বাংলাদেশ-ভারতে নানা কাজে বাঁশ ব্যবহার করা হয়৷ জার্মানিতে এবার বাঁশের তৈরি সাইকেল নজর কাড়ছে৷ টেকসই উন্নয়নের দৃষ্টান্ত হিসেবে আফ্রিকার দেশ ঘানায় সেই সাইকেলের কাঠামো তৈরি হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির উত্তরে কিল শহরে সাইকেল ছাড়া দৈনন্দিন জীবন আর ভাবাই যায় না৷ তা সত্ত্বেও মাইবু কোম্পানির সাইকেল সত্যি চোখে পড়ার মতো৷ কারণ সেগুলির ফ্রেম বা কাঠামো বাঁশ দিয়ে তৈরি৷ মানুষের প্রতিক্রিয়া শুনে তাঁরা আমোদ পান৷ সবাই জানতে চায় এই সাইকেল মজবুত কিনা৷ অনেকে টোকা মেরে দেখতে চায়, সত্যি বাঁশ তো? নাকি ধাতুর উপর বাঁশের মতো রং লাগানো হয়েছে? সাইকেল দেখে এই দুটি প্রতিক্রিয়াই সবচেয়ে বেশি শোনা যায়৷
২০১২ সালে বাঁশের প্রতি মাক্সিমিলিয়ান শাই ও ইয়োনাস স্টলৎসকে-এর আগ্রহ জাগে৷ ছাত্র হিসেবেই তাঁরা ‘মাইবু' নামের কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ ঘানায় টেকসই সাইকেল তৈরি করে ইউরোপে বিক্রি করাই ছিল সেই ব্যবসার মূলমন্ত্র৷ জার্মানির উত্তরে এক উৎপাদনকেন্দ্রে সাইকেলগুলি বিক্রির জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করা হয়৷ মাইবু কোম্পানির মাক্সিমিলিয়ান শাই বলেন, ‘‘ঘাস হিসেবে বাঁশের তন্তুকে লংগিটিউডিনাল ফাইবার বলা হয়৷ সাইকেলের প্রচলিত উপকরণের তুলনায় এটি একেবারে ভিন্ন৷ বাইরের অংশ শক্ত হলেও নমনীয় এই তন্তুর কল্যাণে কাঠামো খুব হালকা হয়৷ মনে রাখতে হবে, এশিয়ায় ঘরবাড়ি নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত বাঁশের কাঠামো অনেক উঁচু হওয়া সত্ত্বেও দমকা বাতাসের মুখেও নমনীয় ও স্থিতিশীল থাকে৷ সে কারণেই এশিয়ায় নির্মাণকাজের কাঠামো এবং আমাদের এখানে সাইকেলের কাঠামো তৈরি করতে বাঁশ ব্যবহার করা হয়৷''
জার্মানির রাজপথে বাঁশের তৈরি সাইকেল
04:20
ঘানায় এক স্থানীয় প্রকল্পের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে এই কোম্পানি কাজ করে৷ এর আওতায় ঘানায় সাইকেলের ফ্রেম তৈরির কারখানা তৈরি করা হয়েছে৷ গোটা অঞ্চলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপাদান হিসেবে বাঁশ ব্যবহার করা হয়৷ মাত্র তিন বছরের মধ্যেই নতুন করে বাঁশ গজায়৷
প্রত্যেকটি ফ্রেম হাতে করে তৈরি করতে প্রায় ৮০ ঘণ্টা সময় লাগে৷ এই কাজের কারণে প্রায় ৪০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে৷ উৎপাদনের কাজে যেটুকু মুনাফা হয়, একটি স্কুল তৈরির কাজে তা ব্যয় করা হয়৷ মাক্সিমিলিয়ান শাই বলেন, ‘‘আমরা কিন্তু বড়াই করতে চাইনি, যে ঘানায় আমাদের নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে৷ বরং সমানাধিকারের ভিত্তিতে ঘানায় আমাদের সহযোগী রয়েছে৷ ঘানায় উৎপাদন হয়, পরিচালনার রাশও সেখানেই থাকে৷ সেই উপাদানও ঘানায় তৈরি হয়৷ আমাদের সহযোগীরা সেখানকার মানুষ, সংস্কৃতি, রীতিনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল৷ ব্র্যান্ড হিসেবে আমরা সেই কাঠামো ইউরোপে নিয়ে আসি এবং চূড়ান্ত রূপ দেই এবং বিক্রি করি৷''
