জার্মানি দ্বিধাবিভক্ত৷ অনেকেই চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সুবিখ্যাত উক্তি, ‘‘আমরা পারব!’’ মেনে তার সপক্ষে, কিন্তু সমালোচকদের সংখ্যাও বাড়ছে৷ সীমান্ত খুলে দেবার পর থেকে জার্মানি বদলে গেছে বলে ভেরিচা স্পাসোভস্কার ধারণা৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে এই এক বছরে অনেক কিছুই বদলেছে৷ খারাপের মধ্যে সবার আগে বলতে হয়, জার্মানিতে জাতিবাদি প্রবণতা বেড়েছে৷ ডানঘেঁষা এএফডি দল উদ্বাস্তু সংকটের ফলে পালে হাওয়া পেয়েছে৷ ইতিমধ্যে গোটা জার্মানিতে ১৫ শতাংশ ভোটার এএফডিকে সমর্থন করতে প্রস্তুত৷ অথচ শেষ সংসদীয় নির্বাচনে এই দল ন্যূনতম পাঁচ শতাংশ ভোটের বেড়া পার হতে পারেনি৷ অর্থাৎ জার্মানিতে বহিরাগত বিদ্বেষের চল বাড়ছে৷
ইউরোপের প্রেক্ষাপটে
তবে পরিস্থিতি পর্যালোচনার আগে ইউরোপীয় প্রেক্ষাপট স্মরণে রাখা ভালো৷ ফ্রান্স ও বুলগেরিয়ার সংসদে গোঁড়া দক্ষিণপন্থিদের বিশ শতাংশ; হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডে সরকার গঠন করেছে দক্ষিণপন্থিরা৷ ব্রিটেনের ক্ষেত্রে ব্রেক্সিটের প্রেরণা আসে বহিরাগতবিদ্বেষী ইউকিপ দলের কাছ থেকে৷ এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে জার্মানিকে এখনো মধ্যমপন্থি রাজনীতি ও স্থিতিশীলতার পরাকাষ্ঠা বলা চলে৷
চ্যান্সেলরের প্রতি জার্মানদের মনোভাবও বদলেছে, ম্যার্কেলের জনপ্রিয়তা কমেছে৷ বহু জার্মান উদ্বাস্তু সংকটের মোকাবিলা নিয়ে সন্তুষ্ট নন৷ অপরদিকে জরিপে সিডিইউ-সিএসইউ দলগুলির প্রতি সমর্থন প্রায় অপরিবর্তিতই রয়েছে৷ পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ম্যার্কেলের আগের মতোই সুনাম৷ তাঁর উদ্বাস্তু নীতি সব ইইউ দেশের মনঃপূত না হলেও, ব্রেক্সিটের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে তাঁর মতামতের এখনও দাম আছে৷ উদ্বাস্তুদের প্রতি ম্যার্কেলের মনোভাবের প্রশংসা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, ‘‘জার্মানি ইতিহাসের সঠিক দিকে’’৷ আরো অনেকেরই এই মত৷
সন্ত্রাসের আশঙ্কা বাড়ছে
উদ্বাস্তুদের প্রতি জার্মানদের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটেছে; প্রাথমিক উৎসাহের পর এখন যেন কিছুটা ক্লান্তি দেখা দিয়েছে৷ নিউ ইয়ার্স ইভে কোলন রেলওয়ে স্টেশনের ঘটনা, আন্সবাখ ও ভ্যুর্ৎসবুর্গে ইসলামপন্থি মনোভাব থেকে সংঘটিত সন্ত্রাসী আক্রমণ জার্মানদের মধ্যে ইসলামপন্থি সন্ত্রাসের আশঙ্কাকে আরো উসকে দিয়েছে৷
