ইতিমধ্যেই ‘‘জিহাদের এলাকায়’’, অর্থাৎ সিরিয়াতে শ’চারেক জার্মান যোদ্ধার খবর পাওয়া গিয়েছে৷ তাঁদের যাওয়াই শুধু নয়, পরবর্তীতে তাঁদের জার্মানিতে ফেরা নিয়েও কর্তৃপক্ষ বেশ শঙ্কিত৷ কিন্তু করার কিছু আছে কি?
বিজ্ঞাপন
অবশ্য সিরিয়ায় শুধু তথাকথিত ‘‘জার্মানরাই'' নয়, ৭৪টি দেশ থেকে আগত মোট বারো হাজার বিদেশি ‘‘সংগ্রামে'' সংশ্লিষ্ট৷ তাঁদের অধিকাংশই আরব বংশোদ্ভূত; বিদেশি যোদ্ধাদের মধ্যে হাজার আড়াই এসেছে পশ্চিমি দেশগুলো থেকে; আর জার্মানি থেকে আগত জিহাদিদের সংখ্যা চারশো – যদিও সেটাও আনুমানিক৷
বাস্তব সত্য হলো: জার্মানিতে তরুণ ইসলামি জঙ্গিদের একটা মহল শুধু গড়েই ওঠেনি, ক্রমাগত বেড়েও চলেছে৷ অপরদিকে জার্মানিতে চল্লিশ লাখ মুসলিমের বাস, কিন্তু সালাফিদের সংখ্যা পাঁচ থেকে দশ হাজারের বেশি নয় – যদিও তারা মানুষ তথা মিডিয়ার নজর কাড়তে জানে: কখনো বাজারে পবিত্র কোরান বিলি করে, কখনো কোনো মসজিদের কাছে জনসভা করে৷ এমনকি সমাজকর্মীদের মতো পথে পথে ঘুরে যুব-কিশোরদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাদের রংরুট বানানোর প্রচেষ্টাও করে থাকে এই সালাফিরা৷ তাদের সর্বাধুনিক ‘প্রচার' অভিযান সারা জার্মানিতে চাঞ্চল্য ও উষ্মার সৃষ্টি করেছে: ভুপার্টাল শহরে তাদের কয়েকজনকে ‘শরিয়া পুলিশ' লেখা প্লাস্টিকের উর্দি পরে ডিস্কো কিংবা বার-এর সামনে তরুণ-তরুণীদের ‘অনাচার' থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাতে দেখা গেছে৷
ইরাকে জিহাদিবিরোধী যুদ্ধ
চরমপন্থি ইসলামি সংগঠন আইএস-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে ইরাকে৷ সন্ত্রাসবাদী এ সংগঠনটির সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশেও তৎপরতা রয়েছে৷ দেখুন ইরাকে আইএস-বিরোধী যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট কিছু ছবি৷
ছবি: Reuters
টিকরিট পুনরুদ্ধারের চেষ্টা
সুন্নিদের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (আইসিস) উত্তর ও দক্ষিণ ইরাকের কিছু অংশ দখল করে নিয়েছে৷ বাগদাদ থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরের শহর টিকরিটও এখন তাদের দখলে৷ সে এলাকায় ইরাক সরকারের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য আইসিস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়ছে সেনাবাহিনী৷
ছবি: Reuters
মধ্যপ্রাচ্যে কর্তৃত্ব চায় আইসিস
আন্তর্জাতিক ইসলামি জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে আইসিস-এর একসময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ ২০০৬ থেকে ২০০৭-এর দিকে ইরাকে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই চলছে তখনই আইসিস-এর জন্ম৷ সংগঠনটির লক্ষ্য সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন এবং জর্ডান মিলিয়ে বেশ বড় একটা অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা৷ ইরাকে নুসরা ফ্রন্টসহ বেশ কিছু সংগঠন তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
বিদ্রোহীদের পাশে যুক্তরাষ্ট্র
সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ আর ইরাকে নুরি আল মালিকির সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদ্রোহীদের মধ্যে মধ্যপন্থি এবং মৌলবাদী সংগঠনের কর্মী রয়েছে৷ সিরিয়ায় ন্যাশনাল কোয়ালিশনের মতো কিছু মধ্যপন্থি সংগঠনকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র৷ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামা বিদ্রোহীদের একাংশকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছেন৷
ছবি: Reuters
ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি জানিয়েছেন, কংগ্রেস বিদ্রোহীদের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব অনুমোদন করলে তা সিরিয়া এবং ইরাকে দেয়া হবে৷ এই বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ, কেননা, ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বড় একটা অংশ যে আইসিস-এর কাছে যাবেনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই৷
ছবি: Reuters
কুর্দিরা চায় স্বাধীন কুর্দিস্তান
যুক্তরাষ্ট্র চায় ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকি সুন্নি এবং কুর্দিদের অংশিদারিত্বের সরকার গঠন করুন৷ ইরাকের কিছু অংশে কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন রয়েছে৷ কুর্দিরা ‘পেশমেরগা’, অর্থাৎ কুর্দিদের স্বাধিকার আন্দোলনের অংশ হিসেবে আইসিসের বিরুদ্ধে লড়ছে৷ কুর্দিদের মূল লক্ষ্য ইরাকে স্বাধীন কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠা করা৷
ছবি: Reuters
ইরানের ভূমিকা
ইরাকে শিয়া-সুন্নি সংঘাতের মধ্যে জড়াতে চায়না ইরান৷ কিন্তু শিয়া প্রধান দেশ ইরানের সরকার ইরাকের মালিকি সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে বলে ধারণা করা হয়৷ নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইসিস-বিরোধী যুদ্ধে মালিকি সরকারকে ড্রোন এবং অন্যান্য সমর উপকরণ দিয়ে সহায়তা করছে ইরান সরকার৷
ছবি: Atta Kanare/AFP/Getty Images
এক হাজারেরও বেশি নিহত
সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে সৌদি আরব৷ ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকি মনে করেন, আইসিসকেও মদদ দিচ্ছে সৌদি সরকার৷ ইরাকে চলমান সংঘাতে কমপক্ষে এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে৷ মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ জন্য ইরাক সরকার এবং আইসিস-এর কঠোর সমালোচনা করেছে৷
ছবি: Reuters
বাড়ছে শরণার্থী
আইসিসের হামলা শুরুর পর থেকে ইরাকের বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ১২ লাখ মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন৷ সিরিয়া সংকট শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত আড়াই লাখ সিরীয় স্বায়ত্তশাসিত কুর্দি রাজ্যগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে৷ এখন আইসিসের দখল করে নেয়া শহরগুলো থেকে পালিয়ে ইরাকিরাও আসছে৷ ছবিতে খাজাইর চেকপয়েন্ট অতিক্রম করে কুর্দিদের নিয়ন্ত্রিত শহর এরবিলের দিকে যেতে দেখা যাচ্ছে মসুল থেকে আসা ইরাকিদের৷
ছবি: Getty Images
স্বেচ্ছাসেবীরাও নেমেছে যুদ্ধে
