অবশেষে আঙ্গেলা ম্যার্কেলের নেতৃত্বে আরো একবার তৈরি হচ্ছে জার্মান সরকার৷ তবে এবারের রাস্তা খুব সহজ ছিল না৷ অতীত থেকে কি শিক্ষা নেবেন রাজনীতিকেরা? প্রশ্ন তুললেন, ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক ইনেস পোল৷
ছবি: picture-alliance/AP/M. Sohn
বিজ্ঞাপন
যাকে বলে, খাদের কিনার থেকে উঠে আসা৷ আশা যখন প্রায় অস্ত যেতে বসেছিল, ঠিক তখনই সমাধানসূত্র মিললো৷ জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বা এসপিডি মহাজোটের পক্ষে সমর্থনসূচক ভোট দিলো৷ জানা গেছে, মার্চের শেষ সপ্তাহের আগেই নতুন সরকার তৈরি হয়ে যাবে৷ সম্ভবত ইস্টারের আগেই৷
তবে এই সমাধান সূত্রে পৌঁছানো সহজ ছিল না৷ জোট আলোচনা থেকে জোট সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত, কোনো বিষয়ই খুব সহজে হয়নি৷ এসপিডি'র তারকা রাজনীতিক মার্টিন স্কুলৎসও সমস্যার প্রাথমিক সমাধান করতে পারেননি৷ অন্যদিকে আঙ্গেলা ম্যার্কেলও যথেষ্ট চাপের মধ্যে ছিলেন৷ কারণ, জোট না হলে তাঁর পক্ষে আরো একবার ক্ষমতায় আসা সম্ভব ছিল না৷ কারণ, তাঁর দলও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি৷ ফলে জোট রাজনীতির এই নতুন বিশ্বে অন্যান্য দলের ওপর তাঁকে ভরসা করতেই হচ্ছিলো৷
যেভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাস্ত করেন ম্যার্কেল
এমনকি ২০১৭ সালের নির্বাচনের আগেও তাঁর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো রাজনীতিবিদদের নিষ্ক্রিয় বা পাশে সরিয়ে দিয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ নিজের দল বা বিরোধী দলের অনেক নেতাকেই নানাভাবে ঠেকিয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/ANP/R. De Waal
‘কোল গার্ল’ যখন গুরুকে ছাড়লেন
দীর্ঘদিন চ্যান্সেলর পদে থাকে হেলমুট কোল ম্যার্কেলকে মন্ত্রিসভায় প্রথম সুযোগ দিয়েছেন এবং তাঁর উত্থানে সহায়তা করেছিলেন৷ কিন্তু ১৯৯৮ সালে চ্যান্সেলর পদ হারানোর পর ম্যার্কেল এবং সিডিইউ তাঁর বিপক্ষে চলে যায়৷ কোল কিছু সূত্র থেকে নগদ অর্থ সাহায্য নিয়েছিলেন৷ কিন্তু সে সব সূত্রের বিস্তারিত তিনি জানাননি যা দলের জন্য ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেছিলেন সেসময় সিডিইউ’র সাধারণ সম্পাদক আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Altwein
গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার – রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি
২০০৫ সালের নির্বাচনে এসপিডি’র চ্যান্সেলর শ্র্যোডারকে পরাস্ত করেন ম্যার্কেল৷ তবে এই পরাজয়ে শ্র্যোডারের নিজের দাম্ভিকতাও কিছুটা ভূমিকা রেখেছিল৷ সেই নির্বাচনে খুব অল্প ব্যবধানে সিডিইউ’র কাছে হেরে যায় এসপিডি৷ যদিও নির্বাচনের আগে টিভি বিতর্কে তিনি দাবি করেছিলেন, যে জার্মানরা চায় তিনি ক্ষমতায় থাকুন৷ কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি এবং তিনি রাজনীতি থেকে বিদায় নেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমায়ার - দীর্ঘদিনের সঙ্গী