সব অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও জার্মানরা এখনো সাহায্য করতে চান, যেখানে সম্ভব, সেখানেই তারা সাহায্য করে থাকেন: উদ্বাস্তুদের জার্মান শেখান, যেসব অপ্রাপ্তবয়স্ক উদ্বাস্তুরা একা এসেছে তাদের আশ্রয় দেন অথবা চাকুরি খুঁজতে সাহায্য করেন৷ হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবীর সহযোগিতা ছাড়া সব কিছু এত ভালোভাবে আয়োজন করা সম্ভব হতো না৷ জার্মানিতে আজ অবধি কোনো উদ্বাস্তুকে পথে রাত কাটাতে হয়নি৷ এই পরিমাণ বদান্যতা ও সহায়তা জার্মানদের একটা সাফল্য বৈকি৷
সামনের কাজ
আসল চ্যালেঞ্জ তো এখনো সামনে৷ যাদের আশ্রয় দেওয়া হলো, জার্মান সমাজে তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে: ছোটদের স্কুলে পাঠাতে হবে, বড়দের কাজ বা চাকুরির ব্যবস্থা করতে হবে৷ তার জন্য বিপুল অর্থবিনিয়োগ করতে হবে, যার ফলে সমাজের আরেক শ্রেণির মানুষদের মধ্যে ঈর্ষা দেখা দিতে পারে৷
আবার এই উদ্বাস্তু সংকট একটা সুযোগও বটে, নিজেদের মূল্যবোধকে জোরগলায় ঘোষণা করার, বাস্তবায়িত করার একটা সুযোগ৷ এটা স্বতঃসিদ্ধ হওয়া উচিৎ যে, সব উদ্বাস্তু থাকবেন, জার্মান শিখবেন, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক সমাজের মূল্যবোধকে সম্মান করে চলবেন, সংবিধানকে বাইবেল, কোরান প্রমুখ ধর্মগ্রন্থের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবেন এবং নারী-পুরুষের সমানাধিকারকে মেনে নেবেন৷ আইন ভঙ্গ করলে অবিলম্বে তার সাজা হবে৷ বিদেশিরা অপরাধ করলে তাদের শীঘ্র বহিষ্কার করা হবে৷
সংহতি
উদ্বাস্তু সংকট জার্মানদের আরামের জীবন থেকে ঠেলে তুলে অনেক নতুন দাবি, নতুন চ্যালেঞ্জ ও নতুন সুযোগের মুখোমুখি করেছে৷ বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষদের একসঙ্গে হওয়ার মধ্যে একটা বিরাট সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, যদি উদ্বাস্তুদের এই অনুভূতি দেওয়া সম্ভব হয় যে, তারা জার্মানির, জার্মান সমাজের অংশ৷ অপরদিকে উদ্বাস্তুরা জার্মানি থেকে যে টাকা বাড়ি পাঠাচ্ছেন, তা জার্মান উন্নয়ন সাহায্যের চেয়ে বেশি৷
জার্মানরা যদি উদ্বাস্তুদের সমস্যা হিসেবে না দেখে, বাস্তবিক পরিস্থিতি বিচার করেন, তাহলে তারা বুঝবেন যে, বিপন্ন মানুষদের সঙ্গে সংহতি একটি সমাজকে আরো জোরদার করে৷ সেক্ষেত্রে আমরা একদিন বলতে পারব, ‘‘ভালোই তো যে, জার্মানি বদলে গেছিল!’’
