বহু শীর্ষ গবেষক ও বিজ্ঞানী জার্মানিকে বিদায় জানাচ্ছেন৷ গবেষণা ও আবিষ্কার সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিশন বা ইএফআই-এর নতুন রিপোর্টে এই তথ্য জানা গিয়েছে৷ যা গবেষণা অঙ্গনে রীতিমত অসন্তোষ ও বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে৷
বিজ্ঞাপন
এটা কোনো অজানা বিষয় নয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য গবেষকদের জন্য আকর্ষণীয় দেশ৷ সেসব দেশে সুযোগ-সুবিধা ও ক্যারিয়ারের সম্ভাবনা চমত্কার, বেতন ভাল৷ এছাড়া সব কিছুই মানানসই৷ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কম৷
‘ব্রেইন ড্রেইন' হচ্ছে
অনেক গবেষক বিদেশে চলে যাওয়ার ফলে এক ধরনের ‘ব্রেইন ড্রেইন' দেখা দিচ্ছে জার্মানিতে৷ গবেষণার জন্য কিছুদিন অন্যদেশে অভিজ্ঞতা অর্জন করা গুরুত্বপূর্ণ৷ কিন্তু অনেকেই তারপর আর ফিরে আসেন না৷
গত ২০ বছরে জার্মান নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে অনেকেই বিদেশে বিশেষ করে অ্যামেরিকার হার্ভার্ড, ইয়েল, স্ট্যানফোর্ড কিংবা কলোম্বিয়া ইউনিভার্সিতে কাজ করছেন৷ এশিয়া ও ল্যাটিন অ্যামেরিকার শীর্ষ গবেষকরা শুধু ভাষায় কারণেই জার্মানির চেয়ে ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলিকে প্রাধান্য দেন৷
জার্মানিতে আসছেন কম
ইএফআই-এর নতুন রিপোর্টে বলা হয়েছে : জার্মানির সেরা গবেষকদের অনেকেই দেশ ছাড়ছেন, কিন্তু জার্মানিতে আসছেন সেই তুলনায় কম৷
বিষয়টি নতুন নয়, কিন্তু একেবারে সঠিকও নয়৷ ইএফআই-এর তথ্যমতে ১৯৯৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৩ হাজার গবেষক জার্মানি ছাড়েন, জার্মানিতে আসেন ১৯,০০০৷
সংখ্যাটা সঠিক হলেও হালনাগাদ করা হয়নি বলেন ‘হেল্মহল্জ অ্যাসোসিয়েশন অফ জার্মান রিসার্চ সেন্টার'-এর প্রেসিডেন্ট ইউর্গেন মিনেক৷ তাঁর মতে, গত ১০ বছরে জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এক্ষেত্রে শক্ত একটা ভিত তৈরি করেছে৷ গবেষণার অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে তারা৷
আকর্ষণীয় করার উদ্যোগ
গত বছরগুলিতে জার্মানিকে দেশি-বিদেশি গবেষকদের জন্য আকর্ষণীয় করার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷
সেরা শিক্ষার্থীদের রাজ্যসভা ভবনে থাকার সুযোগ
জার্মানির মিউনিখ শহরের কেন্দ্রস্থলে বাভেরিয়ার রাজ্যসভা ভবনে সেরা শিক্ষার্থীরা বিলাসবহুল জীবনযাত্রার সুযোগ পাচ্ছেন৷ সংসদ সদস্যদের কাছাকাছি থেকে অনেক কিছু শেখারও সুযোগ পাচ্ছেন তাঁরা৷
ছবি: Andreas Praefcke
৫০ জন সেরা শিক্ষার্থী
জার্মানির মিউনিখ শহরের কেন্দ্রস্থলে বাভেরিয়ার রাজ্যসভা ভবনে ৫০ জন সেরা শিক্ষার্থী বিলাসবহুল জীবনযাত্রার সুযোগ পাচ্ছেন৷ এঁদের মধ্যে এই দু’জন ভাগ্যবান শিক্ষার্থীও রয়েছেন৷
