বিকৃত যৌনাচার, নিপীড়ন-নির্যাতন, ধর্ষণ কি জার্মানিতে নেই? নিশ্চয়ই আছে৷ জার্মানি নিশ্চয়ই একেবারে স্বর্গ নয়, তবে এ দেশে বিচার চাইতে কারো ভয় হয় না, বিচারের বাণী এখানে নিভৃতে কাঁদে না৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে আমার সাত বছর হলো৷ এই সাত বছরে আমার, আমার পরিবার এবং পরিচিতজনদের কম করে হলেও সাতটি ঘটনা তো বলতেই পারি, যেগুলোর মধ্যে পুলিশের কাছে যেতে ভয় পাওয়ার ঘটনা একটাও নেই৷ প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশ মনযোগ দিয়ে অভিযোগ শুনেছে৷ অনেক ক্ষেত্রে ব্যবস্থাও নিয়েছে৷ যেগুলোতে পারেনি, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আশায়ও রাখেনি, হয়রানি করা, ঘুস চাওয়া তো দূরে থাক৷ আমার কিশোর সন্তান সাইকেল খুইয়ে রাতে একা বেশ দূরের পুলিশ স্টেশনে একা গিয়েছে, পুলিশ তার কথাও গুরুত্ব দিয়ে শুনেছে৷ ভিনদেশ থেকে আসা এক কিশোর নির্ভয়ে পুলিশের কাছে যেতে পারে এবং কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা ছাড়া, বরং বিচারপ্রার্থী হিসেবে যথেষ্ট সহানুভূতি, সম্মান পেয়ে বাড়ি ফিরতে পারে— এই হলো জার্মানি৷ পুলিশের ভালো ব্যবহার, কর্তব্যপরায়নতা এখানে কাউকে অবাক করে না, পাঠককে বিস্মিত করতে সাংবাদিকরা এখানে ‘পুলিশের মহানুভবতা' শিরোনামে টুকরো খবর লিখতে বসেন না— এই হলো জার্মানি৷
যে কোনো অপরাধের শিকারের জন্য প্রাথমিকভাবে এই ভরসাটা খুব দরকার৷পুলিশের কাছে গেলে বিপদ আরো বাড়তে পারে জানলে কে যাবে অভিযোগ জানাতে?
শুধু ধর্ষণ-নির্যাতন নয়, সব অপরাধের ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীর এই আস্থাটুকু খুব দরকার৷ আর দরকার পাশের মানুষগুলোর সহানুভূতি, সহমর্মিতা এবং পাশে থেকে লড়াইয়ে শামিল না হলেও তারা কথায়-কাজে বিরুদ্ধে দাঁড়াবে না এমন নির্ভরতা৷ এই জায়গায় জার্মানি এখনো শতভাগ আদর্শ হয়ে উঠতে পেরেছে তা বলা যাবে না৷ এই কয়েকদিন আগেই এক খবরে জানলাম, এ দেশের ঘরে ঘরে পুরুষনির্যাতনও হয়, লোকলজ্জার ভয়ে এ দেশের অনেক পুরুষও বিচার চাইতে পারেন না, তাই জার্মানির দুই রাজ্য বাভারিয়া এবং নর্থরাইন ওয়েস্টফালিয়া সম্প্রতি পুরুষ নির্যাতন বন্ধের উদ্যোগ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে৷
নারীনির্যাতনও হয় এবং পুরুষনির্যাতনের চেয়ে অনেক বেশিই হয় জার্মানিতে৷ শিশুনির্যাতনও হয়৷ গত মাসে ডয়চে ভেলেতেই প্রকাশিত একটি খবরের প্রথম দুটি বাক্য ছিল এমন— ‘‘ জার্মানিতে শিশুদের যৌন নিপীড়ন, শারীরিক নির্যাতন ও হত্যা বাড়ছে৷ পুলিশ জানিয়েছে, গত বছর সারা দেশে ১০০-রও বেশি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে কয়েক হাজার শিশু৷''
সুতরাং বুঝতেই পারছেন, জার্মানি এমন স্বর্গ নয়, যেখান থেকে অনেক দূরে থাকে অপরাধী বা অপরাধপ্রবণ মানুষেরা৷এ সমাজেও কিছু মানুষের মাঝে অপরাধরাধপ্রবণতা দেখা দেয়, কিছু মানুষ তার শিকার হয়, কিন্তু দু' পক্ষই জানে সমাজ, পুলিশ, আইন-আদালত কোনোভাবেই অপরাধীর পাশে দাঁড়াবে না৷
পরিসংখ্যান অনেক দেয়া যাবে, অনেক খবর তুলে ধরে দাবি করা যাবে জার্মানিকে অপরাধশূন্য করার লড়াই সরকার বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনো জিতে যায়নি৷এ লড়াই পুরোপুরি কখনো জেতা যায় না৷ কিন্তু সভ্য দেশে অপরাধীর জন্য শাস্তির ভয় থাকে আর বিচারপ্রার্থীর জন্য থাকে বিচার পাওয়ার নিশ্চয়তা৷ বিশ্বযুদ্ধের লজ্জাজনক অতীত আছে যে দেশের, সেই দেশ কিন্তু আজ সমৃদ্ধ হয়েছে, সভ্যও হয়েছে৷
যৌন লালসার বিকৃত রূপ
পাঁচ-ছয় বছরের শিশু থেকে শত বছরের বৃদ্ধা, কেউ বাদ যাননি ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে৷ ঘর, গণপরিবহন আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- সব জায়গাতেই ঘটেছে এসব ঘটনা৷ ছবিঘরে দেখে নিন যৌন লালসার এমন বিকৃত রূপের চিত্র৷
ছবি: bdnews24.com/A. Mannan
লালসার শিকার ছয় বছরের সায়মা
রাজধানীর ওয়ারীতে প্রতিবেশীর ফ্ল্যাটে খেলতে গিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছে ছয় বছরের শিশু আফরিন সায়মা৷ সম্প্রতি এই ঘটনা ব্যাপক আলোচনা ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে৷ ধর্ষককে গ্রেপ্তারের পর তার বাবার আবেগধর্মী বক্তব্যে আলোড়িত হয়েছেন সবাই৷