হাঙ্গেরি সার্বিয়ার সঙ্গে তার সীমান্ত বন্ধ করে দেবার পর তথাকথিত বলকান রুটে উদ্বাস্তুর স্রোত ক্রোয়েশিয়ার দিকে যেতে শুরু করেছে৷ অস্ট্রিয়াও এবার হাঙ্গেরি সীমান্তে বাছাই নিয়ন্ত্রণ চালু করেছে৷
দীর্ঘ পথ
তুরস্কের এডির্নে শহরের কাছে সিরীয় উদ্বাস্তুরা ছোটদের কোলে করে পায়ে হেঁটে চলেছেন গ্রিক সীমান্তের দিকে৷
ছবি: Reuters/O. Orsal
সব বাধা পার হয়ে
গ্রিস আর ম্যাসিডোনিয়ার সীমান্তে গেভগেলিয়া শহরে তারের বেড়ার ধারে এক অভিবাসী শিশু৷ শুধুমাত্র ১৪ই সেপ্টেম্বরের রাত্রেই সাড়ে সাত হাজারের বেশি উদ্বাস্তু ম্যাসিডোনিয়ায় ঢোকেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Atanasovski
প্রবেশ নিষেধ
১৫ই সেপ্টেম্বর থেকে সার্বিয়ার সঙ্গে হাঙ্গেরির সীমান্ত চার মিটার উঁচু কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঢাকা৷ শত শত উদ্বাস্তু সীমান্ত কেন্দ্রে নাম লেখাতে পারেন বটে, আবার ক্ষেত্রবিশেষে বহিষ্কৃতও হতে পারেন৷ বেআইনিভাবে সীমান্ত পার হওয়ার সাজা তিন বছর অবধি কারাদণ্ড, কাঁটাতারের বেড়ার ক্ষতি করলে পাঁচ বছর৷
ছবি: DW/N. Rujević
সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ জোরদার হচ্ছে
অস্ট্রিয়া আর হাঙ্গেরির মধ্যে সীমান্তে অস্ট্রিয়ান তরফে হাইলিগেনক্রয়েৎস শহর৷ মঙ্গলবার রাত্রি থেকেই বাছাইভাবে সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ চালু করার কথা ঘোষণা করে ভিয়েনা সরকার৷ স্লোভেনিয়া, ইটালি এবং স্লোভাকিয়ার সঙ্গে সীমান্তেও নাকি অনুরূপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হতে পারে, বলে জানিয়েছে অস্ট্রিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷
ছবি: dpa
রেলস্টেশনে ভিড়
অস্ট্রিয়ার সালৎসবুর্গ শহরের মুখ্য রেলওয়ে স্টেশনে উদ্বাস্তুরা অপেক্ষা করছেন জার্মানিগামী ট্রেনের৷ রবিবার জার্মানি সাময়িকভাবে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয় মিউনিখ রেলওয়ে স্টেশন – এবং শহরের উপর উদ্বাস্তু সমাগমের চাপ কমানোর আশায়৷ অবশ্য সোমবার সকালেই তা আবার তুলে নেওয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Gindl
মিউনিখে আরেক যাত্রার শুরু
মিউনিখ শহরের প্রধান রেলওয়ে স্টেশনে পথের খোঁজ দিচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তা৷ ট্রেনের জানলার কাচে যে শিশুমুখ, সে-ই তো ভবিষ্যৎ...
ছবি: DW/M. Gopalakrishnan
বলকান রুট
উদ্বাস্তুর স্রোত এবার ক্রোয়েশিয়া হয়ে উত্তরে যাবার চেষ্টা করবে৷ তাদের গন্তব্য: জার্মানি, নেদারল্যান্ডস কিংবা সুইডেনের মতো কোনো সমৃদ্ধ, স্বাগতিক দেশ৷
7 ছবি1 | 7
একটা সেলফি যেভাবে তাঁর জীবন বদলে দিয়েছে
আপনি কি সেলফির প্রতি আসক্ত? কিংবা আপনি কি একে হাস্যকর মনে করেন? আনাস মোডামানির কিন্তু ভাগ্য বদলে গেছে এক সেলফির কারণে৷ দেখুন কিভাবে:
ছবি: Anas Modamani
আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ
বার্লিনে এক শরণার্থী শিবিরে থাকার সময় আনাস মোডামানি একদিন শুনলেন যে, জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল তাদের দেখতে আসবেন এবং তাদের সঙ্গে কথাও বলবেন৷ ১৯ বছর বয়সি সিরিয়ান তরুণ, যিনি কিনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক ভক্ত, সুযোগটা হাতছাড়া করেননি৷ তিনি তখন ভাগ্য বদলের স্বপ্ন নিয়ে ম্যার্কেলের সঙ্গে একটি সেলফি তোলেন৷
