তরুণ সমাজ যদি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়ে তাহলে প্রশিক্ষণ সিস্টেমের কী হবে? সম্প্রতি প্রকাশিত শিক্ষা রিপোর্টে শিক্ষা-গবেষকরা এই প্রশ্নই তুলে ধরেছেন৷ ইন্টিগ্রেশন ও অন্তর্ভুক্তি নিয়েও সমালোচনা করেছেন তাঁরা৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানি জ্ঞানকেন্দ্রিক সমাজের পথে এগিয়ে যাচ্ছে৷ অন্তত শিক্ষাজগতের দিকে দৃষ্টি দিলে এই কথাই মনে হবে৷ গত বছর প্রথমবারের মতো পেশাগত শিক্ষার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেছেন বেশি শিক্ষার্থী৷ সম্প্রতি বার্লিনে উপস্থাপিত ২০১৪ সালের জাতীয় শিক্ষা-রিপোর্টে এই তথ্যই প্রকাশিত হয়েছে৷
প্রতিবেদনের লেখকরা সিস্টেমে একটা ‘গতি' এসেছে বলে উল্লেখ করেছেন৷ অন্যদিকে একটা ‘স্থির' অবস্থাও বিরাজ করছে বলে জানান তাঁরা৷ কেননা এই গতি যথেষ্ট বিস্তৃত নয়৷
জার্মানিতে শিক্ষার্থীরা যেভাবে বসবাস করেন
এর আগে কখনো প্রথম সেমিস্টারে এত ছাত্র দেখা যায়নি৷ ক্লাসে পড়াশোনার পাশাপাশি একটি থাকার জায়গাও তো চাই? থাকার জায়গা পাওয়া কিন্তু মোটেই সহজ ব্যাপার নয়৷ এই ছবিঘরের মধ্য দিয়ে জানা যাক কে কোথায় জায়গা পায়৷
ছবি: DW/V. Wüst
অনিশ্চয়তা
নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছে, কিন্তু হোস্টেলগুলোতে জায়গা নেই৷ এখন শিক্ষার্থীরা কি করবে? মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই তো চাই! একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে! মিউনিখ এবং ফ্রাংকফুর্ট সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর৷ বাভারিয়া রাজ্য একটি ঘর ভাড়া গড়ে ৪৯৩ ইউরো আর ফ্রাংকফুর্টে ৪২১ ইউরো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মায়ের কাছে থাকা
শতকরা ২৭ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনার সময় মায়ের কাছেই থাকে৷ এতে করে শুধু যে খরচ কম হয় তা নয়, মায়ের কাছে থাকার আরামই আলাদা৷ কাপড়চোপড় সবসময় ধোঁয়া থাকে আর ফ্রিজ থাকে ভর্তি, অর্থাৎ খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা নেই৷ তাছাড়া সন্তান যত বড়ই হোক না কেন বাবা-মায়ের কাছে তারা সবসময়ই আদরের৷
ছবি: Fotolia/Jeanette Dietl
জরুরি অবস্থায় জিমে থাকা
প্রথম সেমিস্টারে প্রায় সমস্যা হয় বড় শহরগুলোতে, বিশেষ করে মিউনিখ, কোলোন বা ফ্রাংকফুর্টে৷ এত ভাড়া দিয়ে অনেকের পক্ষেই বাসা নেওয়া সম্ভব হয় না, তাই অনেক সময় ক্যাম্পাসের জিমে একটি ম্যাট্রেস পেতেই রাতে ঘুমোতে হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হোস্টেলে জায়গা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার!
শতকরা মাত্র ১২ জন ছাত্র হোস্টেলে জায়গা পেয়ে থাকে৷ বেশিরভাগ সময় সেখানে দুই তিনজনকে একসাথে থাকতে হয়৷ কোলোনের একটি ছাত্রদের হোস্টেলের ভাড়া ২৩০ ইউরো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
থাকার জন্য কন্টেনার
৮০’র দশক থেকেই অনেক ছাত্র কন্টেনার-এ থাকা শুরু করে৷ কন্টেনার ঘরগুলো খুবই ছোট ছোট৷
ছবি: Manfred Kovatsch
নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে থাকা
কোনো কোনো মালিক তাঁদের ফ্যাক্টরি, হাসপাতাল বা স্কুলের ঘরগুলো একেবারে খালি রাখতে চান না৷ তাই অনেক সময় ছাত্রদের নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে সেখানে থাকতে দেন৷ তবে সেখানে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়৷ যেমন ধূমপান করা, কুকুর-বেড়াল পোষা বা কোনো ধরনের পার্টি করার অনুমতি থাকেনা সেখানে৷
ছবি: DW/L.Heller
বিদায় বাড়ি !
তবে সব শিক্ষার্থী কিন্তু বাবা-মায়ের সাথে থাকতে পারেনা কারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রায়ই থাকে বাড়ি থেকে অনেক দূরে৷ অর্থাৎ মায়ের হোটেল থেকে এবার বিদায়ের পালা!