বাঁশের সাইকেল তৈরি
বাঁশ সাধারণত তার স্থায়ীত্ব এবং নির্মাণ কাজে ব্যবহারের জন্য প্রসিদ্ধ৷ বার্লিন ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান এই বাঁশ দিয়ে তৈরি করছে সাইকেল৷
ছবি: Guy Degen
দুই উদ্ভাবক
বার্লিনের একটি সাইকেল কোম্পানির নকশাকার ডানিয়েল ফোগেল-এসেক্স (বামে) স্টেফান ব্রুনিং (ডানে)-এর সঙ্গে মিলে একটি ওয়ার্কশপ চালু করেছেন৷ যেসব ক্রেতা বাঁশের তৈরি সাইকেল পেতে আগ্রহী তাদের জন্য কাজ করেন এই দুই তরুণ৷
ছবি: Guy Degen
ঝাঁকুনি কমায় বাঁশ
বাঁশের একটা বড় গুণ এর স্থায়ীত্ব৷ এর ভেতরে ও বাইরে যে আঁশ রয়েছে সেটা বাঁশকে যেমন শক্ত করে তেমনি রাস্তায় চলতে গিয়ে যে ঝাঁকুনি তৈরি হয় সেটাকে দমিয়ে রাখে৷
ছবি: Guy Degen
সহজে কাটা যায়
বাঁশের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো, একে খুব সহজেই করাত দিয়ে পরিমাণ মতো কাটা যায়৷ এরপর শিরিস কাগজ আর বার্নিশ দিয়ে সাইকেলে ব্যবহারের উপযোগী করা যায়৷
ছবি: Guy Degen
অবকাঠামো তৈরি
বাঁশের একটা নলের সঙ্গে আরেকটা জোড়া লাগিয়ে সাইকেলের অবকাঠামো তৈরির একটা বড় চ্যালেঞ্জ৷ এজন্য একেকজন একেক ধরণের পদ্ধতি ব্যবহার করে৷ কেউ ব্যবহার করে ইস্পাত আর কেউবা বার্নিশ, যা-তে মিশ্রিত থাকে শণজাতীয় উদ্ভিদের আঠা৷
ছবি: Guy Degen
সবকিছুই বাঁশের
মজার বিষয় হচ্ছে, ওয়ার্কশপে সাইকেল তৈরির উপাদান যেমন বাঁশের, তেমনি যেসব উপকরণ ব্যবহার করে বাঁশকে সাইকেল তৈরির উপযোগী করা হয়, সেগুলোও বাঁশেরই তৈরি৷
ছবি: Guy Degen
জনপ্রিয়তা পাচ্ছে
যারা নিজের জন্য বাঁশের তৈরি সাইকেল চান তাদের সহায়তা করতে সপ্তাহান্তে ওয়ার্কশপ চালু রাখেন এসেক্স ও ব্রুনিং৷ বাঁশের তৈরি এই সাইকেলের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ঘানা, জাম্বিয়া এবং সিংগাপুরে কিছু ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে, যারা সাইকেলের জন্য বাঁশের ফ্রেম তৈরি করছে৷
ছবি: Guy Degen
হাতেই তৈরি করতে হবে
এসেক্স বলছেন, বাঁশের সাইকেল হাতেই তৈরি করতে হবে৷ কারণ বড় শিল্পের মতো ঢালাওভাবে সাইকেল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাঁশ ঠিক মানানসই উপকরণ নয়৷
ছবি: Guy Degen
7 ছবি1 | 7
অন্য কয়েকটি কোম্পানিও প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে সাইকেল তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে৷ যেমন এই সাইকেলের কাঠামোর পাইপ লিনেন ফাইবার দিয়ে তৈরি৷ কিছু কোম্পানি এমনকি সাইকেলে কাঠের চাকাও ব্যবহার করে৷
