কাতার সন্ত্রাসে মদত দেয় – এই অভিযোগে দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের চারটি দেশ৷ তবে এখন সারা বিশ্বে সন্ত্রাস ছড়ানোয় সৌদি আরবের ভূমিকার বিষয়টিও খুব স্পষ্টভাবে উঠে আসছে৷
বিজ্ঞাপন
ব্রিটেনে সন্ত্রাসী হামলার পর থিংক ট্যাংক ‘হেনরি অ্যান্ড জ্যাকসন সোসাইটি' এক সমীক্ষায় সন্ত্রাসবাদে কোন কোন দেশ অর্থায়ন করে তার একটা তালিকা প্রকাশ করেছে৷ সেখানে কাতারের নাম এসেছে৷ তবে সৌদি আরবের নামটি এসেছে আরো জোরালোভাবে৷ লন্ডনভিত্তিক এই থিংক ট্যাংক স্পষ্ট করেই বলেছে, ‘‘বিশ্বের সব মুসলিম দেশ এবং পশ্চিমা দেশগুলোর মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝে ১৯৬০-এর দশক থেকেই ওহাবি ভাবধারার ইসলামকে ছড়িয়ে দিতে মাল্টিমিলিয়ন ডলার খরচ করে আসছে সৌদি আরব৷''
হেনরি অ্যান্ড জ্যাকসন সোসাইটি-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, সৌদি আরব এখনো ব্রিটেনে উগ্রবাদের বিস্তার ঘটানোর পেছনে ভূমিকা রাখছে৷ জরুরি ভিত্তিতে এমন তৎপরতা রোধের উদ্দেশ্যে ব্রিটেনের সব মসজিদ এবং ‘ইসলামি' প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে বিদেশি অর্থ সহায়তা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে হেনরি অ্যান্ড জ্যাকসন সোসাইটি৷
সৌদি ক্ষমতাকেন্দ্রে তারুণ্য
সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ বাদশাহ মহম্মদ বিন সালমান ‘এমবিএস’ নামেও পরিচিত৷ গত কয়েক বছরে ক্ষমতাকেন্দ্রে তাঁর উত্থান সবার নজর কেড়েছে৷ এই তরুণ নেতা সম্পর্কে এই তথ্যগুলো কি জানা আছে?
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Jensen
বাদশাহর আস্থাভাজন
অশীতিপর বাবা বাদশাহ সালমান কার্যত দেশের ক্ষমতা প্রিয় ছেলের হাতেই তুলে দিয়েছেন বলে অনেকে মনে করেন৷ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়াও তিনি পেট্রোলিয়াম কোম্পানি আরামকো ও দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন৷ উপ প্রধানমন্ত্রী পদও তাঁর দখলে ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Saudi Press Agency
ঝুঁকি নিতে ভয় পান না
প্রচণ্ড পরিশ্রমী বলে পরিচিত মহম্মদ বিন সালমান সৌদি শাসকগোষ্ঠীর এতকালের ধীরস্থির ভাবমূর্তি ভেঙে দিয়েছেন৷ অর্থনৈতিক সংস্কারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি এতদিনের নানা প্রথা ভেঙে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন৷ তাঁর সমর্থকরা মনে করেন, বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করতে দেশে এমন নেতারই প্রয়োজন৷
ছবি: picture-alliance/abaca/Balkis Press
পররাষ্ট্র নীতির পরিবর্তন
এতকালের সংযম ভেঙে ফেলে সৌদি আরব গোটা অঞ্চলে নিজস্ব স্বার্থরক্ষায় বেশ কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ ইরানের প্রতি বৈরি মনোভাব, ইয়েমেনে সেনা অভিযান থেকে শুরু করে কাতারকে একঘরে করে ফেলার সিদ্ধান্তের পেছনেও মহম্মদ বিন সুলতানের স্বাক্ষর স্পষ্ট৷ ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার স্থপতিও তিনি৷
ছবি: picture alliance / AP Photo
রাজপরিবারে উত্থান
