বৃহস্পতিবার কাবুল থেকে শেষ জার্মান সামরিক বিমানের প্রস্থানের পরেও নানা পথে মানুষের উদ্ধারের কাজ চালিয়ে যাবার অঙ্গীকার করেছে জার্মানি৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস সপ্তাহান্তে প্রতিবেশী দেশগুলিতে যাচ্ছেন৷
বিজ্ঞাপন
আফগানিস্তানের পরিস্থিতির আচমকা অবনতির আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, বৃহস্পতিবার কাবুল বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলা তা প্রমাণ করে দিলে৷ এমন উত্তেজনার মাঝে সেদিন রাতে জার্মান বিমানবাহিনীর বিমান শেষবারের মতো জার্মান নাগরিক ও স্থানীয় আফগান কর্মীদের নিয়ে কাবুল ত্যাগ করলো৷ সংবাদ সংস্থা ডিপিএ-র সূত্র অনুযায়ী এ৪০০এম বিমানটি আহতদের উদ্ধারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিল৷ পরিকল্পনা না থাকা সত্ত্বেও সেটি সন্ধ্যায় কাবুলে অবতরণ করে৷
জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী আনেগ্রেট ক্রাম্প-কারেনবাউয়ার জানিয়েছেন, সব জার্মান কূটনীতিক, সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের কাবুল থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে৷ বৃহস্পতিবার আরো তিনটি উড়াল কাবুল ত্যাগ করে৷ প্রত্যেকটি বিমানের গন্তব্য ছিল উজবেকিস্তানের রাজধানী তাশখন্দ৷ প্রতিরক্ষামন্ত্রী আগেই সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন৷ শেষ উড়াল সম্পর্কে তিনি বলেন, সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতিতে এই অভিযান ছিল সবচেয়ে দ্রুত ও সবচেয়ে বিপজ্জনক৷ তিনি মনে করিয়ে দেন যে, অন্যান্য দেশের জন্যও কাবুলের পরিস্থিতি অত্যন্ত কঠিন৷
ক্রাম্প-কারেনবাউয়ার আরো বলেন, সামরিক বাহিনীর শেষ উড়ালের মাধ্যমে কাবুল থেকে উদ্ধারের কাজ মোটেই শেষ হয় নি৷ কোনো বিরতি ছাড়াই এই প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হচ্ছে৷ কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে কাবুল ত্যাগ করতে ইচ্ছুক মানুষদের প্রস্থান তরান্বিত করা হচ্ছে৷ জার্মান সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা এবারহার্ড সর্ন জানিয়েছেন, গত ১৬ই আগস্ট থেকে জার্মান সেনাবাহিনী ৪৫টি দেশের মোট ৫,২০০ মানুষকে উদ্ধার করেছে৷ এর মধ্যে ৪,২০০ আফগান ও ৫০৫ জন জার্মান নাগরিক৷
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস বলেন, আফগানিস্তানে যে সব মানুষের প্রতি জার্মানির দায়িত্ব রয়েছে, তাদের নিরাপদে রাখার কাজ এখনো চলছে৷ সে দেশে বসবাসরত সব জার্মান নাগরিকের সঙ্গে সরকার যোগাযোগ রেখে চলেছে৷ উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রস্থানের ক্ষেত্রে তাদের সহায়তা করা হচ্ছে৷ প্রতিবেশী দেশগুলির জার্মান দূতাবাসগুলিকে জার্মান সেনাবাহিনী ও সরকারের জন্য কর্মরত সেই সব আফগান কর্মীদের জার্মানিতে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আগেই যাদের সেই অনুমতি দেওয়া হয়েছিল৷ মাস রবিবার উজবেকিস্তান, পাকিস্তান ও তাজিকিস্তান সফরে যাচ্ছেন৷ জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হর্স্ট সেহোফার জানিয়েছেন, জার্মান সরকার আফগান সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য ও তালেবানের প্রতিশোধের ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাবে৷ তাঁর মতে, সেই লক্ষ্যে তালেবানের সঙ্গে সংলাপ চালানো জরুরি৷
কাবুলে মোতায়েন জার্মানিসহ অন্যান্য দেশের বাহিনী মার্কিন সেনাবাহিনীর সুরক্ষার উপর নির্ভরশীল৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩১শে আগস্টের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে অটল থাকার পর অন্যান্য দেশও তার আগে পাততাড়ি গুটানোর তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে৷ বৃহস্পতিবারের সন্ত্রাসী হামলার পর সেই তৎপরতা আরও জোরালো হচ্ছে৷
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল কাবুলে সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন৷ তিনি আফগানিস্তান ত্যাগ করতে ইচ্ছুক মানুষদের সহায়তা চালিয়ে যাবার অঙ্গীকার করেন৷ বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে ম্যার্কেল সপ্তাহান্তে পরিকল্পিত ইসরায়েল সফর মুলতবি করেছেন৷ শনিবার সন্ধ্যায় তার এই সফর শুরু হবার কথা ছিল৷
এসবি/এসিবি (ডিপিএ, রয়টার্স)
আফগানিস্তানকে ঘিরে চীন, পাকিস্তান, ভারতের নতুন ‘লড়াই’
লড়াইটা বেশি চলছে পর্দার আড়ালে৷ এ লড়াইয়ে পাকিস্তান আর চীন এ মুহূর্তে অনেক সুবিধাজনক অবস্থায়৷ তবে তালেবান ফিরে আসায় দুর্ভাবনায় পড়লেও ভারতও হাল ছাড়ছে না৷ ছবিঘরে বিস্তারিত...
