দুটো পথ খোলা ছিল ৷ এক, তালেবান ধরার আগে দেশত্যাগ, দুই, দেশে ভয়াবহ পরিণতির অপেক্ষা৷ শুরুতে যারা আফগানিস্তান ছেড়েছিলেন তারা ভালো আছেন জার্মানিতে৷ তবে বড় একটা অংশ এখনো তালেবানের নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পাওয়ার অপেক্ষায়৷
ছবি: Marc Tessensohn/Bundeswehr/dpa/picture alliance
বিজ্ঞাপন
আফগানিস্তানে বিদেশি সৈন্য মোতায়েন শুরু হয় ২০০১ সালের টুইন টাওয়ার হামলার পরে৷ জার্মানিও সৈন্য পাঠায় তখন৷ কিন্তু ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক মিশন সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করার পরই আফগানিস্তানের দখল নিয়ে নেয় তালেবান৷ জার্মান সৈন্যদেরও ফিরিয়ে আনা হয় তাড়াতাড়ি৷ জার্মানির সেনাবাহিনী এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর হয়ে কাজ করা আফগানদের নিয়ে আসার উদ্যোগও শুরু হয় তখন৷
গত জুনে জার্মানির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ন্যান্সি ফেজারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ২০ হাজারের মতো আফগান নাগরিক জার্মানিতে এসেছেন৷ তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে উন্নয়ন সংস্থা এবং জার্মান সেনাবাহিনীতে কাজ শুরু করেছেন বলেও জানান তিনি৷
কিন্তু যারা সময়, সুযোগের অভাবে এখনো আফগানিস্তান ছাড়তে পারেননি, তাদের কী হবে?
২০২১ সালে জার্মানির তখনকার চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল বলেছিলেন, ‘‘আফগানদের, বিশেষ করে যে আফগানরা
‘অধিকারহীন’ অসহায় আফগান নারীরা
২০২১ সালের আগস্টে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আফগানিস্তানের নারীদের নানা অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে তালেবান৷ সম্প্রতি নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অধিকারও কেড়ে নিয়েছে তারা৷
ছবি: AFP
বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ
বোরকা পরা এক নারী কান্দাহারের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসছেন৷ গত বুধবার, এক বিবৃতিতে আফগানিস্তানের সকল সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের নিষিদ্ধ করে তালেবান সরকার৷ এরপর থেকে নারীদের আর শ্রেণিকক্ষে যেতে দেওয়া হচ্ছে না৷
ছবি: AFP
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক নিয়ন্ত্রণ
বিবৃতি দেওয়ার পর কাবুলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক নিয়ন্ত্রণ করছে তালেবান৷ কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ হয়েছে৷ পুরুষ শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে গেছেন৷ আর কিছু পুরুষ শিক্ষক ধর্মঘট করছেন বলে জানা গেছে৷
ছবি: WAKIL KOHSAR/AFP/Getty Images
নিষেধাজ্ঞা আগে থেকেই
নারীদের বিষয়ে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা অবশ্য আগে থেকেই জারি ছিল৷ যেমন, তালেবান ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষ এবং প্রবেশপথ নারী পুরুষের জন্য আলাদা করা হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘ভবিষ্যতের উপর মারাত্মক প্রভাব’
গত অক্টোবর মাসে হাজার হাজার নারী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিল৷ কিন্তু নতুন এই নিষেধাজ্ঞার কারণে অনিশ্চয়তায় তারা৷ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘‘নারীদের উচ্চশিক্ষার উপর দেওয়া এই নিষেধাজ্ঞা শুধু মানবাধিকারের লঙ্ঘনই নয়, এমন পদক্ষেপ দেশের ভবিষ্যতের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে৷’’
ছবি: WAKIL KOHSAR/AFP/Getty Images
একা একা দূরে নয়
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বরের এক নির্দেশনা অনুযায়ী, আফগানিস্তানের নারীরা ৭২ কিলোমিটারের (৪৫ মাইল) চেয়ে বেশি দূরে একা যেতে পারবেন না৷ যেতে হলে সঙ্গে কোনো পুরুষকে রাখতে হবে৷তালেবান মিনিস্ট্রি ফর প্রোপাগেশন অফ ভার্চু অ্যান্ড দ্য প্রিভেনশনস অব ভাইস এক নির্দেশনায় কোনো চালক যাতে কখনো একা দূরে যেতে আগ্রহী নারীকে গাড়িতে না তোলেন সেই কথাও বলা হয়েছে৷