ছবি: DW/V. Wüst
7 ছবি1 | 7
যেমন ৬০ শতাংশ তুর্কি তরুণীর কোনো পেশাগত শিক্ষা নেই৷ দশ বছর আগে প্রথম শিক্ষা রিপোর্ট বের হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ সমালোচনা করে বলেন গ্যোটিংগেন ইউনিভার্সিটির মার্টিন ব্যাথগে৷ এ জন্য শুধু সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক কারণই দায়ী নয়৷ এক্ষেত্রে জার্মান মালিক ও নিয়োগকর্তাদের ভূমিকাও কম নয়৷ অনেকের মনে অভিবাসীদের ব্যাপারে একট নেতিবাচক বদ্ধমূল ধারণা থাকে৷ আর তাই অভিবাসী প্রার্থীদের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ করেন তাঁরা৷ অবশ্য শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্বলতার কারণেও কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েন বিদেশি বংশোদ্ভূতরা৷ তরুণ অভিবাসীদের মধ্যে প্রায় ১৮ শতাংশের পেশাগত ডিগ্রি নেই৷ সারা জার্মানিতে এই হার ১০ শতাংশের মতো৷
ভারসাম্য বজায় রাখা
সাধারণ শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার মধ্যে ভারসাম্য বজায় না থাকলে কর্মজগতে সংকট দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করে দেন শিক্ষা গবেষকরা৷
জার্মানির দ্বৈত শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষানবিশের কাজ ও প্রশিক্ষণ কোর্সের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে৷ এছাড়া তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে জার্মানিতে৷ যা কর্মবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে৷ অন্যদিকে শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাচেলর ও মাস্টার্স ডিগ্রির প্রবর্তন কর্মক্ষেত্রে কীরকম প্রভাব বিস্তার করে, সেটাও দেখার বিষয়৷ এ সব কারণে দুই সিস্টেমের মধ্যে ‘যাতায়াত ব্যবস্থা' আরো খোলামেলা করতে হবে৷
জার্মানির শিক্ষামন্ত্রীও মনে করেন, বিশেষজ্ঞ শ্রমিকদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত করতে হবে৷ অন্যদিকে ডিগ্রি শেষ না করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য পেশাগত শিক্ষার পথ খোলা রাখতে হবে৷ এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো অর্জিত ডিগ্রিকে পারস্পরিক স্বীকৃতিপ্রদান৷ ভবিষ্যতে শিক্ষামন্ত্রণালয় এই ধরনের কর্মসূচির জন্য ১৩ মিলিয়ন ইউরো ব্যয় করবে৷
জার্মানিতে পেশাগত প্রশিক্ষণ
জার্মানিতে পেশাগত প্রশিক্ষণের বেশ নামডাক রয়েছে৷ তরুণ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা কিভাবে তাদের ভবিষ্যৎ পেশার জন্য নিজেদের তৈরি করে তারই কিছু নমুনা পাবেন এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture alliance/dpa
বিশেষভাবে তৈরি করা
ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ যে বিষয়েই নিন না কেন, মনে রাখতে হবে তা যেন যুগের প্রযুক্তির সাথে সম্পর্কিত হয়৷ এমন কিছু হয়, যে পেশার চাহিদা আছে সমাজে৷ এবং যে পেশায় নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করারও সুযোগ থাকে৷ সেভাবেই কিছুটা বুঝে-শুনে এবং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিজের পছন্দের পেশাকে বেছে নেওয়া প্রয়োজন৷
ছবি: Fotolia
ঘড়ি তৈরি
ঐতিহ্যগতভাবে ঘড়ি তৈরি বা ঘড়ি মেরামতের কাজও আজকের যুগে প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়৷ আর এই কাজটি অত্যন্ত নিপুণভাবে করতে হয়৷ ছবিতে মেয়েটিকে ঘড়ি তৈরির কাজে প্রশিক্ষণ নিতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: AP
বাড়ির ছাদে টালি বসানো
জার্মানিতে যে কোনো বাড়ির শুধু ছাদে টালি বসানো নয়, ছাদের যে কোনো কাজ করার জন্য রয়েছে আলাদা মানুষ, আলাদা মিস্ত্রি৷ এবং তাঁরা শুধু এই কাজটিই করে থাকেন৷ এই কাজের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণও নিতে হয়৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
নাপিত
অনেক রকম পেশা আছে যেগুলো আগে শুধু পুরুষরাই করতো৷ আস্তে আস্তে এ অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে৷ তবে কিছু কিছু চাকরি আজও আছে যেগুলো নারীরাই বেশি করেন৷ নাপিতের চাকরিটিও সেরকমই একটি, যা মেয়েরাই বহুদিন থেকে করে আসছেন৷
ছবি: AMH
ধাত্রী
