অবসর ভাতায় চলতে পারেন না বলে অনেক প্রবীণ বোতল কুড়ান৷ তা বিক্রি করে সামান্য কিছু অর্থ আসে, তাতেই তারা খুশি!
ছবি: Rupert Oberhäuser/picture alliance
দারিদ্র্য বাড়ছে জার্মানিতে
জার্মানিতে দরিদ্রের সংখ্যা বাড়ছে- এ শুধু বিশ্লেষকদের অনুমান নয়, পারিট্যাটিশে ভলফারট্সফারবান্ড নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানও বলছে এ কথা৷ তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এ মুহূর্তে জার্মানির এক কোটি ৩৮ লাখের মতো মানুষ হয় দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করছেন, নয়তো দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছেন৷
ছবি: imago images/epd
২০তম ধনী দেশ জার্মানি
২০২১ সালে মাথাপিছু জিডিপির হিসেবে বিশ্বের ২০ তম ধনী দেশ হয়েছিল জার্মানি৷সে বছর জার্মানির মাথাপিছু বার্ষিক জিডিপি ছিল ৫২ হাজার ২০০ ইউরো (৫০ হাজার ৭০০ ডলার)৷ এক লাখ ৩৬ হাজার ৭০০ ইউরো মাথাপিছু বার্ষিক জিডিপি নিয়ে সবচেয়ে ধনী দেশের স্বীকৃতি পেয়েছিল লুক্সেমবুর্গ৷ সবচেয়ে কম মাত্র ২৭০ ইউরো বার্ষিক মাথাপিছু জিডিপি ছিল বুরুন্ডির৷ সে কারণে ২০২১ সালে আফ্রিকার এই দেশটিই ছিল বিশ্বের দরিদ্রতম৷
ছবি: Markus C. Hurek/dpa/picture alliance
জার্মানিতে দরিদ্র কারা
কোনো ব্যক্তির মাসিক আয় এক হাজার ১৪৮ ইউরোর চেয়ে কম হলে তিনি দারিদ্র্যসীমার নীচে আছেন বলে ধরে নেয়া হয়৷তবে এক সন্তান আছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে মাসিক আয় কমপক্ষে এক হাজার ৪৯২ ইউরো হতে হয়, না হলে তাকেও দারিদ্র্যসীমাধীন বলে ধরে নেয়া হয়৷ দুই সন্তানের বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে আয়সীমাটা দু হাজার ৪১০ ইউরো, অর্থাৎ আয় তার চেয়ে কম হলে জার্মানির মানদণ্ডে তারাও দারিদ্র্যসীমার নীচে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Skolimowska
দ্রব্যমূল্যের চাপে পিষ্ট মানুষ
জার্মানিতে কেউ চাকরি না পেলে বা কাজ করতে না পারলে সরকার তাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেয়৷ সেই প্রণোদনার অংশ হিসেবে ৪৪৯ ইউরো দেয়া হয় সারা মাসের খাদ্য, বস্ত্র, গৃহস্থালী নানা পণ্য কেনা এবং ঘরের যাবতীয় বিল পরিশোধের জন্য৷এছাড়া প্রতিটি শিশুর জন্য দেয়া হয় (বয়সভেদে) ২৮৫ থেকে ৩৭৬ ইউরো৷ কিন্তু দ্রব্যমূল্য এত বেড়েছে যে, ওলাফ শলৎস সরকার এ ভাতা ৪৪৯ থেকে বাড়িয়ে ৫০৩ ইউরো করার কথা ভাবছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/W. Steinberg
অপ্রতুল সরকারি উদ্যোগ
সমাজ বিজ্ঞানী এবং দারিদ্র্য গবেষক ক্রিস্টোফ বুটারভেগে মনে করেন, মাসিক সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা কমপক্ষে ৬৫০ ইউরো না করলে দুর্মূল্যের এ বাজারে অনেক মানুষের জন্য তিনবেলা পর্যাপ্ত খাওয়া কঠিন হবে৷প্রসঙ্গত, জার্মানিতে রুটি, দুধ, ফল এবং শাকসবজির দাম ২০২০ সালের তুলনায় এ বছর শতকরা ১২ ভাগেরও বেশি বেড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/imageBROKER
বার্ধক্যে দারিদ্র্যের জ্বালা
বের্টেলসমান ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জার্মানিতে প্রবীণদের মধ্যেও দারিদ্র্য বাড়ছে৷ কয়েক দশক কাজ করে যারা মাসিক অবসর ভাতায় আয়েশে জীবন যাপনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাদের কেউ কেউ দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে খণ্ডকালীন কাজে যোগ দিচ্ছেন৷ কাজ করেও নারীরা কুলাতে পারছেন না৷ পুরুষদের চেয়ে পারিশ্রমিক কম বলে অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হচ্ছে তাদের৷
ফুলটাইম জব, অর্থাৎ দিনে আট ঘণ্টা কাজ করেও সেই আয়ে সংসার চালাতে পারছেন না- এমন মানুষের সংখ্যাও জার্মানিতে বাড়ছে৷এতদিন সন্তানহীন কোনো মানুষ ঘণ্টায় ১২ ইউরো হিসেবে দিনে আট ঘণ্টা করে সপ্তাহে মোট ৪০ ঘণ্টা কাজ করতেন৷ বিনিময়ে প্রতি মাসে পেতেন এক হাজার ৪৮০ ইউরোর মতো৷ দিব্যি চলে যেতো তাতে৷এখন তাতে চলছে না বলে অনেকেই আরেকটা খণ্ডকালীন কাজ করছেন৷