জার্মানি থেকে সেনা কমানোর ঘোষণা করে দিলেন অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর ক্ষোভের কারণ দুইটি। জার্মানি ন্যাটোর সিদ্ধান্ত মেনে প্রতিরক্ষায় খরচ করছে না। আর বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অ্যামেরিকাকে সুবিধা দিচ্ছে না
বিজ্ঞাপন
আশঙ্কাটা আগে থেকেই ছিল। এ বার সেই ঘোষণাটাও করে দিলেন অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। জার্মানিতে যে মার্কিন সেনা আছে তার সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হবে। জর্মানিতে এরপর ২৫ হাজার মার্কিন সেনা থাকবে।
জার্মানি থেকে সেনা কমাবার সিদ্ধান্ত কেন নিতে গেলেন অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট? ট্রাম্প বলেছেন, ''আমরা জার্মানিকে রক্ষা করছি, আর ওরা আমাদের অবহেলা করছে। এর কোনও মানে হয় না। আমরা জার্মানিতে সেনার সংখ্যা কমিয়ে ২৫ হাজার করে দেব। ওখানে সেনা বহাল রাখতে অ্যামেরিকাকে প্রচুর খরচ করতে হচ্ছে।''
ট্রাম্পের দাবি, ন্যাটোর সদস্য হিসাবে ২০২৪ সালের মধ্যে জিডিপির দুই শতাংশ প্রতিরক্ষাখাতে খরচ করার কথা জার্মানির। কিন্তু তা তারা করছে না। জার্মানি বলছে, ২০৩১ সালের মধ্যে তারা প্রতিরক্ষায় এতটা অর্থ খরচ করতে পারবে। বার্লিন যদি অর্থের পরিমাণ না বাড়ায়, তা হলে অ্যামেরিকা সেনা কমাতে থাকবে।
ম্যার্কেল ও মার্কিন প্রেসিডেন্টদের রসায়ন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির বিশেষ সম্পর্কের ভিত্তি যথেষ্ট মজবুত হলেও শীর্ষ নেতাদের সম্পর্কের রসায়নের উপর তার বিবর্তন অনেকটাই নির্ভর করে৷ আঙ্গেলা ম্যার্কেল তাঁর ক্ষমতাকালে চারজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের দেখা পেলেন৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
প্রথম সাক্ষাৎ
২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে আঙ্গেলা ম্যার্কেল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন৷ সে সময়ে জার্মান চ্যান্সেলর ছিলেন গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার৷
ছবি: AP
চ্যান্সেলর ও প্রেসিডেন্ট
২০০৮ সালের জুন মাসে বার্লিনের কাছে মেসেব্যার্গ-এ জার্মান সরকারের অতিথি নিবাসে মিলিত হয়েছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ৷ বুশ দুই দিনের সফরে জার্মানি এসেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/G. Bergmann
পারিবারিক পরিবেশে বুশ-ম্যার্কেল
২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় জর্জ ডাব্লিউ বুশ ম্যার্কেলকে নিজের খামারবাড়িতে স্বাগত জানান৷ স্ত্রী লরা ও ম্যার্কেলের স্বামী ড. ইওয়াখিম সাউয়ারকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই গাড়ি চালিয়েছিলেন বুশ৷
ছবি: AP
উষ্ণতার বহিঃপ্রকাশ
২০০৮ সালেই রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে জি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে জর্জ ডাব্লিউ বুশ আচমকা ম্যার্কেল-এর কাঁধ মালিশ করে বসেন৷ তাঁর এই স্বতঃস্ফূর্ত উষ্ণতার প্রকাশে ম্যার্কেল অবশ্য কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন৷
নতুন সম্পর্ক
২০০৯ সালে জার্মানির বাডেন বাডেন শহরে ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে আসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা৷ ম্যার্কেল তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
ম্যার্কেল-ওবামা রসায়ন
একই বছর ওয়াশিংটন সফরে জান ম্যার্কেল৷ ধীরে ধীরে ওবামা ও ম্যার্কেলের ব্যক্তিগত উষ্ণতা গড়ে উঠতে শুরু করে৷
ছবি: AP
বিশেষ সম্মান
২০১১ সালে ওয়াশিংটন সফরের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘মেডেল অফ ফ্রিডম’ হাতে পান আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ কিন্তু তার ঠিক পরে এনএসএ কেলেঙ্কারির ফলে ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে ম্যার্কেলের সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়ে পড়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নতুন পরিস্থিতি