ছবি: Anas Modamani
ইউরোপে পালিয়ে আসা
দামেস্কে যখন তাঁদের বাড়ির উপর বোমা পড়ে, তখন মোডামানি এবং তাঁর বাবাম ও ভাইবোনেরা গরিয়া নামক একটি ছোট্ট শহরে চলে যান৷ সেখান থেকে ইউরোপের পথে যাত্রা করেন তিনি৷ প্রথমে লেবানন, এরপর তুরস্ক হয়ে গ্রিসে৷
ছবি: Anas Modamani
বিপজ্জনক যাত্রা
মোডামানি যাত্রাপথে প্রায় মরতে বসেছিলেন৷ আরো অনেক শরণার্থীর মতো, একটা রাবার বোটে করে তুরস্ক থেকে গ্রিস আসতে হয়েছিল তাঁকে৷ মোডামানি জানান, নৌকাটি অতিরিক্ত বোঝাই ছিল এবং এক পর্যায়ে সমুদ্রে তলিয়ে যায়৷ তিনিও প্রায় ডুবে যাচ্ছিলেন৷ কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান৷
ছবি: Anas Modamani
পাঁচ সপ্তাহ পায়ে হাঁটা
গ্রিস থেকে পায়ে হাঁটা পথে মেসিডোনিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন মোডামানি৷ হাঙ্গেরি এবং অস্ট্রিয়ায় তিনি হেঁটেছেন অনেকটা পথ৷ এরপর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে পৌঁছান তাঁর চূড়ান্ত গন্তব্য মিউনিখে৷ জার্মানিতে আসার পর তিনি বার্লিনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷ তখন থেকেই তিনি বার্লিনেই আছেন৷
ছবি: Anas Modamani
রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার আশায়
বার্লিনে পৌঁছানোর পর মোডামানি বেশ ক’টা দিন কাটিয়েছেন লাগেসো শরণার্থী কেন্দ্রের সামনে৷ তিনি জানান, সেখানকার অবস্থা বেশ জটিল, বিশেষ করে শীতের সময়৷ এক পর্যায়ে তাঁকে বার্লিনের স্পানডাও অঞ্চলের শরণার্থী কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়৷ তিনি শরণার্থী হিসেবে তাঁর অবস্থা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন৷ আর ম্যার্কেলের সঙ্গে সেলফি তাঁকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে৷
ছবি: Anas Modamani
অবশেষে এক পরিবারের সন্ধান
মোডামানি জানিয়েছেন, চ্যান্সেলর ম্যার্কেলের সঙ্গে তোলা সেলফি জীবন বদলে দিয়েছে৷ সেই ছবি ইন্টারনেটে প্রকাশের পর গণমাধ্যমের নজর পড়ে তাঁর দিকে এবং একটি জার্মান পরিবার তাঁকে আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্তে নেয়৷ গত দু’মাস ধরে জার্মান পরিবারের সঙ্গে আছেন তিনি৷ আর সেই পরিবার তাঁকে পরিবারের সদস্যদের মতোই সহায়তা করছে৷
ছবি: Anas Modamani
বাড়ির কথা মনে পড়ে
জার্মান পরিবারের সঙ্গে বসবাসের পর থেকে বেশ ভালোই আছেন মোডামানি৷ জার্মান ভাষা শিখছেন এখন৷ তাঁর বেশ কিছু বন্ধুও হয়েছে৷ জার্মানিতে পড়াশোনা করতে চান তিনি৷ তবে তাঁর আপাতত লক্ষ্য হচ্ছে জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া৷ কেননা তাহলে নিজের পরিবারকে জার্মানি নিয়ে আসা সহজ হবে তাঁর জন্য৷
ছবি: Anas Modamani
শরণার্থীদের সম্পর্কে নেতিবাচক মানসিকতা
জার্মানিতে একটি উন্নত ও নিরাপদ জীবনের আশা মোডামানি৷ তবে শরণার্থীদের সম্পর্কে জার্মানির বর্তমান মনোভাব নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত তিনি৷ তাঁর আশঙ্কা, শরণার্থীদের সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব ভবিষ্যতে আরো বাড়তে পারে৷ সেক্ষেত্রে তা শরণার্থী বিষয়ক আইনের উপর প্রভাব ফেলবে৷ ফলে তাঁর আবেদন হয়ত বাতিল হবে৷ আর নিজ পরিবারকে জার্মানিতে আনার স্বপ্ন হয়ত স্বপ্নই থেকে যাবে৷