সৌদি রাজপরিবারের জটিল ক্ষমতার কাঠামোর মধ্যে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের কোণঠাসা করে বাদশাহর ঠিক পরে শীর্ষ স্থানে পৌঁছানোর মতো অসাধ্যসাধন করেছেন ‘এমবিএস’৷ শুধু তাই নয়, এতকাল মনোনীত ‘ক্রাউন প্রিন্স’ মহম্মদ বিন নায়েফ (বামে) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও উপাধি খুইয়েও তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন৷
ছবি: Reuters/Saudi Press Agency
ব্যতিক্রমী জীবন
সৌদি রাজপরিবারের সন্তানরা সাধারনত বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন, কমপক্ষে মাস্টার্স ডিগ্রি পর্যন্ত পৌঁছে যান৷ মহম্মদ বিন সালমান সেই পথে না গিয়ে দেশে থেকেই আইন নিয়ে পড়েছেন এবং বাবার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছেন৷ বাদশাহ সালমান যখন নিজে ক্রাউন প্রিন্স ছিলেন, তখনও তিনি বাবার রাজসভার দায়িত্বে ছিলেন৷
ছবি: Getty Images
পেট্রোলিয়ামের উপর নির্ভরতা
সৌদি অর্থনীতি এতকাল তার বিশাল পেট্রোলিয়াম ভাণ্ডারের উপর নির্ভর করে ছিল৷ মহম্মদ বিন সালমান অর্থনীতির খোলনলচে বদলে ২০৩০ সালের মধ্যে সেই পরিস্থিতি বদলানোর উদ্যোগ শুরু করেছেন৷ ভরতুকিসহ অনেক সুযোগসুবিধা বন্ধ করে তিনি বেশ কিছু অপ্রিয় সিদ্ধান্তও নিয়েছেন৷
ছবি: Reuters/Ali Jarekji
ধর্মীয় অনুশাসন
সৌদি আরবের প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে এখনো কোনো বড় সংঘাতে যাননি মহম্মদ বিন সালমান৷ তবে দেশের বিশাল যুবসমাজের কথা ভেবে তিনি সংগীতের জলসা, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছেন৷ সেইসঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনের তত্ত্বাবধায়ক পুলিশের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Hilabi
7 ছবি1 | 7
এদিকে জঙ্গিবাদে মদত দেয়ার বিষয়ে সৌদি তৎপরতা নিয়ে জার্মানির ফ্রাংকফুর্টার রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক সুজানে শ্র্যোটারও ডয়চে ভেলের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন৷ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘হেনরি অ্যান্ড জ্যাকসন সোসাইটি যে তথ্য দিয়েছে, তা জেনে আমি মোটেই অবাক হইনি৷এটা দীর্ঘদিন ধরেই জানা বিষয় যে, সৌদি আরব ওহাবি ভাবাদর্শ রপ্তানি করে আসছে৷ '' তিনি বলেন, সৌদি অর্থায়নে জার্মানিতেও উগ্রবাদের বিস্তার ঘটছে৷ বিষয়টি পরিষ্কার করতে গিয়ে বেশ কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন সুজানে শ্র্যোটার৷ জার্মানির সালাফি নেতা পিয়েরে ফোগেল যে সৌদি আরবের দেয়া বৃত্তি নিয়ে মক্কা থেকে লেখাপড়া করে এসেছেন– সে বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন তিনি৷
নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা সামলাতে কতটা প্রস্তুত কাতার?
সৌদি নেতৃত্বে জোট কাতারের উপর প্রবল চাপ বজায় রাখছে৷ সে দেশ তাদের শর্ত পূরণ না করায় উত্তেজনা কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না৷ নিষেধাজ্ঞাসহ অন্যান্য পদক্ষেপের মুখে সে দেশ কতকাল মাথা উঁচু করে থাকতে পারবে?