ছবি: Gerhard Brack
বিশাল প্রাসাদ
বিশাল প্রাসাদের লোহার গেট দিয়ে ঢুকছেন কালো ব্রিফকেস বগলে নিয়ে স্যুট পরা কোনো এক রাজনীতিবিদ৷ তাঁর গাড়ির পাশেই সাইকেল দাঁড় করিয়ে মাথায় বেসবল ক্যাপ পরে কোনো একজন ছাত্র প্রাসাদের ঐ একই গেট দিয়ে ঢুকছেন নিজের থাকার ঘরে৷
ছবি: Bayerischer Landtag
রাজকীয় ব্যাপার
প্রাসাদের ঝকঝকে মেঝেতে লাল কার্পেট, দেয়ালে সব বড় বড় পেইনটিং আর লম্বা করিডোর পেরিয়ে ছাত্রদের যেতে হয় নিজেদের ঘরে৷
ছবি: Bayerischer Landtag
দ্বিতীয় রাজা মাক্সিমিলিয়ন
১৮৫২ সালে বাভেরিয়ার দ্বিতীয় রাজা মাক্সিমিলিয়ন ছাত্রদের জন্য একটি ফাউন্ডেশন গঠন করেন৷ তাঁর লক্ষ্য ছিল মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার সুযোগ করে দেওয়া৷ ছাত্ররা বাবা-মায়ের আর্থিক সাহায্য ছাড়া এবং পড়াশোনার পাশাপাশি টাকা রোজগারের কোনো চিন্তা না করে পুরো মনোযোগ যেন লেখাপড়ায় খরচ করতে পারে৷
ছবি: picture alliance/akg
‘এক্সক্লুসিভ’ ছাত্রদের হোস্টেল
এই লক্ষ্য নিয়েই দ্বিতীয় রাজা মাক্সিমিলিয়ন সেরা ছাত্রদের জন্য এই বৃত্তির সুযোগ করে দেন৷ এটা জার্মানির ‘এক্সক্লুসিভ’ ছাত্রদের হোস্টেল৷ ছাত্র আন্দ্রেয়াস বলেন, ‘‘কারো প্রতিভা থাকলে এখানে তারা তাদের সে চাহিদা পূরণের সুযোগ পায়৷’’
ছবি: Fotolia/mylivi
বৃত্তি পাওয়ার প্রধান শর্ত
সংসদ সদস্যদের পাশে থেকে নিজেদের যোগ্য মানুষ হিসেবে তৈরি করার সুযোগ পাওয়ার জন্য এই ছাত্রাবাসে থাকার সুযোগ পাওয়া একেবারে সহজ ব্যাপার নয়৷ ‘‘এখানে বৃত্তি পাওয়ার প্রধান শর্ত, আবিট্যুর, অর্থাৎ স্কুল ফাইনালের ফলাফল হতে হবে ১,০ গ্রেড এবং নিজ স্কুল থেকে সুপারিশ করা চিঠি৷
ছবি: Bayerischer Landtag
চেয়ারম্যান হান্সপেটার বাইসার
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছেও ছাত্রদের প্রমাণ করতে হয় যে, তাঁরা শুধু স্কুলে মেধাবী ছাত্রই নন, তাঁরা অন্য ছাত্রদের চেয়ে ব্যক্তিত্ব সম্পন্নও৷ এছাড়া, থাকতে হবে সামাজিক সচেতনতাবোধ এবং বিভিন্ন কর্মতৎপরতায় নিয়োজিত করার মানসিকতা’, বলেন এই ছাত্রাবাস কমিটির সম্মানিক চেয়ারম্যান হান্সপেটার বাইসার৷
ছবি: Gerhard Brack
বিশাল ডাইনিং হল
হান্সপেটার বাইসার নিজেও একসময় এই বৃত্তি পেয়ে এই হোস্টেলেই ছিলেন৷ তিনি প্রতিদিন ঠিক দুপুর একটায় প্রাসাদের বিশাল ডাইনিং হলে বসার পর, ছাত্ররা যাঁর যাঁর আসন নেন৷ সবাইকে যে প্রতিদিন খাবার টেবিলে হাজির হতে হবে, তেমন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই৷ প্রতিবছরই কয়েকজন করে নতুন ছাত্রকে এই বিশেষ ছাত্রাবাসে থাকার জন্য বৃত্তির সুযোগ দেওয়া হয়৷