শুরুতে ম্যার্কেলের অধীনে চারবছর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমায়ার৷ এরপর ২০০৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেন সামাজিক গণতন্ত্রীদের এই রাজনীতিবিদ৷ কিন্তু সেই নির্বাচনে সুবিধা করতে পারেনি স্টাইনমায়ারের দল৷ পরবর্তীতে ২০১৩ সালে আবারো ম্যার্কেলের অধীনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন স্টাইনমায়ার৷ আর চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে তিনি জার্মানির প্রেসিডেন্ট৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Kembowski
গ্যুন্টার ও্যটিঙার - পথের কাঁটা দূর হলো
ম্যার্কেল যে শুধু তাঁর সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেন এমন নয়৷ বরং নিজের দলে থাকা সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের লোভনীয় অন্য কোন পদেও পাঠিয়ে দেন৷ তাঁর সহকর্মী বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যার্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী গ্যুন্টার ও্যটিঙারকে ২০১০ সালে তিনি ইউরোপীয় কমিশনে বড় পদে পাঠিয়ে দেন৷ অথচ ও্যটিঙারের সেই পদ পাওয়ার মতো কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Seeger
রোনাল্ড কখ - বাতিলের তালিকায় ফেলে দেয়া
দুই কারণে রোনাল্ড কখ পরিচিত৷ প্রথমত, তিনি দলাই লামার বন্ধু৷ দ্বিতীয়ত, সরকারের দ্বৈত নাগরিকত্ব চালুর পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কয়েক মিলিয়ন স্বাক্ষর সংগ্রহের জন্য৷ হেসে রাজ্যের এই রাজ্য প্রধান কখনো ম্যার্কেলের উত্থানে বাধা না হলেও হঠাৎ করেই মনে করেছিলেন তাঁকে বার্লিনে বড় পদের জন্য ডাকা হবে৷ কিন্তু ম্যার্কেলকে তাঁকে সেরকম কোন সুযোগ দেননি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ক্রিস্টিয়ান ভুল্ফ - একজন দুর্ভাগা রাষ্ট্রপতি
ক্রিস্টিয়ান ভুল্ফ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ম্যার্কেলের প্রথম পছন্দ ছিলেন না৷ কিন্তু ২০১০ সালে হর্স্ট ক্যোলার পদত্যাগ করার পর সিডিইউ বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েনের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায় ভুল্ফ সুযোগ পেয়ে যান৷ ভুল্ফ তখন লোয়ার স্যাক্সনি রাজ্যের রাজ্যপ্রধান৷ পরবর্তীতে অবশ্য দুর্নীতির দায়ে প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়তে হয় তাঁকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পেয়ার স্টাইনব্রুক – সঠিক মানুষ, ভুল সময়
২০১৩ সালে ম্যার্কেল যখন তাঁর ক্যারিয়ারের তুঙ্গে, তখন এসপিডি থেকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বেছে নেয়া হয় পেয়ার স্টাইনব্রুক’কে৷ ম্যার্কেলের অধীনে একসময় অর্থমন্ত্রী থাকা এই রাজনীতিবিদের চ্যান্সেলর পদ পাওয়ার সব যোগ্যতাই ছিল৷ কিন্তু সময়টা ঠিক ছিল না৷ ম্যার্কেলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সুবিধা করতে পারেননি তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
7 ছবি1 | 7