বার্লিনে টোবিয়াস রুডল্ফ প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে সাইকেল তৈরি করেন৷ একটি মাত্র সাইকেল তৈরি করতে তাঁর অনেক ঘণ্টা সময় লাগে৷ তবে তাঁর মতে, পরিবেশবান্ধব এই সব উপাদান ধাতুর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামছে না৷ টোবিয়াস বলেন, ‘‘যতকাল প্রাকৃতিক উপাদান অনেক কষ্ট করে হাতে করে তৈরি করতে হবে, ততকাল সেটা সম্ভব নয়৷ এমন দাম রাখা সম্ভব নয়, যা সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের মধ্যে থাকবে৷''
মাইবু কোম্পানির বাঁশের তৈরি সাইকেলের দাম দেড় থেকে চার হাজার ইউরো হতে পারে৷ অনেক ক্রেতা গাড়ির বিকল্প হিসেবে এমন সাইকেল ব্যবহার করেন৷ যেমন একজন বলেন, ‘‘জানি, সাইকেলেরও বেশি দাম হয়৷ কিন্তু যখন জানলাম যে আমি সামাজিক ও টেকসই একটি প্রকল্পে সহায়তা করছি, তখন সাইকেলের জন্য প্রতিটি পয়সা সার্থক বলে মনে হয়৷''
বাঁশ দিয়ে তৈরি সাইকেল কি সত্যি টেকসই ভাবধারার সঙ্গে মানানসই? সাইকেলের কাঠামো যেভাবে ঘানা থেকে জার্মানিতে আনা হচ্ছে, তার প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্ন উঠতেই পারে৷ ইয়োনাস স্টলৎসকে বলেন, ‘‘আমাদের কাছে টেকসই উন্নয়নের তিনটি অংশ রয়েছে এবং সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ প্রথমত পরিবেশের বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে৷ সেইসঙ্গে একই গুরুত্বের সঙ্গে টেকসই সামাজিক ও অর্থনৈতিক মানদণ্ডও জরুরি৷''
মাক্সিমিলিয়ান শাই মনে করেন, ‘‘আমাদের ক্ষেত্রে এটা একটা ভালো আপোশ হয়েছে বলে মনে করি৷ আমরা সঠিক দিশায় পদক্ষেপ নিচ্ছি৷ সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা শতভাগ প্রভাব রাখতে পারি৷ পরিবেশবান্ধব মানদণ্ডেও আমরা অন্য সাইকেলের তুলনায় এগিয়ে রয়েছি৷''
প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি সাইকেল একদিকে পরিবেশ রক্ষা করছে, অন্যদিকে উন্নত ডিজাইনের ক্ষেত্রেও নিজস্ব জায়গা করে নিচ্ছে৷
ডরোটে গ্র্যুনার/এসবি
ইউরোপের সাইকেল-বান্ধব শহর
পরিবেশ-বান্ধব, স্বাস্থ্যকর আর সাশ্রয়ী- সব দিক দিয়েই বাহন হিসাবে এগিয়ে বাইসাইকেল৷ সেই চিন্তা মাথায় রেখে নিজেদের এলাকাকে সাইকেল-বান্ধব করেছে ইউরোপের বিভিন্ন শহর৷ সাইকেল-বান্ধব এমন কয়েকটি শহর সম্পর্কে জেনে নিন ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gentsch
কোপেনহেগেন
ডেনমার্কের রাজধানী শহরে রয়েছে ৩৫০ কিলোমিটারের সাইকেল নেটওয়ার্ক৷ সাইকেলকে মাথায় রেখে গড়ে তোলা হয়েছে ট্রাফিক ব্যবস্থাও ৷ সিগন্যালে সাইকেল নিয়ে অপেক্ষার জন্য আছে সুন্দর ব্যবস্থা৷ কোপেনহেগেনে ৬২ শতাংশ মানুষ সাইকেল চড়ে কাজে যান৷ সাইকেল-বান্ধব নগর গড়ার উদাহরণ হিসাবে ‘কোপেনহেগেনাইজ’ শব্দটি তাই জায়গা করে নিয়েছে ইংরেজি অভিধানে৷
সাইকেল-বান্ধব শহরগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে আছে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম৷ এখানকার সাইকেল-চালকেরা প্রতিদিন প্রায় দুই মিলিয়ন কিলোমিটার পথ চলেন৷ উটরেস্ট এলাকায় রয়েছে সবচেয়ে বড় সাইকেল পার্কিং, যেখানে সাড়ে ১২ হাজার সাইকেল রাখা যায়৷ ২০২০ সালের মধ্যে এটাকে ৩৩ হাজারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে কর্তৃপক্ষ৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/N. Economou