ছবি: Sayed Khodaiberdi Sadat/AA/picture alliance
টেলিভিশনে, মুভিতে চেহারা দেখানো যাবে না
টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রে নারীদের চেহারা দেখানোও সীমিত করেছে তালেবান৷ এই নির্দেশের ফলে কোনো নারী আর টিভি শো, নাটক বা চলচ্চিত্রে অংশ নিতে পারেন না৷ বিশেষ ক্ষেত্রে অংশ নিলেও নারীকে অবশ্যই হিজাব পরতে হয়৷এক প্রতিবেদনে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স জানিয়েছে, তালেবান ক্ষমতায় আসার পর অনেক নারীই মিডিয়া ছেড়েছেন৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Ariana News
নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয় অবলুপ্ত
২০০১ সালে নারীদের জন্য আলাদা একটি মন্ত্রণালয় খুলেছিল তখনকার সরকার৷২০২১ সালে ক্ষমতায় এসে সেই মন্ত্ণালয় বন্ধ করেছে তালেবান৷ ওপরের ছবিতে কাবুলের এক বেকারির সামনে দরিদ্র নারীদের মধ্যে রুটি বিতরণের দৃশ্য৷ রুটি দিচ্ছেন এক সাধারণ নাগরিক৷
ছবি: Petros Giannakouris/AP/picture alliance
‘বিশ্ববিবেকের জন্য লজ্জা’
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নারীদের উপর এমন নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে থাকে তালেবান৷ তবে তালেবানের এই নিষেধাজ্ঞায় প্রতিবাদে পিছপা হননি অনেকেই৷ গত নভেম্বরে নিজেরদের এই অবস্থা বিশ্বকে জানাতে এভাবেই প্রতিবাদে শামিল হন নারীরা৷ সেখানে এক নারীকে ইংরেজিতে লেখা ‘আফগান নারীদের ভয়াবহ অবস্থা বিশ্ববিবেকের জন্য লজ্জা’ প্লেকার্ড নিয়ে প্রতিবাদে অংশ নেন৷
ছবি: AFP
চেষ্টা করছে কেউ কেউ
তালেবানের শাসনে থাকা আফগানিস্তানের তরুণীরা শুধুমাত্র ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পায়৷ তবে এই ছবির তরুণীরা ভাগ্যবান৷ তালেবানের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ কম এমন কিছু প্রদেশে অবশ্য নারীরা নিষেধাজ্ঞা মানছে না৷
ছবি: AFP
9 ছবি1 | 9
সেনাসদস্যদের সহায়তায় কাজ করেছেন, নানা সাহায্য সংস্থাকে সহায়তা করেছেন, যারা পুলিশ বাহিনীতে কাজ করেছেন, তাদের আফগানিস্তান ছেড়ে আসতে সহায়তা করার এ উদ্যোগ চলতে থাকবে৷ যেসব মানুষ নিরাপদ এবং স্বাধীন গড়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছেন, তাদের নিরাপদ রাখার চেষ্টা বজায় থাকবে৷''
ওলাফ শলৎসের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেও তালেবানবিরোধী যুদ্ধে সহায়তাকারী অনেক আফগানকে জার্মানিতে নিয়ে আসার কাজ দ্রুত করা যায়নি৷ এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হিসেবে জার্মানির কৌশলগত ভুলের কথাও উঠে আসছে৷ বলা হচ্ছে, তালেবানবিরোধী আফগানরা প্রথমে পাকিস্তান, ইরান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তানের মতো প্রতিবেশী বা কাছের দেশগুলোতে আশ্রয় নেবেন, সেখান থেকে পরে তাদের নিয়ে আসা হবে- জার্মানির এই পরিকল্পনাই ছিল ভুল৷ কারণ, জার্মানি চাইলেও ওই প্রতিবেশী দেশগুলো আফগান শরণার্থীদের নিতে চায়নি৷
আফগানিস্তানে ঠাণ্ডায় ১৬০ জনের মৃত্যু
আফগানিস্তানে এখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা৷ তালেবান ক্ষমতা দখলের পর দেশটিতে ত্রাণ তৎপরতা কমে গেছে৷ এই অবস্থায় তীব্র শীতে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে৷ ১৬০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন৷
ছবি: ALI KHARA/REUTERS
প্রাণহানি
আনুষ্ঠানিক হিসেব বলছে, আফগানিস্তানে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় শুধু জানুয়ারি মাসেই ১৬০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন৷
ছবি: ALI KHARA/REUTERS
কাঠের বদলে প্লাস্টিক দিয়ে আগুন জ্বালানো
তীব্র শীত থেকে মুক্তি পেতে আগুন জ্বালানোর জন্য কাঠ কেনার সামর্থ্য অনেক আফগানের নেই৷ তাই তারা প্লাস্টিক পুড়িয়ে আগুন ধরাচ্ছেন৷ ছবিতে এক শিশুকে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ৭০ হাজারের বেশি গবাদিপশু মারা যাওয়ার কথা জানিয়েছে৷ অনেক আফগানের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল এসব গবাদিপশু৷
ছবি: ALI KHARA/REUTERS
মাইনাস ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস!
