জার্মান স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নেই, ডাক্তারের ফি নেই, ওষুধপত্র থেকে শুরু করে অস্ত্রোপচার নিখরচায়৷ বিমার প্রিমিয়াম নিজে দিতে না পারলে, সরকার দিয়ে দেয়৷ বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন স্বাস্থ্যবীমা পদ্ধতি আজও সক্ষম৷
বিজ্ঞাপন
বিনা প্রিমিয়ামের জাতীয় স্বাস্থ্য বিমা যেসব দেশে আছে, সেসব দেশের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি৷ কিছুটা যেন ‘তোমার কর্ম তুমি করো মা' কিংবা ‘ভাগের মা গঙ্গা পায় না' অবস্থা৷ পেশেন্টরা অপারেশনের জন্য ওয়েট করতে করতে শেষমেশ পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশে গিয়ে অপারেশন করিয়ে নেন৷
আমাকে স্বাস্থ্য বিমার জন্য দিতে হয় থোক মাইনের প্রায় ১৬ শতাংশ৷ বিমাটা জার্মানির শতকরা ৯০ ভাগ নাগরিকের মতো আমার জন্যও বাধ্যতামূলক৷ প্রতি মাসে মাইনে থেকেই বিমার প্রিমিয়াম কেটে আমার ‘ক্রাঙ্কেনকাসে' বা ‘সিকনেস ফান্ড'-কে পাঠিয়ে দেওয়া হয়; হাতে থাকে বিমা কোম্পানির প্লাস্টিক কার্ড৷
তবে সেই কার্ড সাথে থাকলে গলা ব্যথা থেকে শুরু করে করোনারি বাইপাস, এমন কোনো চিকিৎসা নেই যা আমি করাতে পারি না; এমন কোনো ডাক্তার নেই যার কাছে যেতে পারি না৷ অসুখ করলে, প্রথম ২৯ দিনের মাইনে দেয় এই স্বাস্থ্য বিমা৷ সমস্ত ওষুধপত্রের খরচ দেয় স্বাস্থ্য বিমা, যদিও নিজেকে তার সামান্য একটা অংশ দিতে হয়৷
ঢাকা মেডিক্যালের করুণ দশা
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ বাংলাদেশের অন্যতম বড় চিকিৎসা কেন্দ্র৷ সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের চিকিৎসার অন্যতম ভরসাস্থলও এটি৷ তবে গুরুত্বপূর্ণ এ হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষরা নানান সমস্যার সম্মুখীন হন৷
ছবি: DW
বহু পুরনো হাসপাতাল
ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংলগ্ন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল৷ ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল৷ সরকারি এ হাসপাতালটি ২০১৫ সালে প্রায় আট লক্ষ রোগীকে সেবা প্রদান করেছে৷
ছবি: DW
জরুরি বিভাগ
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রতিদিন ভিড় করেন অসংখ্য রোগী৷
ছবি: DW
ভিড় লেগেই থাকে
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের টিকেট কাউন্টারের সামনে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের ভিড়৷ স্বল্প খরচে চিকিৎসার জন্য এ হাসপাতালটি একটি ভালো জায়গা৷ মাত্র ১০ টাকা টিকেট এবং ১৫ টাকা ফি দিয়ে এ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি হতে পারেন একজন রোগী৷
ছবি: DW
ব্যস্ত চিকিৎসক
ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগে চিকিসায় নিয়োজিত দু’জন চিকিৎসক৷ প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসকের সঙ্কট রয়েছে হাসপাতালটিতে৷
ছবি: DW
প্রাথমিক চিকিৎসার পর...
জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা৷ এখানে প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা দেয়ার পর নির্দিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয় রোগীদের৷
ছবি: DW
মেঝেতে রোগী
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের একটি ওয়ার্ডের চিত্র৷ বিছানা না পাওয়ায় হাসপাতালের মেঝেতে শুয়েই চিকিৎসা নিতে হয় অনেককে৷
ছবি: DW
প্রতিদিন চারশ’ নতুন রোগী
এটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আরেকটি ওয়ার্ড৷ প্রতিদিন এ হাসপাতালটিতে কমপক্ষে চারশ নতুন রোগী ভর্তি হন৷
ছবি: DW
বারান্দায় রোগীর ভীড়
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত রোগী থাকায় হাসপাতালের বারান্দায়ও রোগীদের অবস্থান নিতে হয়৷ ২৬০০ শয্যার এ হাসপাতালটিতে দিনে ৩৬০০-৪০০০ রোগীর সেবা দিতে হয়৷
ছবি: DW
নিম্নমানের খাবার সরবরাহের অভিযোগ
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের জন্য সরবরাহ করা হচ্ছে খাবার৷ তবে এ খাবারের মান নিয়ে রোগীদের অনেক অভিযোগ আছে৷ অনেক রোগী অভিযোগ করেছেন, তাদের যে খাবার দেয়া হয়, তা খুবই নিম্নমানের৷
ছবি: DW
গরমে স্বস্তির সন্ধান
ওয়ার্ডের ভেতরে গাদাগাদি অবস্থা আর অস্বাভাবিক গরম৷ এই রোগীকে তাই তার স্বজনরা স্যালাইনসহ বাইরে নিয়ে এসেছেন একটু স্বস্তি দিতে৷
ছবি: DW
দালালদের খপ্পরে পড়েন অনেকে
প্যাথোলজিক্যাল বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিক্যালে সঠিক সেবা পান না রোগীরা৷ সেজন্য অনেক সময় দালালদের খপ্পরেও পড়তে হয় তাঁদের৷
ছবি: DW
11 ছবি1 | 11
বাড়ির ডাক্তার
ইনি সাধারণত পাড়ার ডাক্তার৷ তাদের চেম্বারে গেলে সেখানেই যাবতীয় প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অমুক টেস্ট আর তমুক কাউন্ট করা হয়৷ প্রয়োজনে ডাক্তার আমাকে পাঠান স্পেশলিস্টের কাছে৷ স্পেশালিস্টের কাছ থেকে রিপোর্ট আসে আমার ডাক্তারের কাছে বা কমপিউটারে৷ তা দেখবার পর ডাক্তার প্রয়োজনে আমাকে আবার ডেকে পাঠান৷ মোট কথা চিকিৎসা চলে, চলে নিয়মিত চেক-আপ৷
এখনও অবসর গ্রহণ করিনি, নয়তো জার্মানিতে একটা কথা আছে, প্রবীণরা যে অবসর গ্রহণ করেন, এমন নয় যে অবসর গ্রহণ করার পর তাঁদের ফুলটাইম পেশা হয়ে দাঁড়ায় অসুস্থ হওয়া; সপ্তাহের কাজের দিনগুলো কাটে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আর ল্যাবরেটরির টেস্ট আর ফিজিওথেরাপি, এই সব মহৎ কর্মে, মরার পর্যন্ত সময় থাকে না৷ ডাক্তারের কাছে গেলেই দেখতে পাই, আমাদের পাড়ার কিছু প্রবীণা ওয়েটিং রুমে হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে মনোযোগ দিয়ে ম্যাগাজিন পড়ছেন৷ ঘণ্টাখানেক বাদে একবার ডাক পড়ে ব্লাড দেবার৷ সকালটা কাটে চমৎকার৷ সাধে কি পরিসংখ্যান বলে, জার্মানরা ডাক্তারের কাছে যান গড়ে বছরে আঠেরো বার! সব দেখে-শুনে বুঝেছি, গরিব দেশের লক্ষণ হল, সেখানকার লোকজন অসুখ করলেও ডাক্তারের কাছে যায় না; আর বড়লোক দেশের মানুষজন অসুখ না থাকলেও ডাক্তারের কাছে যায়৷ ডাক্তাররাও প্রেস্ক্রিপশন দিতে দক্ষ, কোনো পেশেন্টকেই খালি হাতে ফিরতে হয় না৷
জার্মানদের স্বাস্থ্য সচেতনতার নমুনা
জার্মানরা খাওয়া-দাওয়া, ব্যায়াম বা নিয়মিত চেকআপ – যাই ধরুন না কেন, সব ব্যাপারেই বেশ স্বাস্থ্য সচেতন৷ তবে নারী, পুরুষ, পেশা বা বয়স ভেদে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে! দেখে নিন ছবিঘরে৷
ছবি: Fotolia/lithian
নারীরা কি বেশি সচেতন?
অসুস্থ বোধ করার ফলে শতকরা ৩৫ ভাগ জার্মান পুরুষ ডাক্তারের কাছে যান৷ আর নারীদের ক্ষেত্রে এই হিসেব শতকরা মাত্র ১৭,৩ ভাগ৷ কারণ নারীরা খাওয়া-দাওয়া, নিয়মিত চেক-আপ এবং সংক্রমক রোগের বিরুদ্ধে আগে থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করেন৷ এই তথ্যটি জানা গেছে স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র গ্ল্যাক্সো-স্মিথ-ক্লাইন’এর করা এক সমীক্ষা থেকে৷
ছবি: bilderbox
নারীদের ফলমূল বেশি পছন্দ
জার্মান পুরুষরা ফলমূল তেমন খান না৷ তবে নারীদের মধ্যে শতকরা ৫৩ ভাগই ফলের ভক্ত৷ এমনকি নারীদের মধ্যে অনেকে দু’বেলাই ফলমূল খান৷ তাছাড়া তরুণ-তরুণীদের অধিকাংশ আজকাল সরাসরি ফল না খেলেও ফল এবং সবজির তৈরি স্মুদি খেতে পছন্দ করে৷ জানা গেছে জার্মানির অন্যতম গবেষণা কেন্দ্র টিএনএস-এমনিড’এর করা এক জরিপের ফল থেকে৷
ছবি: Michael Urban/ddp
জার্মানদের বিষণ্ণতা বাড়ছে
জার্মানির স্বাস্থ্যবীমা কোম্পানির ডিএকে-র দেওয়া এক তথ্য থেকে জানা যায় যে, জার্মানিতে বিষণ্ণ রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে৷ সমীক্ষাতে জানানো হয়, মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা আগের তুলনায় বাড়লেও তার সঙ্গে বিষণ্ণতাও বাড়ছে৷
ছবি: Fotolia/Jochen Schönfeld
স্বাস্থ্য সচেতন জার্মানরা কেমন সঙ্গী চান?