আন্টভের্প
বেলজিয়ামের আন্টভের্প শহরের সাইকেল পার্কিং অগণিত আর সেগুলোর অবকাঠামো অভিভূত করে সবাইকে৷ সাইকেলের পথ বাড়ানোর পাশাপাশি কেবল সাইকেল আর পথচারীদের জন্য তিনটি সেতু তৈরি করছে কর্তৃপক্ষ৷
ছবি: picture-alliance/Arco Images/P. Schickert
প্যারিস
কয়েক বছর ধরে সাইকেল নেটওয়ার্ক বাড়াচ্ছে প্যারিসের নগর কর্তৃপক্ষ৷ শহরের নানা জায়গায় রয়েছে বাইসাইকেল স্টেশন৷ পর্যটকেরাও সাইকেল নিয়ে ঘুরতে পারেন পুরো শহর৷ অন্যদিকে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সাইকেল ভাড়া নেওয়া সেখানে বেশ জনপ্রিয়৷
ছবি: picture-alliance/robertharding/S. Dee
মালমো
সাইকেলের জন্য অবকাঠামো বাড়াতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করছে সুইডেনের মালমো শহর৷ এখানে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার সাইকেলের রাস্তা রয়েছে৷ মালমো আর কোপেনহেগেনের মধ্যে ফেরি পারাপার সেখানকার বাইসাইকেল পর্যটনকে বেশ জনপ্রিয়তা দিয়েছে৷ কোথাও কোথাও হোটেলের সামনেই মিলবে সাইকেল স্টেশন আর ওয়ার্কশপ৷
ছবি: Ohboy
ট্রন্ডহেইম
নরওয়ের শহর ট্রন্ডহেইম৷ পাহাড়ি এই নগরে চালু আছে ‘ট্রাম্পে’ নামে পৃথিবীর সর্বপ্রথম বাইসাইকেল উঠানামার ব্যবস্থা৷ প্রতি ঘন্টায় সেখানে ৩০০ সাইক্লিস্টকে ১৩০ মিটার উচ্চতায় আনা-নেওয়া করা হয়৷ পাহাড়ি পথেও সাইকেল নিয়ে চিন্তা নেই, এর চেয়ে স্বস্তির আর কি হতে পারে!
ছবি: public domain
ম্যুনস্টার
জার্মানির ওয়েস্টফালিয়ার ম্যুনস্টার এলাকায় মানুষের চেয়ে সাইকেলের সংখ্যা বেশি৷ সাইকেলের জন্য চওড়া রাস্তা, পর্যাপ্ত পার্কিং আর সমতল ভূমির কারণে সেখানে এই দ্বিচক্রযান এতো জনপ্রিয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Thissen
বার্সেলোনা
২০০২ সালেও ভাড়ায় বাইসাইকেল পাওয়া যেত স্পেনের বার্সেলোনা শহরে৷ কেবল সাইকেলের জন্য রয়েছে ১৫৮ কিলোমিটার রাস্তা৷ অনেক জায়গায় গাড়ির গতি ঘন্টায় ৩০ কিলোমিটারে সীমাবদ্ধ রাখায় সাইক্লিস্টদের জন্য এলাকাটি বেশ নিরাপদ৷ পর্যটকেরা যাতে বাইসাইকেল নিয়ে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরে বেড়াতে পারেন, আছে সেই ব্যবস্থাও৷
ছবি: picture-alliance/imageBROKER/G. Guarino
বাসেল
সুইজারল্যান্ডের বাসেল অনেকটা সমতল এবং দর্শনীয় স্থানগুলোও কাছাকাছি৷ গ্রীষ্মে ‘স্লো আপ’ নামে গাড়িমুক্ত এলাকা ঘোষণা করা হয় সেটিকে৷ প্রচুর লোকের সমাগম হওয়ায় তখন ৩০ কিলোমিটার এলাকা নির্ধারিত রাখা হয় কেবল সাইক্লিস্টদের জন্য৷ একইসঙ্গে সাইক্লিস্টদের আনন্দ দিতে থাকে বহু আয়োজন৷
ছবি: picture-alliance/imageBROKER/M. Dr. Schulte-Kellinghaus