প্রধানমন্ত্রী মালিকি জানিয়েছেন, রাশিয়া আর বেলারুশের কাছ থেকে পুরোনো যুদ্ধ বিমান কিনেছে ইরাক৷ আইসিসের বিরুদ্ধে সেগুলো ব্যবহার করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি৷ বাড়ছে সমরাস্ত্র৷ বাড়ছে যোদ্ধা৷ স্বেচ্ছাসেবীরাও যোগ দিচ্ছেন আইসিস বিরোধী যুদ্ধে৷
ছবি: Reuters
9 ছবি1 | 9
জিহাদিদের আকর্ষণ
এক পর্যায় যুব-কিশোরের কাছে সালাফি মতবাদ একটি স্পষ্ট কাঠামো ও স্পষ্ট ধ্যানধারণা এনে দেয় – বিশেষ করে সেই যুব-কিশোরের যদি নিজের জীবনকে অর্থহীন বলে মনে হয়, কিংবা সেই জীবনে অন্য কোনো ধরনের বাস্তব অথবা কাল্পনিক সংকট দেখা দিয়ে থাকে৷ সালাফিরা ঠিক সেই মুহূর্তে এসে তাঁকে সঙ্গ দেয়, সান্ত্বনা দেয়, ফিরিয়ে দেয় তাঁর আত্মসম্মান৷ অপরদিকে সালাফিদের কাছে এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো – সিরিয়া৷
সিরিয়া এবং ইরাক থেকে ইন্টারনেট প্রচারণার একটা স্রোত ভেসে আসছে জার্মানি অভিমুখে৷ ইসলামিক স্টেট-এর মিডিয়া বিভাগ সিরিয়া ও ইরাকে আইসিস বা আইএস-এর গতিবিধিকে দেখায় ঠিক অ্যাকশন ফিল্মের মতো – পেশাদারদের তৈরি করা অ্যাকশন ফিল্ম৷ সেই ফিল্ম দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে যদি কোনো হবু জিহাদি জার্মানি থেকে সিরিয়া যেতে চায়, তবে সে পথও অতি সোজা: তিন ঘণ্টা বিমানযাত্রার পর তুরস্ক; সেখান থেকে ‘সবুজ সীমান্ত' পার হয়ে সিরিয়ায় ঢুকলেই হলো৷
জার্মান জিহাদি
ইরাক কিংবা সিরিয়ার যুদ্ধে জার্মান জিহাদিদের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ তার মূল কারণ এই যে, জার্মান জিহাদিরা স্থানীয় আরব সংস্কৃতির সঙ্গে বিশেষ পরিচিত নয়; ফলে তাদের আচার-আচরণে নানা ভুলভ্রান্তি ঘটে থাকে৷ এছাড়া তারা যুদ্ধেও বিশেষ দড় নয়, কেননা জার্মান জিহাদিদের অধিকাংশ বাধ্যতামূলক সামরিক সেবায় পর্যন্ত অংশ নেয়নি৷ সেই কারণেই হয়ত জার্মান জিহাদিদের বারংবার আত্মঘাতী বোমারুর ভূমিকায় দেখা যায়৷
মাত্র এক মাস আগে জার্মানির ডিন্সলাকেন থেকে আসা ফিলিপ ব্যার্গনার মোসুল শহরের কাছে নিজেকে উড়িয়ে দেয় এবং সেই বোমায় আরো বিশজন মানুষের প্রাণ নেয় – ফিলিপ জাতে জার্মান, পরে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছিল৷ এ যাবৎ পাঁচজন জার্মান জিহাদি ইরাকে আত্মঘাতী বোমা আক্রমণ চালিয়েছে বলে জানা গেছে – তবে তাদের বাস্তবিক সংখ্যা সম্ভবত আরো অনেক বেশি৷
রোখার পন্থা
জার্মান জিহাদিরাও জার্মানির নাগরিক – এবং অনেক ক্ষেত্রে জার্মান নাগরিকদের সন্তান৷ তাদের এভাবে ইসলামিক স্টেট-এর হাতে তুলে দেওয়া যায় না, মরতে দেওয়া যায় না৷ আবার তারা যখন ‘যুদ্ধের' অভিজ্ঞতা নিয়ে জার্মানিতে ফেরে, তখন তারা তাদের স্বদেশের পক্ষেও বিপদ সৃষ্টি করতে পারে৷ কিন্তু তাদের সিরিয়া কিংবা ইরাক যাওয়া, অথবা জার্মানিতে ফেরা, দু'টোর কোনোটাই সংবিধানসম্মত উপায়ে রোখা সম্ভব নয় – অন্তত আপাতত নয়৷
ওদিকে জার্মানি উত্তর ইরাকের কুর্দ বা কুর্দিদের অস্ত্র দিতে চলেছে – যার অর্থ, জার্মানিতে প্রতিশোধমূলক আক্রমণের সম্ভাবনা বাড়বে৷ এবং সেই আক্রমণে যে সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তিত কোনো ‘জার্মান জিহাদি' জড়িত থাকবে না, তা-ই বা কে বলবে?