ইন্টারনেট ‘ম্যাচ মেকিং’ বা পাত্র-পাত্রীর সন্ধান দেয়, এমন একটি সংস্থার করা গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে এক মজার তথ্য৷ সেখানে শতকরা ২৬ ভাগ পুরুষ এবং ১৯ ভাগ নারী জানায় যে, তাঁদের সঙ্গীর ‘ফিগার’ হতে হবে স্লিম৷ অন্যদিকে শতকরা ৩৪ ভাগ মানুষের স্বাভাবিক ফিগারের সঙ্গী বা সঙ্গিনীই পছন্দ৷
ছবি: Fotolia/Web Buttons Inc
ভেষজ চায়ের জনপ্রিয়তা বাড়ছে
জার্মানরা কফি-প্রিয় বলেই প্রসিদ্ধ৷ কিন্তু আজকাল জার্মানদের কাছে ভেষজ চা বা ফলের চায়ের জনপ্রিয়তাও বাড়ছে৷ বিশেষ করে পুদিনা পাতা, মৌরি এবং বিভিন্ন ফলের সুগন্ধ দেয়া চা ভীষণ পছন্দ করে জার্মানরা৷ এ বছর তো তারা ইতিমধ্যেই প্রায় ১৩,১ বিলিয়ন কাপ চা পান করেছেন, যা গত বছরের তুলনায় তিন শতাংশ বেশি৷
ছবি: Colourbox
অফিসিয়াল ট্যুর কী স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর?
এ তথ্যই জানা গেছে ট্র্যাভেল ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির করা এক সমীক্ষা থেকে৷ ট্যুরে থাকাকালীন কর্মীদের ফিটনেস সেন্টারে যাওয়া, কোনোরকম শরীরচর্চা বা হাঁটা-চলা হয় না৷ তাছাড়া শতকরা ৭৫ জনই নাকি ট্যুরের সময় বেশি মদ্যপান করেন৷ আবার ৪০ বছরের কম বয়সিরা ট্যুরে গিয়ে রেস্তোরাঁর অস্বাস্থ্যকর খাবার বেশি খান৷ অর্থাৎ যে যত বেশি ট্যুর করেন, তার স্বাস্থ্যের ক্ষতি তত বেশি হয়৷
ছবি: Colourbox
মজার তথ্য!
২০১৬ সালে কি মানুষের সর্দি-কাশি কম হচ্ছে? হ্যাঁ, তেমনটাই বলছে জার্মানির স্বাস্থ্যবীমা কোম্পানি টেকনিকার-এর করা এক সমীক্ষা৷ মজার ব্যাপার হচ্ছে, ২০১০, ২০১২ এবং ২০১৪ সালের তুলনায় ২০০৯, ২০১১ এবং ২০১৩ সালে, অর্থাৎ বেজোড় সালগুলোতে নাকি অনেক বেশি মানুষ সর্দি, কাশি বা ঠান্ডা লাগার কারণে কর্মস্থলে যাননি৷
ছবি: Colourbox
7 ছবি1 | 7
জার্মানরা মুঠো মুঠো ওষুধ খান, নাকি ডেট পার হয়ে গেলে সুবোধ বালকের মতো ডিস্পেনসারিতে গিয়ে ফেরৎ দেন, তা বলতে পারব না৷ তবে ‘ক্রাঙ্কেনকাসে' বা বিমা কোম্পানিগুলো একদিকে হাসপাতাল আর ওষুধের খরচ বাড়া, অন্যদিকে অপারেশনের সংখ্যা বাড়া নিয়ে বকে বকে গলা চিরে ফেলল - কে শোনে কার কথা৷ এমনকি ডাক্তারদের ওষুধের বাজেট করে দেওয়া হয়েছে: কোনো কোয়ার্টারে বাজেট শেষ হয়ে গেলে, ডাক্তারের চেম্বারের সহকারী মহিলারাই বলে দেন, ‘পরের কোয়ার্টারের গোড়ার দিকে আসবেন৷ তখন বাজেট থাকবে৷'
গরিব দেশে যেমন অভাব, বড়লোক দেশে তেমন অপচয়৷ তাই এখানে সকাল-বিকেল ডাক্তারের প্রেস্ক্রাইব করা বিভিন্ন বটিকাগুলো গলাধঃকরণ করার সময় ভাবতে হয়, এগুলো না গিললেই বা কি হতো? কলকাতার এক ডাক্তার বন্ধু আমার এই ধন্দের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘ও সব ছাইপাঁশ না গিলে, দেশে চলে আয়৷ এখানেও ভালো চিকিৎসায় মরতে কয়েক লাখের বেশি লাগে না৷'
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