ছবি: Hoshang Hashimi/AFP
তালেবান-পাকিস্তান সম্পর্ক
তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের সম্পর্ক সবসময়ই বেশ ভালো৷ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তালেবানকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সহায়তার অভিযোগ উঠেছে বহুবার৷ গনি সরকারবিরোধী যুদ্ধে তালেবানকে সহায়তার অভিযোগও আছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে৷ পাকিস্তান অবশ্য সে অভিযোগ অস্বীকার করেছে৷ ওপরের ছবিতে পাকিস্তানের খাইবার জেলার আফগানিস্তান সংলগ্ন তোরখাম সীমান্তে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিচ্ছে তালেবান ও পাকিস্তানের সেনারা৷
তালেবান প্রায় পুরো আফগানিস্তানের দখল নেয়ায় পাকিস্তানে নানা পর্যায় থেকে ব্যাপকভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়েছে৷ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, তালেবানের আগমনে আফগানিস্তান ‘দাসত্বের শৃঙ্খলমুক্ত হলো’৷
ছবি: Saiyna Bashir/REUTERS
পাকিস্তানে উচ্ছ্বাসের কারণ
নিউইয়র্কের ইথাকা কলেজের শিক্ষক রাজা আহমেদ রুমি বলেন, ‘‘পাকিস্তানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং টেলিভিশনে যে উল্লাস দেখা গেছে তার মূল কারণ আফগানিস্তানের ওপর ভারতের যে প্রভাব গড়ে উঠেছিল তা দূর হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়া৷’’ ১৯৪৭-এর পর থেকে ভারত এবং পাকিস্তান যে নিজেদের মধ্যে তিনবার বড় যুদ্ধে জড়িয়েছে এবং সে কারণে পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে যে ভারতবিরোধী মনোভাব কাজ করে তা-ও মনে করিয়ে দেন তিনি৷
ছবি: Rahmat Gul/AP/picture alliance
সম্পর্ক আরো ভালো করার চেষ্টা
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, তালেবানের সরকারের রূপরেখা তৈরির কাজে অংশ নিচ্ছেন পাকিস্তানের কয়েকজন কর্মকর্তা৷ এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, পাকিস্তান চায় আফগানিস্তানে অংশগ্রহণমূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক৷ তবে এ ক্ষেত্রে আফগান নাগরিকদেরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত বলে মনে করেন তিনি৷
ছবি: AFP via Getty Images
‘সময়মতো’ এগিয়ে এসেছে চীন
চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক দীর্ঘদিনের৷ অন্যদিকে ভারত-চীনের বৈরিতাও চলছে দীর্ঘদিন ধরে৷ ফলে তালেবানের আগমনে সেখানে ভারতের প্রভাব কমবে বলে চীনও খুশি৷ চীন বলছে, তালেবানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভালো রাখা জরুরি, কারণ, তালেবান শিনজিয়াং অঞ্চলকে ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ইটিআইএম) জঙ্গি সংগঠনের প্রভাবমুক্ত রাখার কাজে সহায়তা করতে পারবে৷
ছবি: Li Xueren/Xinhua News Agency/picture alliance
তালেবান প্রশ্নে চীন-ভারতের মিল!
