সুকুমার রায় লিখেছিলেন, ‘‘বয়স বাড়তির দিকে না, কমতির দিকে?'' এই সময়ে থাকলে তিনি লিখতেই পারতেন, সভ্যতা বাড়তির দিকে না, কমতির দিকে? এক সময় প্রথম বিশ্বের সভ্যতা মনে করতো, রাসায়নিক সার ব্যবহার করে কম জায়গায় বেশি ফসল উৎপাদনই সভ্যতা৷ সময় বদলে গেছে, ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল এবং জার্মানির বিভিন্ন শহর জৈব ফসল এবং খাবারের দিকে মন দিয়েছে৷ গবেষকরা বলছেন, অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারে ফসলের দ্রব্যগুণ তো নষ্ট হচ্ছেই, পাশাপাশি বাড়ছে নানারকম রোগের প্রকোপ৷ ফলে গত কয়েক দশক ধরে ইউরোপ ক্রমশ জৈব খাদ্যের দিকে ঝুঁকেছে৷ জার্মানির বেশ কয়েকটি শহর যা অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে৷ এর মধ্যে অন্যতম ন্যুরেমবার্গ৷ প্রত্যেক বছর সেখানে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া ছাত্রদের হাতে একটি হলুদ রঙের টিফিনবক্স ধরিয়ে দেওয়া হয়৷ তার মধ্যে থাকে জৈব ফসল থেকে তৈরি খাবার৷ বছরের প্রতিদিনই সেই টিফিন বক্সে শিশুদের জৈব খাবার দেওয়া হয়৷ শিশুদের বাবা-মায়েরা যাতে জৈব খাদ্যের দিকে আকৃষ্ট হন, সে কারণেই এ ব্যবস্থা৷
রাসায়নিক সার ও কীটনাশকে বাড়ে ফসলের উৎপাদন৷ কিন্তু এতে জমির যেমন দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয়, বাড়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিও৷ ফলে বিশ্বজুড়েই গড়ে উঠছে জৈবকৃষি আন্দোলন৷ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত ফসলের চাহিদা বাড়ছে বাংলাদেশেও৷
ছবি: DW/M. Rahmanদেশজুড়ে যখন রাসায়নিক সার ও জিনগতভাবে পরিবর্তন করা বীজ ছড়িয়ে পড়ছে, তখন স্রোতের উলটো দিকে যাচ্ছেন মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের কিষানি কমলা বেগম৷ নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন জৈব খামার৷ কমলা বেগম কেঁচোকে ব্যবহার করেন জৈবসার উৎপাদনে৷ ইংরেজীতে এই পদ্ধতিতে উৎপন্ন সারকে বলা হয় ‘ভার্মি কম্পোস্ট’৷ এই পদ্ধতিতে গাছের পাতা, খড়, গোবর, লতাপাতা, পচনশীল আবর্জনা খেয়ে কেঁচো মল ত্যাগ করে৷ সেই মল থেকেই তৈরি হয় কেঁচো সার৷
ছবি: DW/M. Rahmanবাড়ি বাড়ি ঘুরে সবজি, ফলমূলের উচ্ছিষ্ট জোগাড় করেন কমলা৷ সব একসাথে মিশিয়ে জমানো হয় একটি পাত্রে৷ একসময় সেই সবজি-ফলমূল পঁচে তৈরি হয় জৈব কম্পোস্ট৷ এসব উপাদানে প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান থাকে বলে তা জমির জন্য ক্ষতিকর হয় না৷
ছবি: DW/M. Rahmanস্থানীয়ভাবে ‘খোপ সার’ বলে পরিচিত হলেও দেশের অন্যান্য জায়গায় সাধারণভাবে এই সারকে গোবর সার হিসেবেই চেনেন কৃষকরা৷ গরুর গোবর, হাঁস-মুরগি ও ছাগলের বিষ্ঠা দিয়ে তৈরি হয় এই সার৷ জমির উর্বরতা বাড়াতে বিশেষ খ্যাতি আছে এই সারের৷