ছবি: Bayerischer Landtag
লোভনীয় লাইব্রেরি
ছাত্রী ইভা মনে করেন, ছাত্রাবস্থায় এমন রাজকীয়ভাবে থাকা খাওয়া বা জীবনযাপন অনেকের কাছেই স্বপ্নের মতো৷ তিনি আরো বলেন, পরীক্ষার আগে বেশিরভাগ সময়ই লাইব্রেরিতে কাটে, এখানেই অন্যদের সাথে আলোচনা হয়৷
ছবি: Bayerischer Landtag
মিউনিখের ম্যাক্সমিলেনিউম স্ট্রিট
বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব যেমন ফ্রান্স ইয়োসেফ স্ট্রাউস, যিনি দীর্ঘদিন বাভারিয়া রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তিনি এবং পদার্থবিদ্যায় নোবেল বিজয়ী ভ্যার্নার হাইসেনব্যার্গ-ও এই বিশেষ ধরণের বৃত্তি পেয়ে ছাত্রাবস্থায় এই বিলাসবহুল হোস্টেলে থাকতেন৷
ছবি: Andreas Praefcke
10 ছবি1 | 10
১১টি ইউনিভার্সিটিকে এলিট ইউনিভার্সিটি আখ্যা দেওয়া হয়েছে৷ এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য মিলিয়ন অঙ্কের অতিরিক্ত আর্থিক অনুদান নির্ধারণ করা হয়েছে৷ যাতে তারা বিজ্ঞান ও গবেষণা ক্ষেত্রে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে৷ এ সব কিছুই সেরা গবেষকদের বিদেশ থেকে দেশে ফিরিয়ে আনতে উৎসাহিত করবে৷
জার্মানির শিক্ষা গবেষণা মন্ত্রী ইওহানা ভাংকা বলেন, এই সব উদ্যোগের ফলে দেখা যাচ্ছে জার্মানি সারা বিশ্বের গবেষক, বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে৷ এমনকি নোবেল প্রাইজ বিজয়ীরাও ফিরে আসার অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন৷ যেমন ২০১৩ সালে চিকিৎসায় নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী টোমাস স্যুডহোফ স্বাস্থ্য গবেষণা ইন্সটিটিউটে গবেষণা করার জন্য বার্লিনে আসবেন বলে জানিয়েছেন৷ এতদিন কালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে কাজ করেছেন তিনি৷
অনেক কিছু করতে হবে
তবুও এক্ষেত্রে আরো অনেক কিছু করতে হবে৷ গবেষণা ও শিক্ষায় আরো বেশি অর্থ বিনিয়োগ করা হলেও এবং কয়েকটি ইউনিভার্সিটিকে ‘এলিট উনি' আখ্যা দেওয়া হলেও শিক্ষাঙ্গনের সেরা ব্যক্তিরা অ্যামেরিকা, গ্রেট ব্রিটেন, সুইজারল্যান্ড এমনকি ডেনমার্কেও যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷ সেসব দেশে ইংরেজি ভাষা চলে৷ জার্মানিতে কোনো কোনো বিষয়ে ইংরেজির প্রচলন মাত্র শুরু হয়েছে৷ এছাড়া গবেষক ও বিজ্ঞানীদের জন্য চাকরির চুক্তি প্রায় ক্ষেত্রেই তেমন আকর্ষণীয় নয় এখানে৷
ছয় মাসের চুক্তি নিয়ে কোনো গবেষক কি পরিবার নিয়ে হাইডেলব্যার্গ কিংবা হামবুর্গে আসতে আগ্রহী হবেন? এক্ষেত্রে যে আরো অনেক কিছু করার আছে৷ পাঁচ বছর পর হয়ত কিছুটা উন্নতি হবে৷ এমনই ধারণা ইএফআই-এর৷