জার্মানির অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, হানাওয়ের হত্যাকাণ্ড তীব্র ঘৃণারই ফল৷ এই নৃশংস সহিংসতা জার্মানির রাজনীতিবিদ এবং সুশীল সমাজের জন্য সতর্কবার্তা, বলছেন ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক ইনেস পোল৷
বিজ্ঞাপন
হানাও সবশেষ ঘটনা৷ কয়েক মাসের মধ্য়ে এ নিয়ে তৃতীয়বার জার্মানির বুকে ঘৃণার জয় হলো৷ গত জুনে রক্ষণশীল রাজনীতিবিদ ভাল্টার ল্যুবকে নিজের বাসায় খুন হন৷ শরণার্থীবান্ধব নীতির পক্ষে সোচ্চার ছিলেন তিনি৷ অক্টোবরে হালে শহরে এক সিনাগগে (ইহুদিদের উপাসনালয়) রক্তাক্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়৷
(সিনাগগের নিরাপত্তা কর্মীরা এক-দুইজন সশস্ত্র ব্যক্তিকে সিনাগগে প্রবেশে বাধা দিতে সক্ষম হয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন স্থানীয় ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতা মাক্স প্রিভোরোৎসকি৷ তিনি জানান, ঘটনার সময় সিনাগগে ৭০-৮০ জন প্রার্থনাকারী ছিলেন৷ ইহুদি ধর্মে বছরের সবচেয়ে পবিত্র দিন ‘ইয়ম কিপুর’ উপলক্ষ্যে তাঁরা সিনাগগে গিয়েছিলেন৷ তবে হামলায় দুজনের প্রাণহানি ঘটে৷)
এখন হানাওয়ে ১০ জনকে হত্যা করা হলো৷ হত্যাকারী দুটি শিশা বারে হামলা চালানোর আগে বর্ণবাদ ও যড়যন্ত্রতত্ত্বমূলক বক্তব্য দিয়ে একটি ভিডিও রেকর্ড করে৷ শেষ পর্যন্ত সে তার নিজের মাকেও হত্যা করে৷
জার্মানিতে নিরাপত্তা শঙ্কায় মুসলিমরা
জার্মানির হেসে রাজ্যের হানাও শহরে দক্ষিণপন্থি সন্ত্রাসীর গুলিতে নয় জন মারা গেছেন৷ দু’দিন আগেই নাশকতার পরিকল্পপনা করা কয়েকজন দক্ষিণপন্থিকে গ্রেফতার করে পুলিশ৷ মুসলিম সমাজ সরকারের কাছে নিরাপত্তা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Probst
বারে গুলি
১৯ ফেব্রুয়ারি জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে হানাও শহরের একাধিক স্থানে হামলায় নয়জন প্রাণ হারান৷ পরে হামলাকারী ও তার মা-কে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ৷
ছবি: Reuters/R. Orlowski
নিরাপত্তা শঙ্কায় মুসলিমরা
ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জার্মানিতে মুসলিমদের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের মহাসচিব আবদাসসামাদ এল ইয়াজিদি বলেন, মুসলিমরা ‘খুবই অনিরাপদ’ বোধ করছেন৷ তিনি বলেন, দক্ষিণপন্থার এমন উত্থান আগে কখনো দেখা যায়নি৷
ছবি: imago images/IPON
দেশজুড়ে নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা
এই ঘটনার দু’দিন আগে জার্মান পুলিশ দেশটির ছয় রাজ্যে ১৩টি স্থানে অভিযান চালিয়ে এক ডজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে৷ অভিযোগ রয়েছে, এরা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, আশ্রয়প্রার্থী ও মুসলিমদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন৷ তারা চেয়েছিলেন জার্মানিতে একটি গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করতে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Stein
নাশকতা পরিকল্পনার মূল হোতা পাঁচ উগ্র ডানপন্থি
জার্মান বার্তা সংস্থা ডিপিএ ঘটনার তদন্তকারীদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, এই পরিকল্পনার মূল হোতা ছিলেন পাঁচ জন উগ্র ডানপন্থি সন্ত্রাসী৷ বাকিরা এদের অর্থ জোগাচ্ছিলেন৷ এদের সবাই জার্মান ও পুরুষ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/U. Deck
অস্ত্রের খোঁজে
যে ছয় রাজ্যে অভিযান চালানো হয় তা হলো: বাডেন-ভ্যুটেমব্যার্গ, বাভেরিয়া, লোয়ার স্যাক্সনি, নর্থ-রাইন ওয়েস্টফালিয়া, রাইনল্যান্ড-পালাটিনাটে এবং স্যাক্সনি-আনহাল্ট৷ দলটি ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তৈরি করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ পুলিশ সম্ভাব্য হামলায় ব্যবহার করার অস্ত্রেরও খোঁজ করছে৷ জার্মান গণমাধ্যম জানিয়েছে, তারা হাতে তৈরি অস্ত্র ও হামলার আইডিয়া সম্বলিত ছবি পরস্পরের সঙ্গে শেয়ার করেছেন৷