এমন ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, নিজের প্রতিবেশও কতোটা অনিরাপদ নারী ও শিশুর জন্য৷
ছবি: bdnews24.com
১২ ছাত্রীর ধর্ষক মাদ্রাসা অধ্যক্ষ
নারায়ণগঞ্জে ১২ ছাত্রীকে ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা ও যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আল আমিন৷ গ্রেপ্তার আল আমিন ১২ ছাত্রীকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি অভিযোগ স্বীকার করেছেন বলে র্যাব৷
ছবি: bdnews24.com
শত বছরের বৃদ্ধাকে ধর্ষণ!
মে মাসে টাঙ্গাইলে শত বছর বয়সি অন্ধ বৃদ্ধাকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে ১৫ বছর বয়সি এক কিশোরের বিরুদ্ধে৷ ওই কিশোর বৃদ্ধার ঘরে ঢুকে মুখ বেঁধে তাঁকে ধর্ষণ করেছে বলে জানায় পুলিশ৷ গ্রেফতার কিশোর সোহেল ধর্ষণের অভিযোগ স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ৷
আগুনে পুড়ল নুসরাত
ফেনীতে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করার জেরে আগুনে পুড়তে হলো নুসরাত জাহান রাফিকে৷ অধ্যক্ষের পক্ষ নিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ কয়েকজন ওই কাণ্ড ঘটায়৷ নুসরাতকে হত্যার আগে নিপীড়ক অধ্যক্ষ সিরাজের পক্ষে মানববন্ধনও হতে দেখা গেছে৷ নারায়ণগঞ্জ আর ফেনীর ঘটনা প্রকাশ করছে, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও অনিরাপদ নারীরা৷
ছবি: picture-alliance/M. Rashid
রাজনীতির বিরোধে ধর্ষণ!
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ভোটের রাতে ধর্ষণের ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়৷ এরপর নোয়াখালীতেই আরেকটি ভোট কেন্দ্র করে ছয় সন্তানের জননীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে৷ ধর্ষণে রাজনীতির সংযোগ নারীর জন্য সমাজকে ঝুঁকিপূর্ণই করছে৷ এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনের পরও দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধর্ষণের ঘটনায় ব্যাপক প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছিল৷
ছবি: bdnews24.com
ছয় মাসে ভিকটিম ৩৯৯ শিশু
মানবাধিকার সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের হিসাব বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত সারা দেশে ৩৯৯ শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে৷ এর মধ্যে আটজন ছেলে শিশু রয়েছে৷ ধর্ষণের পর ১৫জন মেয়ে শিশু ও এক ছেলে শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে৷ অন্যদিকে, ছয় মাসে ৬৩০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য৷
ছবি: Bilderbox
পাঁচ মাসে ৩০০ মামলা
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে সারা দেশে শিশু ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৩০০-এর কিছু বেশি৷ আর গত পাঁচ বছরে মোট শিশু ধর্ষণ মামলার সংখ্যা ছিল ৩ হাজারের কিছু বেশি৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregor
কিনারা হয়নি তনু হত্যার
কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার তদন্ত তিন বছরেও শেষ হয়নি৷ তনুর পরিবারের অভিযোগ, স্থবির হয়ে আছে তদন্তকাজ৷ ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস এলাকার থেকে তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়৷ ঘটনার সঙ্গে সেনাসদস্যরা জড়িত বলে অভিযোগ তনুর পরিবারের৷
ছবি: Twitter
আলোচিত রূপা হত্যা
২০১৭ সালের আগস্টে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে কলেজছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রূপাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়৷ ওই মামলায় চারজনকে ফাঁসি ও একজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
ক্রসফায়ার কি সমাধান?
ধর্ষককে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যার ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে৷ ধর্ষককে ক্রসফায়ারে পক্ষে রাস্তায় দাঁড়াতেও দেখা গেছে৷ এমনকি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে একাধিকবার ধর্ষককে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যার কথা বলেছিলেন জাতীয় পার্টির সংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ৷ আইনের শাসনের প্রতি আস্থাহীনতার প্রমাণ হিসাবে দেখা দিয়েছে এসব ঘটনা৷