বাচ্চা প্রসব করানোটাও এমন একটি চাকরি যা মেয়েদের জন্যই বরাদ্দ করা রয়েছে৷ জার্মানিতে এ কাজের জন্য তিন বছর প্রশিক্ষণ নিতে হয় এবং প্রশিক্ষণ শেষে তিনি হাসপাতালে চাকরি পান৷ অবশ্য কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে ধাত্রীর কাজ করতে চান, সেটাও সম্ভব৷ এখানে কয়েকজন ধাত্রীবিদ্যার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন৷ ট্রেনিং-এর সময় শিশুর পরিবর্তে পুতুল দিয়ে প্রসবকালীন নিয়মগুলো শেখানো হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কাঠমিস্ত্রি
জার্মানিতে অনেকেই কাঠমিস্ত্রির প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন, কারণ একাজে বেশ ভালো আয় করা সম্ভব৷ শুধু কাঠমিস্ত্রি নয়, জার্মানিতে যে কোনো কাজের মিস্ত্রির ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য৷ চাকরি পেতেও মিস্ত্রিদের তেমন বেগ পেতে হয় না জার্মানিতে৷ বিভিন্ন ছোট-বড় ফার্নিচারের দোকানে সব সময়ই কিছু কাঠমিস্ত্রি থাকেন৷
ছবি: AMH
কসাই বা ‘মিট কাটার’
মাংস কাটার জন্যও জার্মানিতে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে৷ প্রায় সব ধরণের হাতের কাজের জন্যই জার্মানিতে রয়েছে প্রশিক্ষণের স্কুল৷ ছবিতে একজন কসাইয়ের কাছে ছাত্ররা মাংস কাটার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে৷
ছবি: AMH
প্রশিক্ষণ স্কুল
এই স্কুলে বিভিন্ন পেশার জন্য নানা রকম তত্ত্বগত শিক্ষা দেওয়া হয় এবং পাশাপাশি বিভিন্ন স্কুলে পাঠানো হয় ‘প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস’-এর জন্য৷ সাধারণত এসব প্রশিক্ষণ দুই থেকে চার বছরের মধ্যে হয়ে থাকে৷ কোনো ধরণের প্রশিক্ষণ ছাড়া জার্মানিতে তেমন কোনো চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়৷ কারোর একটি প্রশিক্ষণ থাকলে, তাঁর জন্য চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়৷
ছবি: picture alliance/dpa
8 ছবি1 | 8
অন্তর্ভুক্ত করা উচিত
প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর কেন্দ্র ও রাজ্যের পক্ষ থেকে শিক্ষারিপোর্ট বের করা হয়৷ বর্তমান রিপোর্টটিতে বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের সুযোগ সুবিধা এবং জাতিসংঘের কনভেনশন অনুযায়ী সুস্থ ও শিক্ষাপ্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েদের একসঙ্গে ক্লাস করানোর বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে৷ বর্তমানে জার্মানিতে মোট স্কুল ছাত্র-ছাত্রীর ৬.৬ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় পাঁচ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর বিশেষ শিক্ষার বা স্পেশ্যাল এডুকেশনের প্রয়োজন৷
এদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ ‘বিশেষ স্কুলে' যায়৷ বাকিরা সাধারণ স্কুলে পড়াশোনা করে৷ অর্থাৎ তাদের আলাদা না করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷
সুস্থ ও প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের একসঙ্গে ক্লাস করানোর ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হলেও কয়েক বছর আগের তুলনায় এখন ‘স্পেশ্যাল স্কুলগুলিতে' আরো বেশি ছেলে-মেয়ে যায়৷ বলেন রিপোর্ট লেখকদের মুখপাত্র মার্কুস হাসেলবর্ন৷ এছাড়া ভাষা সমস্যার কারণে ‘বিশেষ স্কুলে' বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি৷ এর মধ্যে রয়েছে সার্বিয়া, লেবানন ও আলবেনিয়া থেকে আসা ছেলে-মেয়ে৷
তুলে দেওয়া ঠিক নয়
অবশ্য হাসেলবর্ন স্পেশ্যাল স্কুল তুলে দেওয়ার পক্ষপাতী নন৷ এই প্রসঙ্গে তিনি যুক্তরাজ্যের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন, যেটা বাস্তবসম্মত৷ সেখানে দুই শতাংশ স্কুল শিক্ষার্থী বিশেষ স্কুলে যায়৷ জার্মানিতে এই হার চার শতাংশ, যা খুব বেশি৷
রাজ্যের সংস্কৃতিমন্ত্রীদের প্রেসিডেন্ট সিলভিয়া ল্যোরমান জোর দিয়ে বলেন যে, তিনি শিক্ষার্থীদের ‘বাধ্যতামূলক অন্তর্ভুক্তির' পক্ষে নন৷ তবে প্রতিটি প্রতিবন্ধী শিশুরই সাধারণ স্কুল সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অধিকার আছে বলে মনে করেন তিনি৷
শিক্ষা প্রতিবেদনটিতে অর্থনীতি সম্পর্কে বলা হয়, এক্ষেত্রে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সুষ্ঠু প্রশিক্ষণনীতি করা হয়নি৷ ধাতব, কারিগরি ও ইলেকট্রনিক ক্ষেত্রে এবং স্বাস্থ্য ও সেবাবিভাগে বহু বছর ধরে শিক্ষানবিশি পদের অভাব রয়েছে৷ তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রেও প্রায় একই অবস্থা৷ শুধুমাত্র খাদ্য, রান্না, হোটেল ও রেস্তোরাঁ বিভাগে শিক্ষানবিশির কাজের প্রাচুর্য রয়েছে৷