শীতে শরীর গরম রাখতে ক্রিকেট খেলছেন তারা৷ আফগানিস্তানে শীতের সময় তীব্র ঠাণ্ডা পড়ার ঘটনা অস্বাভাবিক নয়৷ তবে এবার ঘোর রাজ্যে মাইনাস ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা দেখা গেছে, যা স্বাভাবিক নয়৷ আবহাওয়া অফিস বলছে, তাপমাত্রা আরও কমে যেতে পারে৷
ছবি: ALI KHARA/REUTERS
বিপদে শিশুরা
আশুর আলি ও তার সন্তানেরা কম্বল জড়িয়ে ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছে৷ আফগানিস্তানে এখন আন্তর্জাতিক সহায়তা পাওয়া কঠিন৷ ত্রিশ লাখ শিশু পুষ্টিহীনতায় ভোগার আশঙ্কায় আছে৷ আন্তর্জাতিক সংস্থায় আফগান নারীদের কাজের উপর তালেবান সরকার নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় ঐ সংস্থাগুলোর কাজ স্থগিত আছে৷
ছবি: ALI KHARA/REUTERS
সহায়তার অভাব
কিছু জায়গায় পানির পাইপ জমে গেছে৷ ঘরে হিটিং ব্যবস্থা না থাকায় কম্বল ও গরম কাপড় পরে ঠাণ্ডা মোকাবিলার চেষ্টা করছেন আফগানরা৷ এই অবস্থায় সাম্প্রতিক সময়ে জারি করা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে তালেবানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জার্মানির কর্মকর্তারা৷
ছবি: ALI KHARA/REUTERS
5 ছবি1 | 5
জার্মানির যে আফগানদের দ্রুত, নিরাপদে নিয়ে আসার ব্যাপারে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছিল না তা কেন্দ্রীয় আর্থিক সহায়তা ও উন্নয়ন মন্ত্রণালয় (বিএমজেড)-ও সম্প্রতি তা স্বীকার করেছে৷
মন্ত্রণালয়টি জানায়, পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতির অভাবের কারণে এতদিনে কমপক্ষে ১৫ হাজার মানুষকে বিএমজেড-এর উদ্যোগেই জার্মানিতে নিয়ে আসার কথা থাকলেও, আনা সম্ভব হয়েছে মাত্র ১১ হাজার ৬০০ জনকে৷
বাকি ৩৪০০ জনের মধ্যে মাত্র ১৬০ জন প্রতিবেশী দেশে সাময়িক আশ্রয় পেয়েছেন৷
এদিকে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক জানিয়েছেন, আফগানিস্তানে এখনো থেকে যাওয়া আফগানদের সহায়তার নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে জার্মানি৷ তিনি জানান, এ সহায়তা পাবেন মূলত নারী বা ধর্ম কিংবা যৌন-বৈচিত্র্র্যের কারণে নির্যাতন ও হুমকির মুখে পড়া আফগানরা৷
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অবশ্য এ উদ্যোগের সমালোচনা করেছে৷ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটি মনে করে, পাকিস্তান বা ইরান থেকে কেউ এ সহায়তা দাবি করতে পারবেন না- এর অর্থ হলো কিছু মানুষকে ঝুঁকি নিয়ে আফগানিস্তানে থাকতে বাধ্য করা৷