আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর জার্মানিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে৷ এরপর একজন নতুন চ্যান্সেলর দায়িত্ব নেবেন৷ তার আগে সম্ভবত শেষবারের মতো রাশিয়া ও ইউক্রেন সফর করেছেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷
ছবি: Michael Kappeler/dpa/picture alliance
বিজ্ঞাপন
সাম্প্রতিক সময়ে জার্মানি-রাশিয়া সম্পর্কের আলোচনায় অন্যতম বড় ইস্যু হয়ে উঠেছিল ‘নর্ড স্ট্রিম দুই' প্রকল্প৷ রাশিয়া থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরাসরি জার্মানির বাল্টিক উপকূলে গ্যাস আনার জন্য এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে৷
রাশিয়ার সঙ্গে জার্মানির এমন প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি শুরু থেকেই বিতর্কিত ছিল৷ তবে সাম্প্রতিক সময়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের সবচেয়ে বিরোধী আলেক্সেই নাভালনিকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টার পর নর্ড স্ট্রিম দুই প্রকল্প থেকে জার্মানিকে বের হয়ে যেতে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল৷
তবে চ্যান্সেলর ম্যার্কেল দীর্ঘদিন ধরে এই প্রকল্পকে শুধুই একটি অর্থনৈতিক প্রকল্প বলে আখ্যায়িত করে এসেছেন৷ যদিও জার্মানির রাজনৈতিক দল এফডিপির পররাষ্ট্রবিষয়ক মুখপাত্র আলেকজান্ডার গ্রাফ লাম্বসডর্ফ মনে করেন, নর্ড স্ট্রিম দুই প্রকল্প জার্মানির পররাষ্ট্রনীতির অনেক ক্ষতি করেছে৷
জার্মানি-রাশিয়া সুসম্পর্কের পথে ৬টি বাধা
সোচি শহরে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের বৈঠকে ইরান সম্পর্কে ঐকমত্যে এলেও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে দুই দেশের গভীর মতপার্থক্য রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Schreiber
হ্যাকিং হামলা
জার্মানিতে সাইবার হামলার নেপথ্যে কিছু রুশ রাষ্ট্রীয় সংস্থা রয়েছে বলে জার্মানির গোয়েন্দা সংস্থা মনে করে৷ ২০১৫ সালে জার্মানির সংসদের নিম্নকক্ষ বুন্ডেসটাগসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও ফাউন্ডেশনের উপর এমন হামলা হয়েছিল৷ ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জার্মানির সরকারি নেটওয়ার্কের উপর সাইবার হামলার ক্ষেত্রেও রাশিয়া জড়িত বলে সন্দেহ করা হয়৷ সেই হামলায় অনেক তথ্য চুরি হয়েছিল৷
ছবি: Imago/T. Trutschel
সিরিয়ায় রাশিয়ার ভূমিকা
সিরিয়ার নেতা বাশার আল আসাদকে মদতের কারণে রাশিয়াও সে দেশে যুদ্ধাপরাধের দোসর হয়ে উঠেছে বলে জার্মানি মনে করে৷ জার্মান সরকার সিরিয়ার দুমায় রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের তীব্র নিন্দা করেছে৷ এই ঘটনায় কমপক্ষে ৬০ জনের মৃত্যুর পর পশ্চিমা দেশগুলির সামরিক হামলায় অংশ না নিলেও জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল রাশিয়ার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন৷
ছবি: Reuters/O. Sanadiki
রাশিয়ার ক্রাইমিয়া দখল
২০১৪ সালের মার্চ মাসে রাশিয়া যেভাবে ইউক্রেনের ক্রাইমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নিয়েছে, জার্মানির মতে, তার ফলে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে৷ রুশ প্রেসিডেন্ট পুটিন এর মধ্যে রুশ ভূখণ্ড থেকে ক্রাইমিয়ার মধ্যে একটি সেতুও উদ্বোধন করেছেন৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে জার্মানিও এই বিবাদের ক্ষেত্রে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে৷
ছবি: Reuters/P. Rebrov
গোয়েন্দা সংস্থার অস্বাভাবিক তৎপরতা
