দুটি তথ্য – ২০২২ সালের মধ্যে সব পরমাণু চুল্লি বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে জার্মানি৷ আর বাংলাদেশ ২০২১ সালে তাদের প্রথম পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে৷
বিজ্ঞাপন
বলা যেতেই পারে – একজনের যেখানে শেষ, অপরজনের সেখানে শুরু৷ পরমাণু কেন্দ্রের ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে জার্মানি বছর চার আগেই তাদের সব পারমাণবিক কেন্দ্র বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে৷ বিকল্প হিসেবে তারা এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা করছে৷ ইতিমধ্যে বেশ এগিয়েও গেছে তারা৷ ফলে ২০২২ সালের মধ্যে পারমাণবিক কেন্দ্র বন্ধ করার কারণে বিদ্যুতের যে সম্ভাব্য ঘাটতি হতে পারে, সেটা নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে মেটানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে৷
মূলত বায়ু, বায়োগ্যাস আর সৌরশক্তি ব্যবহার করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন করছে জার্মানি, যেগুলোর কোনো কমতি নেই বাংলাদেশে৷ ফলে চেষ্টা করলে বাংলাদেশও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে এগিয়ে যেতে পারে৷ সেটা অবশ্য হচ্ছেও, বিশেষ করে সৌরশক্তি ব্যবহারে অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ৷ বাংলাদেশের মানুষের সৌরশক্তি ব্যবহার নিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রশংসাসূচক প্রতিবেদনও নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে৷ সরকার ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত চেষ্টার ফলে এটা সম্ভব হয়েছে৷ দু'পক্ষকেই এ জন্য ধন্যবাদ৷
ফুকুশিমার ছায়া
দুইবছর আগে ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে নতুন করে ভেবেছে৷ কারও উপর আবার কোনো প্রভাবই পড়েনি৷
ছবি: Reuters/Kyodo
একইসঙ্গে সুনামি, ভূমিকম্প ও পরমাণু দুর্ঘটনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা হয় দুই বছর আগে৷ সাগরের নীচে ৯.৩ মাত্রার ভূমিকম্পের পর উত্তরপূর্ব উপকূলে সুনামি তৈরি হয়৷ এতে কমপক্ষে ১৫,৮৮০ জন মারা যায়৷ আর আহত হয় ৬,১৩৫ জন৷ তবে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ২,৬৯৪ জন৷
ছবি: dapd
পরমাণু দুর্ঘটনা
সুনামির কারণে ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের শীতলীকরণ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়৷ এতে তিনটি চুল্লি অতিরিক্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে৷ আর তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে৷ ফলে সরকার ঐ বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশেপাশের ৩০ কিলোমিটার এলাকায় বসবাসরতদের সরে যেতে বলে৷ এখনো তারা ঘরে ফিরতে পারেনি৷
ছবি: Reuters/Kyodo
চেরনোবিল
ফুকুশিমার আগে ইউক্রেনের চেরনোবিল দুর্ঘটনা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক পরমাণু দুর্ঘটনা৷ ১৯৮৬ সালে ঐ কেন্দ্রের একটি চুল্লিতে তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে সে ধ্বংস হয়ে যায়৷ ফলে ইউরোপ ও রাশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে৷ ঐ দুর্ঘটনায় ৩০ জন নিহত হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তারপরও পরমাণু বিদ্যুৎ
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চেরনোবিলের কথা সবাই ভুলে যায়৷ ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও জ্বালানির চাহিদা মেটাতে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে পরমাণু বিদ্যুতের দিকে ঝুঁকে পড়ে৷ এমনকি ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পরও যুক্তরাষ্ট্রে দুটি চুল্লি নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এমনকি জার্মানিও
জার্মানি এমনিতেই পরমাণু শক্তির চরম বিরোধী৷ তাই সাবেক চ্যান্সেলর গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার ২০২২ সালের মধ্যে পরমাণু শক্তি উৎপাদন বন্ধ করার পরিকল্পনা করেছিলেন৷ বর্তমান সরকার সেটা বাড়িয়ে ২০৩৪ পর্যন্ত করতে চেয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফুকুশিমা বদলে দিল সব
ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর জার্মানিতে পরমাণু শক্তির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠায় আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সরকার তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়৷ ফলে এখন আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২২ সালের মধ্যেই সব পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবে৷ জার্মানি ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ৮০ শতাংশ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে৷
ছবি: picture alliance/Hinrich Bäsemann
ইটালিতেও পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ
জার্মানির মতো ইটালিও পরমাণু শক্তির ঘোর বিরোধী৷ চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর ১৯৮৭ সালে একটি গণভোটের মাধ্যমে ইটালীয়রা পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের পক্ষে ভোট দেয়৷ পরবর্তীতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি সেটা আবারও শুরু করতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পরমাণু বিদ্যুতের পক্ষে ব্রিটেন
ব্রিটিশ সরকার পরমাণু বিদ্যুৎকে জ্বালানির একটা উৎস হিসেবে দেখছে৷ তাদের মতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন কমানোর লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে পরমাণু বিদ্যুৎ৷
ছবি: AP
চারগুণ বাড়াতে চায় ভারত
২০২০ সালের মধ্যে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন চারগুণ বাড়াতে চায় ভারত৷ সরকারের এই সিদ্ধান্ত ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়েছে৷ রাশিয়ার সহায়তায় তৈরি হওয়া একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বিক্ষোভের কারণে মাঝেমধ্যেই বন্ধ রাখতে হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চীনের লক্ষ্যও একই
চীনও পরমাণু বিদ্যুতের উপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে৷ বর্তমানে দেশটির মোট চাহিদার মাত্র এক শতাংশ আসে পরমাণু বিদ্যুৎ থেকে৷ ২০২০ সালের মধ্যে এই হারটা চীন ছয় শতাংশে নিয়ে যেতে চায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশে প্রথম
পাবনার রূপপুরে বাংলাদেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হতে যাচ্ছে৷ রাশিয়ার সহায়তায় তৈরি হতে যাওয়া এই কেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে৷
নাগরিকদের চাহিদা মেটাতে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চেষ্টা করবে সেটাই স্বাভাবিক৷ কারণ বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণের একটা বড় অংশ বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত৷ কিন্তু সেটা করতে গিয়ে মানুষের প্রাণ ও স্বাস্থ্য নিয়ে ঝুঁকি নেয়াটা কতখানি সঠিক, তা-ও বিবেচনায় নিতে হবে৷ কেননা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, চেরনোবিল আর ফুকুশিমার ঘটনায় সেটা প্রমাণিত হয়েছে৷ জার্মানির পরমাণু কেন্দ্র বন্ধের সিদ্ধান্তের পেছনে ফুকুশিমা দুর্ঘটনার একটি বড় অবদান রয়েছে৷
তবে শুধু দুর্ঘটনা হলেই যে পরমাণু কেন্দ্রের ক্ষতির দিকটি সামনে আসে তা নয়৷ সবকিছু ঠিকঠাকভাবে চললেও সেখান থেকে তেজস্ক্রিয়তা বের হতে পারে, যেটা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এমনকি প্রাণঘাতীও হতে পারে৷ টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন এর প্রমাণ৷ সেখানে বলা হয়েছে, ভারতের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোর আশেপাশে গত ২০ বছরে যত মানুষ মারা গেছেন, তাঁদের প্রায় ৭০ ভাগেরই মৃত্যুর কারণ ক্যানসার৷ তথ্যটি দিয়েছে ভারতের পরমাণু শক্তি বিভাগের অধীন সংস্থা ‘ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার'৷ শুধু তাই নয়, গত ২০ বছরে নাকি এসব কেন্দ্রে কাজ করা ২৫৫ জন দীর্ঘকাল রোগে ভুগে বা পারিবারিক অন্যান্য সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করেছেন৷
আমার কাছে তথ্যগুলো বেশ আতঙ্কের মনে হয়েছে৷ বেশিরভাগ পাঠকেরই নিশ্চয় তা মনে হবে৷ এ সব জানার পর পারমাণবিক কেন্দ্র স্থাপনে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনাকে আমি আর সমর্থন করতে পারছি না৷ সেটা না করে সৌরশক্তিতে বাংলাদেশ যে অগ্রগতি অর্জন করেছে সেটা আরও বাড়াতে সরকার চেষ্টা করতে পারে৷ সেই সঙ্গে নবায়নযোগ্য জ্বালানির আর যেসব উৎস রয়েছে যেমন বায়ু, বায়োগ্যাস সেগুলোর উন্নয়নে সরকার আরও উদ্যোগ নিতে পারে৷ নিতে পারে কি, অবশ্যই নেয়া উচিত৷ কী বলেন?