জার্মানির রাজনীতিতে এ এক নতুন অধ্যায়৷ ১৯৪৯ সালে জার্মান ফেডেরাল রিপাবলিক তৈরি হয়৷ সেই তখন থেকেই জার্মানির প্রধান দু'টি দল কখনো মিলেঝুলে সরকার গঠন করেছে, কখনো একক ক্ষমতাতে সরকারে এসেছে৷ গত ১২ বছরে বিষয়টি আরো সহজ হয়ে গিয়েছিল৷ ম্যার্কেল চ্যান্সেলর থেকেছেন৷ জার্মানির রাজনীতিতেও চোখে পড়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি৷
অঙ্ক জটিল করে দিয়েছে জার্মান রাজনীতিতে হঠাৎ করে প্রাধান্য পেয়ে যাওয়া অতি দক্ষিণপন্থি এএফডি পার্টি৷ সংসদেও তারা নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে৷ আগে যে সমস্ত দলকে বড় বলে মনে করা হতো, গত নির্বাচনে তারা ছোট দলে পরিণত হয়েছে৷ আর এএফডি'র মতো নগণ্য দলগুলি হঠাৎ করে বড় হয়ে উঠেছে৷ এর ফলে সরকার তৈরির অঙ্কগুলিই বদলে গিয়েছিল৷
পরিচয়ের খোঁজে জার্মানি
নতুন করে উদ্ভূত এই পরিস্থিতিই জার্মানির বর্তমান অবস্থাটি স্পষ্ট করে দেয়৷ গত কয়েক দশকে জার্মানির মূল রাজনৈতিক দলগুলি তাদের নিরাপদ ভোটারদের এতটাই বিতশ্রদ্ধ করে তুলেছে যে, এখন তাঁরা নিজেদের মতামত বদলে ফেলেছেন৷ জার্মানদের বর্তমান পরিস্থিতি, ভয়, ভাবনা কোনো কিছুকেই সেভাবে বুঝতে চাইছে না পুরনো দলগুলি৷ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারছে না তারা৷ জার্মানদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, তাঁরা যেভাবে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত, সেখানে একটা হুমকি তৈরি হয়েছে৷ মূলস্রোতের রাজনীতিকেরা জার্মান জনগণকে বোঝাতে পারছে না, কীভাবে বিশ্বায়িত বিশ্বের সামনে জার্মান পরিচয়, মূল্যবোধ, সংস্কৃতিকে খাপ খাইয়ে নেওয়া হবে৷
বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানরা যেভাবে ছুটি কাটান
রাজনীতিবিদদের কাজটাই হলো ভীষণ চাপের৷ তাই এই চাপ থেকে তারাও কিছুটা মুক্ত হতে চান৷ ডয়চে ভেলে খোঁজার চেষ্টা করেছে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা কীভাবে তাদের ছুটি কাটান৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/The Canadian Press/A. Vaughan
ভ্লাদিমির পুটিন
রুশ প্রেসিডেন্ট যখনই তার শারীরিক সৌন্দর্য দেখাতে চান তখনই মনে হয় অবসর কাটাতে যান৷ সাইবেরিয়া তার পছন্দের জায়গা৷ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ছবিতে তাঁকে মাছ ধরতে, নৌকা বাইতে এবং রৌদ্রস্নান করতে দেখা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Druzhinin
আঙ্গেলা ম্যার্কেল
জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল গত এক দশক ধরে তাঁর স্বামীর সঙ্গে উত্তর ইটালির আল্পস পর্বতের কাছে ছুটি কাটাতে যান৷ তিনি বরাবরই তাঁর সেই ট্রেডমার্ক হ্যাট সঙ্গে নেন, জার্মান গণমাধ্যম যেটির নাম দিয়েছে ‘চ্যান্সেলরের টুপি’৷ এই ছবিটি ২০০৬ সালের এপ্রিলে তোলা, যখন তাঁরা ইটালিতে ছুটি কাটাচ্ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জাস্টিন ট্রুডো
ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাহামা অবসরের জন্য পছন্দের জায়গা৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/The Canadian Press/A. Vaughan