২০১৫ সালে বাভেরিয়ার মনোরম পরিবেশে জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে আসেন ওবামা৷ ততদিনে ভ্লাদিমির পুটিনের সঙ্গে বেড়ে চলা সংঘাতের কারণে রাশিয়া একঘরে হয়ে পড়েছে৷
ছবি: Reuters/M. Kappeler
আবেগঘন বিদায়
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কার্যকালের শেষ পর্যায়ে বার্লিন সফরে আসেন বারাক ওবামা৷ পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে তিনি ম্যার্কেলের নাম উল্লেখ করেন৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
নতুন চ্যালেঞ্জ
২০১৭ সালটি অ্যামেরিকা ও জার্মানি – দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ জানুয়ারি মাসে ওয়াশিংটনে ক্ষমতায় এলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ ম্যার্কেলও আবার ক্ষমতায় এলেন।
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Kappeler/R. Sachs
বিরোধ
২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ট্রাম্পের আমলে অ্যামেরিকা ও জার্মানির মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। ন্যাটো নিয়ে ট্রাম্প ও ম্যার্কেলের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। ট্রাম্পের অ্যামেরিকা ফার্স্ট নীতিও ম্যার্কেল মানতে পারেননি। জার্মানি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করেছেন ট্রাম্প। ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে।
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Vucci
বাইডেনের আমলে
২০২১ সালে জি৭ বৈঠকের ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে ম্যার্কেলের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে। এবার ম্যার্কেল অ্যামেরিকা গেছেন। চ্যান্সেলার হিসাবে তার সম্ভবত এটাই শেষ সফর। বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকে করবেন তিনি। সেখানে কি সম্পর্কের বরফ গলবে?
ছবি: Adam Schultz/White House/Planet Pix/Zuma/picture alliance
12 ছবি1 | 12
ট্রাম্পের অভিযোগ হলো, বাণিজ্য ক্ষেত্রেও অ্যামেরিকার স্বার্থরক্ষা করছে না জার্মানি। তাই বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এবং ন্যাটোর দায়বদ্ধতা পালনের ক্ষেত্রে তাঁদের আচরণে অ্যামেরিকা ক্ষুব্ধ।
ট্রাম্প যে ভাবে সেনা প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছেন, তাতে ইউরোপীয়মিত্র দেশগুলির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে ট্রাম্পের দায়বদ্ধতা সম্পর্কেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। এই মাসের গোড়ায় মার্কিন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় যে, অ্যামেরিকা জার্মানি থেকে সেনা কমাবে। তারপর জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস বলেছিলেন, ডনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর অ্যামেরিকার সঙ্গে জার্মানির সম্পর্ক জটিল হয়েছে।
ট্রাম্প সেই ঘোষণা করার পর জর্মানিতে একমাত্র বামপন্থী দল ছাড়া কেউ এখনও তাকে স্বাগত জানায়নি। বাম দল চায়, অ্যামেরিকার একজন সেনাও যেন জার্মানিতে না থাকে।
জার্মানি কি সশস্ত্র ড্রোন ব্যবহার শুরু করবে?
জার্মানির কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী সশস্ত্র ড্রোন ব্যবহার করবে কিনা এ নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। কেনো এই বিতর্ক? জানতে দেখুন ছবিঘরটি।
ছবি: picture-alliancel/McPhoto/C. Ohde
অস্ত্র নয় পাখি
জার্মান সেনাবাহিনীতে বর্তমানে যেসব ড্রোন ব্যবহার করা হয়, সেগুলো কোন অস্ত্র বহন করে না। নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে এটিকে চালানো হয়। ফলে একটি পাখি আর এটির মধ্যে তেমন কোন তফাত নেই।
ছবি: picture-alliancel/McPhoto/C. Ohde
কেন সশস্ত্র ড্রোন?