ছবি: Getty Images/T. Lohnes
মসজিদে নিরাপত্তা চান মুসলিমরা
ডানপন্থি সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের পর মুসলিমরা মসজিদগুলোকে সুরক্ষিত করার আহ্বান জানিয়েছেন৷ জার্মান মুসলিমদের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে আইজিএমজি-র চেয়ার আইমান মাজিয়েক পত্রিকা ড্যের স্পিগেলকে বলেন, ‘‘বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রের ভাবা উচিত৷’’ যেসব জায়গায় আগেও হামলা হয়েছে সেগুলোতে, বিশেষ করে পুলিশের উপস্থিতি জোরদার করার আহ্বান জানান তিনি৷
ছবি: Imago Images/M. Schüler
বছরে একশ’ হামলা
জার্মানির বিভিন্ন মসজিদে বছরে প্রায় একশ’ হামলার ঘটনা নিবন্ধিত হয় বলে জানিয়েছে দেশটির মসজিদগুলোর সবচেয়ে বড় অ্যাসোসিয়েশন ডিটিব৷ গত কয়েক সপ্তাহে উনা, হাগেন, এসেন ও বিয়েলফেল্ডের মসজিদগুলোতে বোমা হামলার হুমকি দেয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Zinken
উগ্র ডানপন্থার উত্থান
গত জুনে ভাল্টার ল্যুবকে নামের এক রাজনীতিককে হত্যা এবং হালেতে একটি সিনাগগে হামলার ঘটনায় জার্মানিতে উগ্র ডানপন্থা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বলে সবার টনক নড়েছে৷ সম্প্রতি সামাজিক গণমাধ্যমে বেশ কিছু পোস্টও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে৷
ছবি: DW/D. Regev
8 ছবি1 | 8
হত্যাকারীদেরউর্বরক্ষেত্রজার্মানি
এই সব হত্যাকারীই জার্মান জাতি সম্পর্কে তাদের নিজেদের ধারণার সঙ্গে মেলে না, এমন সব বিষয়ে ঘৃণার চর্চা করতো৷ এরা কোনো চরম ডানপন্থি ব্যক্তি বা সংগঠনের সঙ্গে জড়িত কিনা তা বিবেচনার বিষয় নয়৷ বরং আমাদের এটা মেনে নিতে হবে যে, এমন ঘৃণার চর্চা জার্মানির রন্ধ্রে পৌঁছে গিয়েছে৷
রাজনীতিবিদ এবং সুশীল সমাজকে এটা স্বীকার করতে হবে যে, এই হত্যাকারীদের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে জার্মানি৷ আর তাদের বর্ণবাদী, বিদ্বেষমূলক এবং উগ্র ডানপন্থি নীতি সমাজের কিছু অংশে আবারও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে৷
এই হত্যাকাণ্ডগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়৷ ঘটনাগুলো উদারপন্থি রাজনীতি, ইহুদি না মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘটছে, তার চেয়ে বড় কথা জার্মানির বর্তমান সামাজিক কাঠামোতে এরা আবার মাথাচাড়া দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে৷ আমাদের জন্য এটা একটা সতর্কবার্তা৷ ধর্ম-বর্ণ-জাতি-লিঙ্গ নির্বিশেষে সংবিধান অনুসারে সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই৷
অনলাইনেওছড়াচ্ছেঘৃণা
ইন্টারনেটে যে ঘৃণা ও পাগলামি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, তা বন্ধে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে? তথ্যপ্রবাহের অবাধ স্বাধীনতার নামে যে-কোনো কিছু করার স্থান নয় ইন্টারনেট৷ হানাওয়ের ঘটনা প্রমাণ করে এসব ঘৃণা কী পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে৷
রাজনীতিবিদদের শুধু কথা নয়, কাজের মাধ্যমে দ্রুত এবং স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ নয়তো একসময় তা এমন এক অবস্থায় পৌঁছাবে, আমরা সাংবিধানিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যা করেছি, ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষায় যা করেছি, সবই পড়বে হুমকির মুখে৷ জার্মান চ্যান্সেলর ভালোই বলেছেন, ‘‘বর্ণবাদ বিষের মতো’’৷ কিন্তু এটা মনে করাই যথেষ্ট নয়৷ সকল অমানবিক মতাদর্শের চর্চা এবং অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে৷ এর দায়িত্ব কেবল ফেসবুক বা টুইটারের ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না৷
ইনেস পোল/এডিকে
গত অক্টোবরের ছবিঘরটি দেখুন...