কিম জং উন
উত্তর কোরিয়াকে বলা হয় পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দেশ৷ কিন্তু এর মানে এই নয় যে সেদেশের নেতা কিম জং উন অবসর কাটাতে চান না৷ ছোটবেলা থেকেই ডিজনির ভীষণ ভক্ত উন৷ ১৯৯১ সালে শিশু উন ভুয়া পরিচয়ে টোকিও-র ডিজনিল্যান্ড ঘুরতে গিয়েছিলেন৷
4 ছবি1 | 4
ট্রাম্প- শি জিন পিং-পুটিনের বিশ্বে জার্মানির অবস্থান কী হবে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে জার্মানির জায়গা ঠিক কোন জায়গায়, কী তার বিদেশনীতি, কী তার অর্থনৈতিক ভাবনা, এর কোনো কিছুই মানুষকে বোঝাতে পারছে না মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলি৷
সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানির নির্বাচন হয়েছিল৷ মার্চ পর্যন্ত সরকার তৈরি করা যায়নি৷ এই সময় পর্বে যে ঝড় বয়ে গেল জার্মান রাজনীতিতে, তার থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত রাজনীতিকদের৷ রাজনীতিবিদদের সাধারণ মানুষের কথা শুনতে হবে৷ মানুষকে বোঝাতে হবে, তাঁদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে৷ রাজনীতিকদের মানুষের কথা বুঝতে হবে৷ তাদের ভাবনাগুলো ধরতে হবে৷ পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে পুরনো এবং ভয়ংকর জাতীয়বাদের ধোঁয়া যাতে আবার ফিরে না আসে৷ পাশাপাশি মহাজোটকে এমনভাবে কাজ করতে হবে যাতে জোটের প্রত্যেকটি দল তাদের নিজেদের বিশেষত্ব, নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান আলাদা রাখতে পারে৷ নইলে নিজেদের ভোটারদের কিন্তু ধরে রাখা যাবে না৷
ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক ইনেস পোলছবি: DW/P. Böll
মহাজোটের আলাদা আলাদা দলগুলি নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করতে না পারলে দু'টি দলই আগামী দিনে আরও ডুববে৷ নিজেদের ভোটারদের আরো বেশি করে হারাবে তারা৷ অন্যদিকে এএফডি'র মতো অতি দক্ষিণপন্থি দলগুলি নিজেদের দিকে আরো বেশি ভোটার টেনে নেবে৷
জরুরি অ্যালার্ম
আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবার সরকার গঠন করতে পারেন৷ এতদিনের এই টালমাটাল স্পষ্ট করে দেয়, জার্মান রাজনীতিকদের সবকিছু নতুন করে গোছাতে হবে৷ এএফডি সংসদে ঢুকে পড়েছে৷ ফলে বুন্দেসটাগ বা জার্মান সংসদের চেহারা এবার অনেকটাই বদলাবে৷ বদলাবে সংসদের সংস্কৃতি৷ গ্রিন পার্টির রাজনীতিক চেম ও্যজদেমি'র অসাধারণ বক্তৃতা ইতিমধ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছে, কীভাবে ঘৃণা এবং বিতারণের রাজনীতির সঙ্গে জুঝতে হবে৷ তুরস্কের শরণার্থীর সন্তান ও্যজদেমি বুঝিয়ে দিয়েছেন, পুরনো নাৎসি ভাবাদর্শ নয়, জার্মানির সংস্কৃতি, সম্মান, ঐতিহ্য আসলে জড়িয়ে সকলকে একসঙ্গে নিয়ে বাঁচার মধ্যে৷ অনেকদিন এত সুন্দর বক্তৃতা শোনা যায়নি জার্মান রাজনীতিকদের মুখ থেকে৷ যুক্তি দিয়ে লড়াই করতে হবে৷ একসময় বলা হতো, জার্মান রাজনীতিতে বিকল্প নেই৷ সেই দিন শেষ৷ একদিকে ভালো হয়েছে৷ শক্তিশালী প্রতিপক্ষ থাকলে সরকারে থাকা দলগুলি সচেতন থাকবে এবং মানুষের কথা ভাববে৷