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তালেবানের সার্বিক ক্ষমতাবৃদ্ধির প্রশ্নে চীন আর পাকিস্তানের অবস্থান বাস্তবে এক নয়৷ সিচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ-এর অধ্যাপক ঝ্যাং লি-ওর মতে, ‘‘পাকিস্তান যেমন আফগানিস্তানকে ভারতবিরোধী অবস্থানে দেখতে চাইবে, চীনের বেলায় এমন দৃষ্টিভঙ্গি অত্যাবশ্যক নয়৷ চীন সবার আগে চায় শিনজিয়াং অঞ্চলে কোনোভাবেই যাতে সন্ত্রাসবাদ বিস্তার লাভ না করে৷’’
ছবি: Reuters
চীনের ‘অস্বস্তি’
চীনের বিরুদ্ধে রয়েছে মুসলিম নিপীড়ন, বিশেষ করে উইগুরদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালানোর সুদীর্ঘ অভিযোগ৷ বেইজিং এ অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে সব সময়৷তালেবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হলেও এ বিষয়টি দু পক্ষের মধ্যে অস্বস্তি হয়ে থাকবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা৷
ছবি: Emrah Gurel/AP Photo/picture alliance
চীনের কাছে তালেবানের প্রত্যাশা
দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর অধ্যাপক ব্রহ্মা চেলানি মনে করেন, আফগানিস্তানে নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠার পর থেকে দু ধরনের সহায়তা জরুরি ভিত্তিতে চাইছে তালেবান৷ এক, তালেবান সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে কূটনৈতিক সহায়তা, দুই, অবকাঠামো নির্মাণ এবং সার্বিক অবস্থার উন্নয়নে অর্থনৈতিক সহায়তা৷ অধ্যাপক ব্রহ্মার মতে, চীন দুই ধরনের সহায়তা দিতেই এখন পুরোপুরি প্রস্তুত৷
ছবি: Hoshang Hashimi/AFP
সন্ত্রাসবাদে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতা এবং ভারতের আশঙ্কা
ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানে ঢুকে হত্যা করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনী৷ ১৯৯৯ সালে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া হয় আফগানিস্তানের কান্দাহারে৷ পাকিস্তানি তিন জঙ্গিকে জেল থেকে মুক্তি দেয়ার বিনিময়ে বিমানের যাত্রীদের ফেরত পেয়েছিল ভারত৷ অন্যদিকে বিমান ছিনতাইকারীদের নিরাপদে পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল তালেবান৷ আবার যাতে এমন ঘটনা না ঘটে তা নিশ্চিত করতে চায় ভারত৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ভারতের আরেক আশঙ্কা
গত ২০ বছর আশরাফ গনি সরকারের পাশে ছিল ভারত৷ এ সময়ে আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশেই উন্নয়নমূলক নানা ধরনের প্রকল্পে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে দেশটি৷ কাবুলে জাতীয় সংসদ ভবনও তৈরি হয়েছে ভারতের অর্থায়নে৷ মোদী সরকারের আশঙ্কা, তালেবান ক্ষমতায় আসায় সমস্ত বিনিয়োগ ‘ভেস্তে’ যেতে পারে৷
ছবি: courtesy PIB, Gov. of India
ভারতের কৌশলগত ভুল
যুক্তরাষ্ট্র যখন তালেবানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে, তখনো ভারত পুরোপুরি এবং শুধুই আশরাফ গনি সরকারের পাশে থেকে কৌশলগত ভুল করেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন৷ তাদের মতে, তালেবান একে একে আফগানিস্তানের সব রাজ্য দখলে নিতে শুরু করার পরও যে ভারত তালেবানবিরোধী বক্তব্যে অটল ছিল কূটনৈতিকভাবে তা-ও এখন ভুল প্রমাণিত৷
ছবি: courtesy PIB, Gov. of India
চীন, পাকিস্তান সুবিধাজনক অবস্থানে, তবু আশাবাদী ভারত
তালেবান ফেরায় আফগানিস্তানে পাকিস্তান এবং চীনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা স্পষ্টতই উন্মুক্ত৷ তবে ভারত একটু দেরিতে হলেও পরিস্থিতি বুঝে কৌশল পরিবর্তন করেছে৷ কাবুলে এক সময় ভারতের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা জয়ন্ত প্রসাদ মনে করেন, ভারত এখন সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য ‘লং গেম’ খেলবে, অর্থাৎ লম্বা সময় নিয়ে চেষ্টা করবে এবং তাতে তালেবানের সঙ্গে একটা সমঝোতার সম্পর্ক গড়া হয়ত সম্ভবও হবে৷