জার্মানির সিরীয় চিকিৎসকদের স্বদেশে ফেরা
১৭ এপ্রিল ২০২৫
সিরিয়ার হামা শহরের অধিবাসী কানবাতের এপ্রিলে ওপেন-হার্ট সার্জারি করা হয়েছিল, যা আজকাল সিরিয়ায় প্রায় বিরল ঘটনার একটি।
বিগত ১৪ বছরে গৃহযুদ্ধে দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে এবং চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। তবে, জার্মানি থেকে আসা সিরীয় চিকিৎসকরা সম্প্রতি কানবাত সহ এমন অনেককে সবচেয়ে অভাবী রোগীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
মোহাম্মদ কানবাত ডিডব্লিউকে বলেন, "আমি কতটা খুশি এবং কৃতজ্ঞ তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আমাদের সন্তানেরা আমাদের সাহায্য করবে বলে আমরা দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম।"
তিনি আরো বলেন, "তারা আমাদের ভোলেনি। তারা আমাদের সাহায্য করতে ফিরে এসেছে।" তিনি মূলত যুদ্ধ চলাকালীন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সিরীয়দের কথা বলছিলেন।
যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঠিক কতজন সিরিয়ার চিকিৎসক দেশ ছেড়েছেন তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে সিরিয়ার প্রায় ৩০,০০০ চিকিৎসক দেশটির জনগণের জন্য কর্মরত ছিলেন। ২০২০ সালে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে সমীক্ষা করা হয়েছিল, তখন দেখা যায় এই সংখ্যা ১৬,০০০-এরও কম। নার্স, ফার্মাসিস্ট এবং ডেন্টিস্টের মতো অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরাও দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে অধিকাংশ জার্মানিতে আশ্রয় নিয়েছেন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৬,০০০-এর বেশি সিরীয় চিকিৎসক জার্মানিতে কর্মরত, যাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন হাসপাতালের সাথে যুক্ত। তবে পরিসংখ্যানে শুধুমাত্র সিরিয়ার পাসপোর্টধারী চিকিৎসকদের গণনা করা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, জার্মানিতে ১০,০০০-এরও বেশি সিরিয়ার চিকিৎসক থাকতে পারেন,কেননা তাদের মধ্যে অনেকেই এখন জার্মানির নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন এবং তাই তাদের বিদেশি কর্মী হিসেবে গণ্য করা হয় না।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন আগে জানিয়েছিল, যুদ্ধের পুর্বে সিরিয়া একটি মধ্যম আয়ের দেশ ছিল এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক সূচকগুলো মোটামুটি ভালো ছিল। তবে, যুদ্ধ চলাকালে আসাদ সরকার এবং তার রাশিয়ান মিত্ররা নিয়মিতভাবে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালায়। নিষেধাজ্ঞা এবং দুর্বল অর্থনীতির কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আরো অবনতি ঘটে।
গত বছর ডিসেম্বরের শুরুতে সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের পতনের পর, বেশ কয়েকজন সিরিয়ার চিকিৎসক একত্রিত হয়ে সিরিয়ান জার্মান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন সিজিএমএ প্রতিষ্ঠা করেন। জার্মানির ক্রেফেল্ডের হেলিওস হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির সিনিয়র চিকিৎসক নূর হাজ্জুরি জানান, চিকিৎসকদের একটি ছোট হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে শুরু, যেখানে তারা কীভাবে সাহায্য করতে পারেন তা নিয়ে আলোচনা করতেন৷ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটি পরে একটি ফেসবুক পেজে পরিণত হয় এবং অবশেষে মধ্য জানুয়ারিতে এসজিএমএ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে সংগঠনটিতে প্রায় ৫০০ সদস্য রয়েছে।
এপ্রিল মাসের শুরুতে, সিজিএমএ সদস্যরা তাদের প্রথম মিশন নিয়ে সিরিয়ায় যান। প্রায় ৮৫ জন সিরিয়ার চিকিৎসক সিরিয়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল্যায়ন এবং দেশজুড়ে অস্ত্রোপচার করছে।
জার্মানির ব্রেমার হাফেন হাসপাতালের নেফ্রোলজি ও ডায়ালাইসিস বিভাগের সিনিয়র ডাক্তার মুস্তাফা ফাহহাম ডিডাব্লিউ-কে বলেন, "আমি বেশ আনন্দিত। প্রত্যেক সিরিয়ানের মনে আসাদকে নিয়ে একটা ভয় ছিল। এখন সেই ভয় চলে গেছে। তাই আমি ভালো বোধ করছি এবং দামেস্কে থাকতে পেরে আমি খুশি, যেখানে আমি অবশেষে সিরিয়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উন্নত করতে পারছি।"
সিরিয়ার এই স্বেচ্ছাসেবক চিকিৎসকরা তাদের ভ্রমণের বেশিরভাগ খরচ নিজেরাই বহন করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে যাতায়াত এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার জন্য তহবিল সংগ্রহ। হাজ্জুরি ডি-ডাব্লিউকে জানায়, "অনেকেই তাদের ক্লিনিক থেকে অনুদান নিয়ে এসেছেন। একই সময়ে আমরা একটি অনলাইন তহবিল সংগ্রহ অভিযান শুরু করি, যার মাধ্যমে আমরা এক মাসের মধ্যে প্রায় ১,০০,০০০ ইউরো সংগ্রহ করতে সক্ষম হই। যার বেশিরভাগই ছিল জার্মানিতে কর্মরত সিরিয়ার চিকিৎসকদের অনুদান।স্থানীয় সিরিয়ার এনজিওগুলোও আমাদের সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করেছে।"
সিরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও এসজিএমএ চিকিৎসকদের কাজ করার অনুমতি দিয়ে সহায়তা করেছে। সিরিয়ার নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিউরোসার্জন মুসাব আল আলীও অতীতে জার্মানিতে কাজ করতেন এবং জার্মানির সিরিয়ান কমিউনিটি (এসজিডি)-র সাথে জড়িত ছিলেন।
বেশিরভাগ এসজিএমএ স্বেচ্ছাসেবক চিকিৎসক পুনরায় জার্মানিতে তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরে যাবেন। তবে, জার্মানিতে সিরিয়ার চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্টদের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, তাদের ৭৬% সদস্য স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছেন।
সিরিয়ার চিকিৎসকরা জার্মানির অতি-ডানপন্থি এবং অভিবাসন-বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, পাশাপাশি তারা সম্পূর্ণরূপে সিরিয়ায় প্রত্যাবাসিত হতে চাচ্ছেন। এই সিদ্ধান্তে জার্মানির স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। যদিও সিরিয়ার চিকিৎসকরা জার্মানিতে কর্মরত মোট চিকিৎসকের মাত্র ২% এবং তারা অধিকাংশই পূর্ব জার্মানির কম কর্মীবহুল হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোতে কাজ করছে।
ব্রেমারহাফেন হাসপাতালের চিকিৎসক ফাহহাম ডিডাব্লিউকে জানায়, "আমরা জার্মানিকে বিবেচনায় রেখেছি এবং অবশ্যই সব চিকিৎসক একসাথে চলে যাবে না।" তিনি আরো বলেন, "আমাদের সিরিয়ার প্রতিও আনুগত্য রয়েছে। তবে আমি বিশ্বাস করি, আমরা এমন একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে পারি, যেখানে আমরা দেশে সাহায্য করতে পারি এবং জার্মানির স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতিও পূরণ করতে পারি।"
এএনএস/ওমর আলবাম