ছবি: Getty Images/ANOC/M. Runnacles
একঘরে করে রাখার প্রচেষ্টা
জুন মাসের শুরুতেই কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ও পরিবহণ যোগাযোগ ছিন্ন করেছিল সৌদি আরব, বাহরিন, সংযুক্ত আরব আমিরাত৷ সন্ত্রাসবাদে মদত সহ একাধিক অভিযোগ আনা হয়েছে কাতারের বিরুদ্ধে৷ কাতার অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/K. Jaafar
শর্ত মানতে অস্বীকার
সৌদি নেতৃত্বে জোট কাতারের কাছে ১৩টি শর্ত পেশ করেছিল৷ আল জাজিরা নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া, ইরান ও তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রা কমানো সহ একাধিক দাবি পেশ করা হয়েছে৷ কিন্তু কাতার অনেক অভিযোগ সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়েছে, বাকিগুলির ক্ষেত্রে নতি স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়৷
ছবি: picture alliance/dpa/T.Brakemeier
নিষেধাজ্ঞার মোকাবিলা
সৌদি আরবের সঙ্গে স্থলপথে পরিবহণ যোগাযোগ ছিন্ন হবার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহে টান পড়েছে৷ পরিস্থিতি সামাল দিতে কাতার দ্রুত সমুদ্রপথে পণ্য সরবরাহের নতুন ব্যবস্থা করে ফেলে৷ ফলে অভাব-অনটন দেখা যায়নি৷ তবে আমদানি সংক্রান্ত ব্যয় অবশ্যই বেড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/shalome05
আর্থিক ও অর্থনৈতিক প্রস্তুতি
আচমকা নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশের আর্থিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় কিছু রদবদল করতে হয়েছে কাতারকে৷ স্থানীয় ব্যাংকে কোটি কোটি ডলার জমা দিয়ে এবং এলএনজি গ্যাসের উৎপাদন ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে আপাতত পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে ছোট্ট অথচ বিত্তশালী এই দেশটি৷ অতএব অদূর ভবিষ্যতে নিষেধাজ্ঞার ফলে তেমন ক্ষতির আশঙ্কা নেই৷
ছবি: imago/Photoshot/Construction Photography
নতুন নিষেধাজ্ঞার কালো ছায়া
সৌদি নেতৃত্বে জোট কাতারের উপর বাড়তি নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দিয়েছে৷ এর আওতায় ব্যাংকিং সম্পর্ক ছিন্ন করা হতে পারে৷ তাছাড়া যে সব কোম্পানি কাতারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে এই জোট৷ কাতার সেই ধাক্কা সামলানোরও প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ এক্ষেত্রে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ডাব্লিউটিও কাতারের সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারে৷
ছবি: Imago/H. Sobik
নিষেধাজ্ঞার সম্ভাব্য পরিণতি
বিপুল অংকের অর্থ ও সম্পদের ফলে কাতার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিতে পারবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন৷ গ্যাস ও অন্যান্য পণ্য বিক্রির পথে বাধা না এলে কিছু ধাক্কা সত্ত্বেও কাতারের অর্থনীতিও চালু থাকবে বলে তাঁদের ধারণা৷ সে দেশের সরকার এখন থেকেই নানা পদক্ষেপের কথা ভাবছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/E. Munoz Alvarez
ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঝুঁকি
বর্তমান সংকটের ফলে কাতারের ব্যাংকিং ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷ কারণ ব্যাংকগুলি অর্থের জন্য বিদেশের উপর বড় নির্ভরশীল৷ গত মে মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির প্রায় ৩৬ শতাংশ লায়াবিলিটি ছিল বিদেশিদের হাতে৷ সেই অর্থে টান পড়লে কাতারকে নানাভাবে ঘাটতি পূরণ করতে হবে৷ বিশেষ করে বিদেশে কাতারের কিছু সম্পত্তি বিক্রি করতে হতে পারে৷