লেবাননের হেজবোল্লাহ গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে নিষিদ্ধ করায় জার্মানির তীব্র সমালোচনা করেছে ইরান৷ তেহরানের মতে, আইএস-এর মতো ‘আসল' সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে এর ফল ভোগ করতে হবে৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে হেজবোল্লাহর কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে এই গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা দেবার সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছে ইরান৷ এই সিদ্ধান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের স্বার্থসিদ্ধি করছে বলে শুক্রবার ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম দাবি করেছে৷ জার্মানিকে এই সিদ্ধান্তের পরিণাম ভোগ করতে হবে বলে ইরান হুমকি দিয়েছে৷ বিশেষ করে পশ্চিম এশিয়ায় আসল সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রামে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করে ইরান৷
উল্লেখ্য, অ্যামেরিকা ও ইসরায়েল বেশ কিছুকাল ধরে জার্মানির কাছে এই পদক্ষেপ দাবি করছিল৷ দুই দেশই জার্মানির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে৷
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আব্বাস মুসাভি বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘পশ্চিম এশিয়ার বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা না করে এবং শুধু ইসরায়েলের জায়নিস্ট প্রচারণা যন্ত্র ও অ্যামেরিকার বিভ্রান্ত প্রশাসনের লক্ষ্যকে গুরুত্ব দিয়ে ইউরোপের কিছু দেশ নিজস্ব অবস্থান স্থির করছে বলে মনে হচ্ছে৷’’ জার্মানির সরকার হেজবোল্লাহর বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসী পদ্ধতিতে সশস্ত্র সংগ্রামে মদত' দেবার যে অভিযোগ এনেছে, মুসাভি সেই অবস্থানেরও সমালোচনা করেন৷ তিনি বলেন, এই গোষ্ঠী লেবাননের সরকার ও সংসদের ‘আনুষ্ঠানিক ও আইনসঙ্গত’ সদস্য এবং ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা’ রক্ষা করার অন্যতম শক্তি৷ তাই এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে লেবানন রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি চরম অসম্মান দেখানো হয়েছে বলে ইরান দাবি করছে৷ ইরান মনে রিয়ে দিয়েছে, যে, তথাকথিত জঙ্গি সংগঠন ‘ইসলামিক স্টেট’-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে হেজবোল্লাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে৷
বৃহস্পতিবার জার্মানির পুলিশ সারা দেশে হেজবোল্লাহর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত মসজিদ ও সমিতি ভবনে তল্লাশি চালিয়েছে৷ জার্মানির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞার ফলে কোনো সমাবেশ, প্রকাশনা এবং সংবাদ মাধ্যমে হেজবোল্লাহর প্রতীক আর দেখানো যাবে না৷ এই গোষ্ঠীর বিষয়সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা যেতে পারে৷
ইউরোপে হেজবোল্লাহ গোষ্ঠী সম্পর্কে এখনো কোনো সাধারণ নীতি গ্রহণ করা হয়নি৷ এই গোষ্ঠীর সামরিক শাখাকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর তালিকায় স্থান দিয়েছে বটে, তবে হেজবোল্লাহর রাজনৈতিক শাখা সম্পর্কে কোনো একক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি৷ ইইউ ত্যাগ করার আগে গত বছর ব্রিটেন হেজবোল্লাহকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় স্থান দেয়৷ নেদারল্যান্ডসও এই গোষ্ঠীর সব কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করেছে৷
এসবি/এসিবি (রয়টার্স, এএফপি)
হেজবোল্লাহর পরিচয়
লেবাননের ইরান সমর্থিত আধাসামরিক গোষ্ঠী হেজবোল্লাহ৷ তাদের একটি রাজনৈতিক দল আছে, আছে একটি সামরিক শাখাও৷ সম্প্রতি তাদের শক্তি বেড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Zaatari
ইতিহাস