ছবি: DW/M. Rahmanযেসব বীজ প্রাকৃতিক উপায়ে গাছ থেকেই সংগ্রহ করা হয়, সেগুলোকে বলা হয় জৈব বীজ৷ তবে এখন বিভিন্ন উপায়ে জিনগতভাবে পরিবর্তন করে বীজ ছাড়া হয় বাজারে৷ এসব বীজ থেকে জন্মানো গাছ আগাছাপ্রতিরোধী এবং বিভিন্ন রোগ থেকে ফসলকে দূরে রাখে৷ কিন্তু এই বীজে উৎপাদিত ফসল স্বাস্থ্য এবং জমির জন্য ক্ষতিকর বলে উঠে এসেছে বিভিন্ন গবেষণায়৷ কমলা বেগম সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে বীজ সংগ্রহ করে ফসল ফলান৷
ছবি: DW/M. Rahmanশুধু সার ও বীজ থাকলেই হবে না৷ এর সঠিক প্রয়োগও জানতে হবে৷ কমলা বেগম জৈব সারের প্রয়োগ যাতে ঠিকমতো হয়, তা-ও নিশ্চিত করেন৷ শুধু জৈব সার ব্যবহার করে প্রায় দুই একর জমিতে গড়ে তুলেছেন আখ খেত৷ এছাড়াও ঢেঁড়শ, লাউসহ নানা ধরনের সবজির চাষ করেন তিনি৷
ছবি: DW/M. Rahmanরাসায়ানিক কীটনাশক ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া গেলেও, তাতে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও থেকেই যায়৷ ফলে কমলা বেগমের মতো অনেকেই ঝুঁকছেন জৈব কীটনাশকের দিকে৷ বিভিন্ন রকম গাছের পাতা, ছাল এবং বুনো ফল দিয়ে তৈরি হয় এই কীটনাশক৷ এই কীটনাশক ব্যবহার করে বেশ ফলও পাচ্ছেন সিঙ্গাইরের কৃষকরা৷
ছবি: DW/M. Rahmanক্ষতিকর পোকামাকড় দমনে কৃষক এখন নিজেই তৈরি করতে পারছেন ফেরোমোন ফাঁদ৷ এই পদ্ধতিতে একটি কৌটায় ফেরোমোন নামের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়৷ এর গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে পোকামাকড় এসে পড়ে কৌটার মধ্যে৷ জৈব পদ্ধতি না হলেও এতে ক্ষতি হয় একেবারেই কম৷ পুরো ক্ষেতে রাসায়নিক ছড়িয়ে না দিয়ে মাঝেমধ্যে শুধু ফেরোমোনের কৌটা পালটে দিলেই সম্ভব হয় পোকা দমন৷ এই পদ্ধতি এখন বাংলাদেশের কৃষকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷
ছবি: DW/M. Rahmanশুধু স্কুলেই নয়, হাসপাতাল, সংশোধনাগার এবং কোনো কোনো সরকারি দপ্তরেও একই কাজ করা হচ্ছে৷ শহরের প্রশাসনের বক্তব্য, দ্রুত ন্যুরেমবার্গকে একটি জৈব শহরে পরিণত করাই তাদের লক্ষ্য৷
শুধু ন্যুরেমবার্গ নয়, জার্মানির অন্যান্য শহরেও একই কাজ শুরু হয়েছে৷ অনেকের কাছেই ন্যুরেমবার্গ মডেল৷ মিউনিখ, ব্রেমেনের মতো শহরেও জৈব খাদ্যের দিকে যথেষ্ট নজর দেওয়া হচ্ছে৷ বাতিল হয়ে যাওয়া কারখানার জমিতে জৈব ফসলের চাষ শুরু হয়েছে বহু এলাকায়৷ বাড়িতে বাড়িতেও জৈব পদ্ধতিতে ফল কিংবা সবজি ফলানোয় উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে৷
পিছিয়ে নেই বার্লিনও৷ জার্মানির রাজধানী শহরে চাষের জমি নেহাতই অপ্রতুল৷ শহরের বিভিন্ন এলাকায় তাই ছোট ছোট বাগান তৈরির ব্যবস্থা করছে কোনো কোনো সংস্থা৷ নাগরিকেরা সেখানে গিয়ে জৈব পদ্ধতিতে ফল এবং সবজির গাছ লাগাতে পারবেন৷ বস্তুত, ইতিমধ্যেই বিষয়টি নাগরিকদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে বলে সূত্রের খবর৷ এ ধরনের উদ্যোগ আরো বেশি গ্রহণ করার কথাও ভাবা হচ্ছে৷