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে জার্মান সেনাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্নেগ্রেট ক্রাম্প কারেনবাওয়ার। সেখানে কর্মরত জার্মান সেনারা চান অস্ত্রবহনকারী ড্রোন ব্যবহারের অনুমতি।
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Pedersen
সমালোচনা
প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এর পক্ষে মত দিলেও জার্মান প্রতিরক্ষাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ এবং পার্লামেন্টের বিরোধী দলগুলোর অনেকেই এর বিপক্ষে অবস্থান নেন।
ছবি: picture-alliance/dpa
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে জার্মানি প্রতিরক্ষার জন্য প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো সামরিক জোটের উপর নির্ভরশীল ছিলো। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে জার্মানি।
ছবি: AP
শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জার্মান সেনাবাহিনী মূলতঃ শান্তিরক্ষার কাজ করে। গত কয়েক দশক ধরে জার্মানি সামরিক খাতকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। সেনা সংখ্যা, প্রশিক্ষণ, আধুনিক অস্ত্র, সামরিক বাজেট –এসব ক্ষেত্র সব সময়ই কম গুরুত্ব পেয়েছে। ৯০ এর দশক থেকে জার্মান সেনাবাহিনী শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা শুরু করে।
ছবি: Imago Images/photothek/T. Wiegold
বুন্ডেসভের
চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত জার্মান কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষাবাহিনীতে সেনা সংখ্যা ১ লাখ ৮৪ হাজার ১৬৭। ৮০ হাজার ৬৯৬ জন সাধারণ নাগরিক।
ছবি: picture alliance/dpa
আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ
জার্মান সংবিধান কেবল আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধের অনুমতি দেয়। ১৯৫৫ সালের ১২ নভেম্বর তৈরি হয় বুন্ডেসভের বা কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী।
ছবি: picture-alliance/dpa/T. Frey
তিন দফায় বিতর্ক
সশস্ত্র ড্রোন নিয়ে বিতর্ক এই প্রথম নয়। এর আগে আরও দুই প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সশস্ত্র ড্রোন মোতায়েন নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। ২০১৭ সালের নির্বাচনের পরও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হঠেছিল জার্মান সরকার।
ছবি: Getty Images/S. Gallup
বিশেষজ্ঞ মতামত
বিশেষজ্ঞদের মতে, এইসব ড্রোন সেনা ঘাঁটিতে সরাসরি আঘাত হানতে সক্ষম, ফলে আন্তর্জাতিক আইন মেনে এটিকে মোতায়েন করা যেতে পারে। তবে কে কীভাবে এটাকে ব্যবহার করছে সেটাই মুখ্য।
ছবি: Sean Gallup/Getty Images
জার্মান আইন
জার্মানির আইন অনুযায়ী, প্রতিটি ড্রোন পরিচালনার ক্ষেত্রে আইনি নির্দেশনা মেনে কাজ করতে হবে। এমনকি অনুমতিও নিতে হবে ঠিক কখন ড্রোন হামলা চালাবে। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান, ইরাক আফগানিস্তানসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশে মার্কিন ড্রোন হামলায় হতাহতের কারণে সশস্ত্র ড্রোন মোতায়েনের বিপক্ষে অবস্থান বিরোধীদের।
ছবি: Philipp Guelland/Getty Images
10 ছবি1 | 10
তবে অ্যামেরিকায় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত এমিলি হাবের বলেছেন, ''জার্মানির রক্ষার জন্য মার্কিন সেনা সেখানে নেই। তারা সেখানে আছে আটলান্টিক পারের নিরাপত্তার জন্য এবং আফ্রিকা ও এশিয়ায় অ্যামেরিকার শক্তি দেখানোর জন্য।''
ট্রাম্পের এই ঘোষণা নিয়ে তাঁর নিজের দেশেই প্রবল সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। তাঁর নিজের দল রিপাবলিকান পার্টির নেতারাও এই সিদ্ধান্ত মানতে পারছেন না। ট্রাম্প ও তাঁর সহকর্মীদের চিঠি নিখে ম্যাক থমবেরি বলেছেন, ''এই সিদ্ধান্ত ন্যাটোর প্রতি মার্কিন দায়বদ্ধতাকে কম করবে। এতে রাশিয়ার সুবিধা হবে। তাদের আগ্রাসী মনোভাব বাড়তে পারে।'' ডেমোক্র্যাট সেনেটর জ্যাক রিডও বলেছেন, ''রশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুটিনকে আরেকটি সুবিধা করে দিলেন ট্রাম্প।'' রিপাবলিকান প্রতিনিধি লিজ চেরির মতে, ''অ্যামেরিকার স্বার্থেই জার্মানিতে সেনা থাকা প্রয়োজন। রাশিয়া ও চীন বিশ্ব জুড়ে স্বাধীনতা ও সুরক্ষার ওপর আঘাত হানতে পারে। সে জন্য ইউরোপে মার্কিন সেনার উপস্থিতি জরুরি।''