জার্মানিতে ইহুদি উপাসনালয়ে যত হামলা
জার্মানির হালে শহরে বুধবার ইহুদিদের একটি উপাসনালয়ে হামলার চেষ্টা হয়েছে৷ তবে সিনাগগে ঢুকতে না পেরে দুইজন পথচারীকে হত্যা করেন এক জার্মান আততায়ী৷ ছবিঘরে কয়েকটি সিনাগগে হামলার ঘটনা তুলে ধরা হলো৷
ছবি: Imago Images/S. Schellhorn
কোলন, ১৯৫৯: স্বস্তিকা ও হেট স্পিচ
১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে ‘ডয়চে রাইশপার্টাই’ নামের একটি চরম ডানপন্থি দলের সদস্যরা কোলনের সিনাগগে স্বস্তিকা এঁকে দিয়েছিল৷ এছাড়া ‘জার্মানদের দাবি: ইহুদিরা চলে যাও’ শব্দগুলোও লিখে দেয় তারা৷ এরপর জার্মানির বিভিন্ন এলাকায়ও ইহুদিবিরোধী গ্রাফিতির দেখা পাওয়া গিয়েছিল৷ ঐ ঘটনায় জড়িতদের ধরা হয়েছিল এবং ভবিষ্যতে কেউ যেন ‘মানুষের উসকানিমূলক’ কিছু করতে না পারে সেজন্য সংসদে আইন পাস হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/Arco Images/Joko
ল্যুবেক, ১৯৯৪: অগ্নিসংযোগ
মার্চ মাসের এই ঘটনা সারা বিশ্বের মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল৷ চরম ডানপন্থি চার ব্যক্তি ল্যুবেকের সিনাগগে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল৷ এই ঘটনার এক বছর পর আবারও একই সিনাগগে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Büttner
এসেন, ২০০০: পাথর ছোড়া
লেবানন থেকে আসা ১০০-র বেশি ফিলিস্তিনি ২০০০ সালের অক্টোবরে এসেন শহরের পুরনো সিনাগগে পাথর ছুড়ে মেরেছিল৷ ‘মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত’-এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শেষে এই হামলা করা হয়৷ এই ঘটনায় একজন পুলিশ আহত হয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/B. Boensch
ড্যুসেলডর্ফ, ২০০০: অগ্নিসংযোগ ও পাথর নিক্ষেপ
ইহুদি ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধ’ নিতে ১৯ বছর বয়সি এক ফিলিস্তিন ও ২০ বছর বয়সি মরক্কোর এক নাগরিক আগুন ও পাথর দিয়ে ড্যুসেলডর্ফের নতুন সিনাগগে হামলা করেছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Weihrauch
মাইনৎস, ২০১০: মলটফ ককটেল হামলা
১৯৩৮ সালে নাৎসি বাহিনী মাইনৎসের একটি সিনাগগ পুড়িয়ে দিয়েছিল৷ সেখানে নতুন করে একটি সিনাগগ নির্মাণ করা হয়৷ তবে উদ্বোধনের কিছুক্ষণ পরই সেখানে মলটফ ককটেল হামলা চালানো হয়৷
ছবি: picture-alliance/akg/Bildarchiv Steffens
ভুপার্টাল, ২০১৪: অগ্নিসংযোগ
ফিলিস্তিনি তিন তরুণ ২০১৪ সালের জুলাই মাসে ভুপার্টালের সিনাগগের প্রবেশ দরজায় দাহ্য পদার্থ ছুড়ে মেরেছিল৷ তবে এই ঘটনায় ইহুদিবিদ্বেষের পক্ষে ‘প্রমাণ পাওয়া যায়নি’ বলে আদালত রায় দিয়েছিলেন৷ জার্মানির ইহুদি ও বিদেশি গণমাধ্যম এই রায়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Seidel
বার্লিন, ২০১৯: ছুরি নিয়ে হামলা
অক্টোবরের ৪ তারিখ শাবাতের পূর্বে বার্লিনের নতুন সিনাগগে স্থাপন করা একটি বেড়ায় ছুড়ি নিয়ে উঠে পড়েছিলেন এক ব্যক্তি৷ নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে ধরে ফেলেন৷ পরে ছেড়েও দেন৷ ইহুদি নেতারা পুলিশের এই সিদ্ধান্তকে বিচারব্যবস্থার ‘ব্যর্থতা’ বলে উল্লেখ করেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Avers
হালে, ২০১৯: গুলি
ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের জন্য বছরের সবচেয়ে পবিত্র দিন ‘ইয়ম কিপুর’ উপলক্ষ্যে ৯ অক্টোবর সিনাগগে উপস্থিত হয়েছিলেন ৭০-৮০ জন মানুষ৷ অস্ত্র নিয়ে সেই সিনাগগে ঢোকার চেষ্টা করেছিল ২৭ বছর বয়সি জার্মান আতাতয়ী৷ তবে নিরাপত্তারক্ষীদের বাধার মুখে সিনাগগে ঢুকতে না পেরে রেগে গিয়ে গুলি করে দুইজন পথচারীকে হত্যা করেন তিনি৷ জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হর্স্ট সেহোফার জানিয়েছেন, ইহুদি-বিদ্বেষের কারণেই তিনি হামলা চালিয়েছেন৷