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এশিয়ায়, বিশেষত ভারত, বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলো সুজলা সুফলা৷ বরাবরই সেখানকার গ্রামে জৈব পদ্ধতিতে চাষ হয়ে এসেছে৷ কিন্তু সভ্যতার দাপটে সেখানে এখন রাসায়নিকের ছড়াছড়ি৷ ইউরোপের মতো এসব দেশও কি ফের জৈব চাষে ফিরবে? ভারতে বেশ কিছু অঞ্চলে ছোট ছোট পরিসরে জৈব ফসল উৎপাদন শুরু হয়েছে৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে ওই সব ফসলের চাহিদা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে৷
জার্মানরা কী খেতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন? জার্মান খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের ফরমায়েশি একটি জরিপে তার উত্তর আছে৷ পাওয়া যাবে ২০১৬ সালের পুষ্টি বিবরণে৷
ছবি: Colourboxজার্মানরা পিৎসা খেতে খুব ভালোবাসেন: এদেশের মানুষদের প্রিয় খাদ্যের তালিকায় পিৎসা বাদ পড়তে পারে না – জরিপে ১৪ শতাংশ উত্তরদাতা পিৎসা ভালো লাগে বলেছেন, তা সে রেস্টুরেন্টের হোক আর ডিপ ফ্রিজেরই হোক৷ জার্মান খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় ফরসা সামাজিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে জার্মানদের খাদ্যাখাদ্য নিয়ে জরিপ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন৷
ছবি: Colourboxউত্তরদাতাদের ১৫ শতাংশ স্যালাডের নাম করেছেন৷ আধুনিক কুইজিনে স্যালাড ছাড়া খাওয়াদাওয়ার কথা ভাবাই যায় না৷ অনেকে তো মেইন কোর্স হিসেবেই স্যালাড খান৷ জার্মানরা আরো স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে পড়ায় স্যালাড খাওয়ার ধুম বেড়েছে৷
ছবি: Colourboxজার্মানদের ১৬ শতাংশ যে মাছ খেতে ভালোবাসেন, তাই বা কে জানতো! ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড নাকি অতি স্বাস্থ্যকর, মাছে যা আছে৷ এ থেকে শরীরের রোগজীবাণু প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ে৷
ছবি: Colourboxজার্মানরা খুব সবজি খাচ্ছেন – এবং বকাঝকা ছাড়াই৷ ১৮ শতাংশ বলেছেন, শাকসবজি তাদের প্রিয় খাবার৷ কিরকম হেল্থ কনশাস দেখুন! শাকসবজিতে কত রকমের অ্যান্টিঅক্সিডান্ট, প্রোটিন, অন্যান্য পুষ্টিকর পদার্থ আছে, যা কিনা হার্টের অসুখ রুখতে সাহায্য করে৷
ছবি: Colourboxআলু আর মাংস হলো জার্মানির ট্র্যাডিশনাল খাবার৷ সবজির মতোই, ১৮ শতাংশ উত্তরদাতা আলুকে ফেলেছেন তাদের প্রিয় খাদ্যের পর্যায়ে৷ আলু পেট ভরায়, অথচ ক্যালরি কম৷ প্রথাগত জার্মান খাওয়া মানেই মাছ-মাংস, সবজি ও আলু৷
ছবি: Colourboxস্প্যাগেটি আর পাস্তা রানার্স-আপ হয়েছে বলা চলে – ৩৫ শতাংশ জার্মান এই সব নুডল ডিশ খেতে ভালোবাসেন, যদিও বেশি নুডল খেলে মেদ জমার আশঙ্কা থাকে৷
ছবি: Colourboxজার্মানরা ঘোরতরভাবে মাংসাশী৷ উত্তরদাতাদের ৮৩ শতাংশ জানিয়েছেন যে, তারা সপ্তাহে একাধিক বার মাংস খেয়ে থাকেন৷ মহিলাদের মাংসপ্রিয়তা দৃশ্যত পুরুষদের চেয়ে কম: পুরুষদের ৪৭ শতাংশের মাংস না হলে চলে না, মহিলাদের ক্ষেত্রে যা কিনা শুধু ২২ শতাংশ৷
ছবি: Colourbox করিন ইয়েগার/এসজি