১৯৮২ সালে ইসরায়েলের দক্ষিণ লেবানন দখলের প্রেক্ষিতে মুসলিম নেতারা মিলে হেজবোল্লাহ গড়ে তোলেন৷ হেজবোল্লাহ শব্দের অর্থ ‘আল্লাহর দল’৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সাধারণ নাগরিকদের সমর্থন
দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েলকে চলে যেতে বাধ্য করেছিল হেজবোল্লাহ৷ এরপর ২০০৬ সালে ইসরায়েল ও হেজবোল্লাহ আরেক দফা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল৷ ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ থেকে লেবাননকে রক্ষার কারণে শিয়াপন্থি হেজবোল্লাহর প্রতি সুন্নিসহ অন্য গোত্রের মানুষ ও লেবাননের সমাজে তাদের প্রতি এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Zaatari
ইরান ও সিরিয়ার সমর্থন
শুরু থেকেই দেশ দুটি হেজবোল্লাহকে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে এসেছে৷ বর্তমানে হেজবোল্লাহর সামরিক শাখা লেবাননের সামরিক বাহিনীর চেয়ে শক্তিশালী এবং সে অঞ্চলে তারা অন্যতম আধাসামরিক গোষ্ঠী হয়ে উঠেছে৷
ছবি: Reuters/O. Sanadiki
রাজনৈতিক শাখা
১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলা লেবাননের গৃহযুদ্ধের পর হেজবোল্লাহ রাজনীতির দিকে মনোযোগ দেয়া শুরু করে৷ হাসান নাসরাল্লাহ (ছবি) ১৯৯২ সালে হেজবোল্লাহর রাজনৈতিক অংশের নেতৃত্বে আসেন৷ বর্তমানে দেশটির শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের একটি বড় অংশ এবং খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মীয় গোত্রের সঙ্গে তাদের সখ্য গড়ে উঠেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সশস্ত্র শাখা
গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর অন্যান্য গোষ্ঠীর মতো হেজবোল্লাহ অস্ত্র ত্যাগ করেনি৷ প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির দলসহ অন্যান্য দলগুলো হেজবোল্লাহকে অস্ত্র ত্যাগের আহ্বান জানালেও তারা তা মানেনি৷ হেজবোল্লাহর যুক্তি, ইসরায়েল ও বাইরের অন্যান্য শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে অস্ত্র প্রয়োজন৷
ছবি: picture-alliance/AA
সন্ত্রাসী গোষ্ঠী?
যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, ক্যানাডা ও আরব লিগের দেশগুলোর দৃষ্টিতে হেজবোল্লাহ একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী৷ কিন্তু যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হেজবোল্লাহর বৈধ রাজনৈতিক শাখা ও তাদের সামরিক শাখাকে ভিন্ন চোখে দেখে৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/I. Press
সিরিয়ার যুদ্ধে হেজবোল্লাহ
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অন্যতম সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে হেজবোল্লাহ৷ আসাদের টিকে থাকার পেছনে তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Syrian Central Military Media
শিয়া-সুন্নি উত্তেজনা বৃদ্ধি
অনেক দিন ধরেই লেবাননকে ঘিরে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই চলে আসছে৷ হেজবোল্লাহর রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিবৃদ্ধি এবং সিরিয়া যুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণ লেবাননসহ অত্র অঞ্চলে শিয়া-সুন্নি উত্তেজনা বাড়িয়েছে৷
ছবি: dapd
ইসরায়েলর সঙ্গে নতুন দ্বন্দ্ব?
সিরিয়া যুদ্ধে অংশ নেয়ার মাধ্যমে ইরান ও হেজবোল্লাহ তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব বাড়িয়েছে৷ বিষয়টিকে ইসরায়েল হুমকি হিসেবে দেখছে৷ ফলে সিরিয়ায় ইরান/হেজবোল্লাহর লক্ষ্যবস্তুতে বার কয়েক হামলাও করেছে ইসরায়েল৷ ইরান ও হেজবোল্লাহ সিরিয়ায় স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করুক, সেটি চায় না ইসরায়েল৷ ফলে ইসরায়েল ও হেজবোল্লাহর মধ্যে আরেকটি যুদ্ধ শুরুর আশংকা দেখা দিয়েছে, যেখানে ইরানও জড়িয়ে পড়তে পারে৷