জার্মানির ১৬টি রাজ্যের মধ্যে শুধুমাত্র নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যেই ২০১৬ সালে প্রায় ৪৭,৩০০টি আশ্রয় আবেদন সংক্রান্ত মামলা হয়েছে৷ দেশটির অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা বিএএমএফ এর বিরুদ্ধে এসব মামলা করেছেন শরণার্থীরা৷
বিজ্ঞাপন
এই শরণার্থীদের বেশিরভাগই সিরীয় নাগরিক৷ মামলা করার কারণ, গত বছরের মার্চে জার্মানিতে আশ্রয় আবেদন সংক্রান্ত নতুন একটি আইন পাস হওয়ার পর থেকে আবেদনকারীদের বেশিরভাগকেই ‘অ্যাসাইলাম’ না দিয়ে ‘সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশন’ দেয়া হচ্ছে৷ এই দুটোর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশন পাওয়ার এক বছর পর আবারও তার জন্য আবেদন করতে হয়৷ আর অ্যাসাইলামের ক্ষেত্রে তিন বছর সময় পাওয়া যায়৷ সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশনের ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা হলো, যারা এটি পেয়েছেন, তাদের জার্মানিতে পরিবার নিয়ে আসার আবেদন করার জন্য দুই বছর অপেক্ষা করতে হয়৷ মূলত এই বিষয়টিতেই আপত্তি সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশন পাওয়া শরণার্থীদের৷ সেজন্যই তাঁরা বিএএমএফ এর বিরুদ্ধে মামলা করছেন৷
শিশু আঙ্গেলা ম্যার্কেল আশ্রয় পেল না
00:50
শরণার্থীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা এনজিও ‘প্রো অ্যাসাইল’-এর উপ-পরিচালক ব্যার্ন্ড মেসোভিচ শরণার্থীদের মামলা করার বিষয়টি সমর্থন করেন৷ তিনি জানান, জার্মান সরকার গত বছরের মার্চে যে নতুন আইনটি করেছে তার বিরোধিতা করেছিল প্রো অ্যাসাইল৷ এবং মেসোভিচ মনে করেন, ‘‘পরিবার আনার জন্য দুই বছর অপেক্ষা করা কঠিন৷’’ তাছাড়া সময়টি শুধু দুই বছর নয়, তার চেয়েও বেশি, কারণ, দুই বছর পর পরিবারের সদস্যরা ভিসা আবেদনের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন৷ তারপর সাক্ষাৎকারের সময় পাওয়ার জন্যও অপেক্ষা করতে হয়৷
বিএএমএফ এর বিরুদ্ধে শরণার্থীদের মামলা করার আরেকটি কারণ, অনেক শরণার্থীর আবেদন যাচাইবাছাইয়ের কাজ শুরু হতেই বছর খানেক সময় লেগে যাচ্ছে৷ কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, আবেদন গ্রহণ না হওয়া পর্যন্ত শরণার্থীরা কাজ খোঁজা কিংবা জার্মান ভাষা শেখার কাজ শুরু করতে পারেন না৷
উল্লেখ্য, শরণার্থীদের মধ্যে যারা সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের কারণে ব্যক্তিগতভাবে নির্যাতনের শিকার হননি তাদেরকে সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশন দেয়া হচ্ছে৷ আর যারা সরাসরি যুদ্ধের শিকার হয়েছেন তারা অ্যাসাইলাম পাচ্ছেন৷
‘অ্যাসোসিয়েশন অফ জার্মান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ জাজেস-’এর প্রধান রবার্ট সিগম্যুলার মনে করছেন, চলতি বছর শরণার্থীদের করা মামলার সংখ্যা অন্তত দ্বিগুন হতে পারে৷ পাশাপাশি তিনি জানান, এত মামলা নিয়ে কাজ করার মতো পর্যাপ্ত বিচারক নেই৷
প্রতিবেদন: কার্লা ব্লাইকার/জেডএইচ
সম্পাদনা: আশীষ চক্রবর্ত্তী
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে নীচে মন্তব্যের ঘরে লিখুন৷
ইউরোপে শরণার্থী সংকট কীভাবে শুরু হয়েছিল?
মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় সহিংসতা বৃদ্ধি থেকে ইউরোপের অসংলগ্ন শরণার্থী নীতি অবধি ইউরোপে শরণার্থী সংকটে কারণগুলো তুলে ধরা হয়েছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুদ্ধ এবং দারিদ্র্যতা থেকে পালানো
২০১৪ সালের শেষের দিকে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চতুর্থ বছরে পা দেয়ার প্রাক্কালে এবং দেশটির উত্তরাঞ্চলে তথাকথিত ‘ইসলামিট স্টেট’-এর বিস্তার ঘটার পর সিরীয়দের দেশত্যাগের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়৷ একইসময়ে সহিংসতা এবং দারিদ্র্যতা থেকে বাঁচতে ইরাক, আফগানিস্তান, ইরিত্রিয়া, সোমালিয়া, নিগার এবং কসভোর অনেক মানুষ ইউরোপমুখী হন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সীমান্তের ওপারে আশ্রয় খোঁজা
সিরীয় শরণার্থীদের অধিকাংশই ২০১১ সাল থেকে সে দেশের সীমান্ত সংলগ্ন তুরস্ক, লেবানন এবং জর্ডানে আশ্রয় নিতে শুরু করেন৷ কিন্তু ২০১৫ সাল নাগাদ সেসব দেশের শরণার্থী শিবিরগুলো পূর্ণ হয়ে যায় এবং সেখানকার বাসিন্দারা সন্তানদের শিক্ষা দিতে না পারায় এবং কাজ না পাওয়ায় এক পর্যায়ে আরো দূরে কোথাও যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পায়ে হেঁটে লম্বা পথ পাড়ি
২০১৫ সালে ১৫ লাখের মতো শরণার্থী ‘বলকান রুট’ ধরে পায়ে হেঁটে গ্রিস থেকে পশ্চিম ইউরোপে চলে আসেন৷ সেসময় ইউরোপের শেঙেন চুক্তি, যার কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অধিকাংশ দেশের মধ্যে ভিসা ছাড়াই চলাচাল সম্ভব, নিয়ে প্রশ্ন ওঠে৷ কেননা শরণার্থীরা গ্রিস থেকে ধীরে ধীরে ইউরোপের অপেক্ষাকৃত ধনী রাষ্ট্রগুলোর দিকে আগাতে থাকেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardy
সমুদ্র পাড়ির উন্মত্ত চেষ্টা
সেসময় হাজার হাজার শরণার্থী ‘ওভারক্রাউডেড’ নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে শুরু করেন৷ লিবিয়া থেকে ইটালি অভিমুখী বিপজ্জনক সেই যাত্রায় অংশ নিতে গিয়ে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে সাগরে ডুবে যায় অন্তত আটশ’ মানুষ৷ আর বছর শেষে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরা শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় চার হাজার৷
ছবি: Reuters/D. Zammit Lupi
সীমান্তে চাপ
ইউরোপের বহির্সীমান্তে শরণার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় কয়েকটি রাষ্ট্র চাপে পড়ে যায়৷ হাঙ্গেরি, স্লোভেনিয়া, ম্যাসিডোনিয়া এবং অস্ট্রিয়া এক পর্যায়ে সীমান্তে বেড়া দিয়ে দেয়৷ শুধু তাই নয়, সেসময় শরণার্থী আইন কঠোর করা হয় এবং শেঙেনভুক্ত কয়েকটি দেশ সাময়িকভাবে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে৷
ছবি: picture-alliance/epa/B. Mohai
বন্ধ দরজা খুলে দেয়া
জার্মান চ্যান্সেল আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সমালোচকরা মনে করেন, তাঁর ‘ওপেন-ডোর’ শরণার্থী নীতির কারণে বিপজ্জনক পথ পেরিয়ে অনেক শরণার্থীই ইউরোপে আসতে উৎসাহ পেয়েছেন৷ এক পর্যায়ে অবশ্য অস্ট্রিয়ার সঙ্গে সীমান্ত পথ নিয়ন্ত্রণ শুরু করে জার্মানিও৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি
২০১৬ সালের শুরুতে ইইউ এবং তুরস্কের মধ্যে একটি চুক্তি হয়৷ এই চুক্তির আওতায় গ্রিসে আসা শরণার্থীদের আবারো তুরস্কে ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়৷ তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই চুক্তির বিরোধিতা করে৷ নভেম্বর মাসে অবশ্য তুরস্কের ইইউ-তে প্রবেশের সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা স্থগিত ঘোষণার পর, সেই চুক্তি আবারো নড়বড়ে হয়ে গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Altan
পরিস্থিতি বদলের কোনো লক্ষণ নেই
ইউরোপজুড়ে অভিবাসীবিরোধী মানসিকতা বাড়তে থাকলেও সরকারগুলো সম্মিলিতভাবে শরণার্থী সংকট মোকাবিলার কোনো সঠিক পন্থা এখনো খুঁজে পাননি৷ কোটা করে শরণার্থীদের ইইউ-ভুক্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে৷ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে চলমান সহিংসতার ইতি ঘটার কোনো লক্ষণও নেই৷ ওদিকে, সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে শরণার্থীদের মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছে৷