ব্রিটেনে প্রাক্তন রুশ গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপাল ও তাঁর কন্যার উপর বিষ প্রয়োগের পেছনে রাশিয়ার হাত ছিল বলে সে দেশের সরকার নিশ্চিত৷ জার্মানিও এই হামলার নিন্দা করেছে এবং তথ্যপ্রমাণ যাচাই করে ব্রিটেনের দাবি মেনে নিয়েছে৷ অন্য কিছু দেশের মতো জার্মানিও কয়েকজন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে৷ এছাড়া ইইউ দেশগুলিতে ভুয়া খবর ছড়ানোর পেছনেও রুশ গোয়েন্দা সংস্থার হাত রয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়৷
পূর্ব ইউক্রেনে অগ্রগতির অভাব
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে সংকট কাটাতে মিনস্ক শহরে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, রাশিয়া তা লঙ্ঘন করে চলেছে বলে মনে করে জার্মানিসহ পশ্চিমা জগৎ ফ্রান্স, রাশিয়া ও ইউক্রেনের উচ্চ পর্যায়ের কূটনীতিকদের ‘নর্মান্ডি কনট্যাক্ট গ্রুপ’-এর কাঠামো সত্ত্বেও দেশগুলি৷ ইউক্রেন ও রাশিয়া সীমান্তে লাগাতার সংঘর্ষ চলে আসছে৷ জার্মান চ্যান্সেলর ম্যার্কেল পুটিনের উদ্দেশ্যে রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের রাশ টানার ডাক দিয়ে আসছেন৷
ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও হয়রানি
রাশিয়ায় আসন্ন ফুটবল বিশ্বকাপের আসরে ডোপিং বিশেষজ্ঞ এক সাংবাদিকের উপস্থিতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল রাশিয়া৷ জার্মানি কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে তাঁর ভিসার ব্যবস্থা করতে পেরেছে বটে, কিন্তু সব ক্ষেত্রে এমন সাফল্য অর্জন করা যাচ্ছে না৷ যেমন, ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ইউরোপীয় প্ল্যাটফর্ম’ নামের এক জার্মান এনজিও-কে অযাচিত ঘোষণা করেছে রাশিয়া৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Krasilnikov
6 ছবি1 | 6
‘সবচেয়ে খারাপ সম্পর্ক'
জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের পূর্ব ইউরোপ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ইয়ানিস ক্লুগে মনে করেন, সোভিয়েত পরবর্তী সময়ে বার্লিন ও মস্কোর মধ্যে সম্পর্ক এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে৷ এক্ষেত্রে তিনি তিনটি বড় সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন৷
প্রথমত, দেশের ভিতর স্বাধীন গণমাধ্যম, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী ও এনজিওদের বিরুদ্ধে রাশিয়া ক্রমেই চাপ সৃষ্টি করে চলেছে৷
দ্বিতীয়ত, ইউরোপে রাশিয়ার গোয়েন্দাদের কার্যক্রম৷ প্রত্যক্ষ হামলা ছাড়াও জার্মানির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উপর কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটছে৷
তৃতীয়ত, ইউক্রেন সংকট৷ এ ব্যাপারে যতদিন না কোনো উন্নতি হচ্ছে ততদিন রাশিয়ার উপর আস্থা ফিরবেনা৷
এদিকে, জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা স্টেফান মাইস্টারও মনে করেন, জার্মানি ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক এখন খারাপ অবস্থায় আছে৷ তবে সমাধানের ক্ষেত্রে জার্মানির কিছু করণীয় আছে বলে মনে করেন তিনি৷ ‘‘রাশিয়ায় কী করা সম্ভব সে ব্যাপারে আমাদের আরও বাস্তবসম্মত হতে হবে এবং যারা পরিবর্তিত রাশিয়া চায় তাদেরও সমর্থন করতে হবে,'' বলেন তিনি৷
‘মুক্ত গণতন্ত্রের প্রতিপক্ষ'
বার্লিনভিত্তিক থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর লিবারেল মডার্নিটির (রুশ সরকারের ‘অনাকাঙ্খিত সংস্থার' তালিকায় নাম ওঠায় এই সংস্থাকে মস্কোর কার্যক্রম বন্ধ করতে হয়েছে) পরিচালক রাল্ফ ফ্যুকস বলেন, ‘‘পুটিনের রাশিয়া পশ্চিমের মুক্ত গণতন্ত্রের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে৷''
তিনি মনে করেন, নির্বাচনের পর যিনি জার্মান চ্যান্সেলর হবেন তার কাজ হবে সংঘাত ও সহযোগিতার মধ্যে সম্পর্ক খাপ খাইয়ে নেয়া৷ রাশিয়ার সঙ্গে জার্মানি ও ইইউর সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাকে একটি স্পষ্ট ‘রেড লাইন'ও এঁকে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি৷