অভিবাসন আর অ্যাসাইলামের কথা উঠলেই আজকাল জার্মানরা মাথা গরম করে বসেন৷ এই পরিস্থিতিতে ফেডারাল অভিবাসন ও উদ্বাস্তু কার্যালয় ‘বাম্ফ’-এর কেলেঙ্কারি গোলমাল আরো বাড়িয়েছে, বলে ডয়চে ভেলের ইয়েন্স টুরাউয়ের ধারণা৷
বিজ্ঞাপন
অথচ পরিসংখ্যান বলছে যে, উদ্বাস্তু পরিস্থিতি ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসছে৷ দু'বছর আগে জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের ৬২ শতাংশ মঞ্জুর হতো; ২০১৭-র প্রথম কয়েক মাসে তা নেমে দাঁড়ায় মাত্র ৩২ শতাংশে৷ দু'বছর আগে কর্তৃপক্ষ বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুদের আগমনে দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন – আজ তাদের কর্মীসংখ্যা বেড়েছে, উদ্বাতুদের ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া আরো অনেক দক্ষ ও সংগঠিত হয়েছে৷
পপুলিস্টদের পালে হাওয়া
ঠিক এই সময়েই অভিবাসন কর্তৃপক্ষের কিছু কিছু শাখার চরম ব্যর্থতার খবর জার্মানিকে টলিয়ে দিল৷ বিশেষ করে ব্রেমেনে দৃশ্যত অপরাধমূলক কার্যকলাপ ঘটেছে: এক কথায়, ব্রেমেনে যত রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছে, তা আর কোথাও নয়৷ একটি বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রধান দৃশ্যত জ্ঞানত জুয়াচুরি করেছেন: এমন সব মামলার দায়িত্ব নিয়েছেন, যা তাঁর এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না – ফলে প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন মঞ্জুর হয়েছে৷
ইউরোপে বাংলাদেশিদের আশ্রয় পাওয়ার হার বাড়ছে
ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান বিষয়ক সংস্থা ‘ইউরোস্ট্যাট’-এর গত ১০ বছরের হিসেব বলছে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের আশ্রয়ের আবেদন সফল হওয়ার হার বাড়তির দিকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. de Sakutin
তিন ধরনের সুরক্ষা
শরণার্থী, হিউম্যানিটারিয়ান ও সাবসিডিয়ারি – এই তিন ক্যাটাগরিতে আশ্রয় দেয়া হয়ে থাকে৷ যাঁরা শরণার্থী স্ট্যাটাসের যোগ্য নন, কিন্তু দেশে ফিরে গেলে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ার ঝুঁকিতে আছেন, তাঁদের সাবসিডিয়ারি সুরক্ষা দেয়া হয়৷ আর অসুস্থতা ও অভিভাবকহীন শিশুদের মানবিক (হিউম্যানিটারিয়ান) বিবেচনায় আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/R. Schlesinger
২০১৭
বাংলাদেশি নাগরিকদের পক্ষ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গতবছর ১৬,০৯৫টি আশ্রয়ের আবেদন পড়েছে৷ আর একই সময়ে বাংলাদেশিদের করা ২,৮৩৫টি আবেদন সফল হয়েছে৷ শতকরা হিসেবে সেটি ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ৷ জার্মানিতে আবেদন পড়েছে ২,৭২৫টি৷ সফল হয়েছে ৩১৫টি৷ এমনিভাবে অন্য কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান এরকম – যুক্তরাজ্য (আবেদন ১,৬৩০; সফল ৬৫), ইটালি (আবেদন ৫,৭৭৫; সফল ১,৮৮৫) এবং ফ্রান্স (আবেদন ৪,১১৫; সফল ৪৪০)৷
ছবি: imago/Cronos
২০১৬
বাংলাদেশিরা ১৪,০৮৫টি আবেদন করেছেন৷ ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে ২,৩৬৫টি৷ অর্থাৎ সফলতার হার ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ৷ কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান – জার্মানি (আবেদন ৬৬৫; সফল ১১০), যুক্তরাজ্য (আবেদন ১,৪০৫; সফল ৮০), ইটালি (আবেদন ৬,২২৫; সফল ১,৬১০) এবং ফ্রান্স (আবেদন ৪,১১০; সফল ৪৪০)৷
ছবি: picture alliance/dpa/D. Kalker
২০১৫
সেবছর সফলতার হার ছিল ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ৷ আবেদন পড়েছিল ১১,২৫০টি৷ ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ১,৭৮৫টি৷ কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান – জার্মানি (আবেদন ২৬৫; সফল ৩৫), যুক্তরাজ্য (আবেদন ১,০১৫; সফল ১২০), ইটালি (আবেদন ৫,০১০; সফল ১,২২৫) এবং ফ্রান্স (আবেদন ৩,৫৬০; সফল ৩১৫)৷
ছবি: Imago/Frank Sorge
২০১৪
আবেদন ৭,৫৮০টি৷ সফল ৭৮৫৷ শতকরা হার ১০ দশমিক ৩৷ কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান – জার্মানি (আবেদন ৪৬৫; সফল ৫০), যুক্তরাজ্য (আবেদন ৭০০; সফল ৭৫), ইটালি (আবেদন ৭৩৫; সফল ৩১৫) এবং ফ্রান্স (আবেদন ৩,৮৭০; সফল ২৬৫)৷
ছবি: Megan Williams
২০১৩
সফলতার হার ৭ দশমিক ১ শতাংশ৷ আবেদন ৮,৩৩৫৷ সফল ৫৯৫৷ কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান – জার্মানি (আবেদন ২৫০; সফল ২০), যুক্তরাজ্য (আবেদন ৮৩০; সফল ৫৫), ইটালি (আবেদন ৫৯০; সফল ৩০০) এবং ফ্রান্স (আবেদন ৩,৬১৫; সফল ১৪৫)৷
ছবি: picture alliance/robertharding/A. Robinson
২০১২
সফলতার হার ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ৷ কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান – জার্মানি (আবেদন ১৯০; সফল ১০), যুক্তরাজ্য (আবেদন ৮০০; সফল ৫০), ইটালি (আবেদন ১,৪১০; সফল ১,০৪৫) এবং ফ্রান্স (আবেদন ৩,৭৫৫; সফল ৮৫)৷
ছবি: Imago/Rainer Weisflog
২০১১
সফলতার হার ২ দশমিক ৮ শতাংশ৷ কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান – জার্মানি (আবেদন ১১০; সফল ০), যুক্তরাজ্য (আবেদন ৪৮০; সফল ৪০), ইটালি (আবেদন ৮৬৫; সফল ৬৫) এবং ফ্রান্স (আবেদন ৩,৭৭০; সফল ৪৫)৷
ছবি: picture-alliance/ZUMAPRESS.com/M. Cohen
২০১০
সফলতার হার ৪ দশমিক ৮ শতাংশ৷ কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান – জার্মানি (আবেদন ১০৫; সফল ০), যুক্তরাজ্য (আবেদন ৪৬০; সফল ৫৫), ইটালি (আবেদন ২১৫; সফল ৪০) এবং ফ্রান্স (আবেদন ২,৪১০; সফল ২৫)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/T. Uhlemann
২০০৯
সফলতার হার ৩ দশমিক ৮ শতাংশ৷ কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান – জার্মানি (আবেদন ৪০; সফল ০), যুক্তরাজ্য (আবেদন ৩৭৫; সফল ৪৫), ইটালি (আবেদন ৮৮৫; সফল ৮৫) এবং ফ্রান্স (আবেদন ১,৭৮০; সফল ৩৫)৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. de Sakutin
২০০৮
সফলতার হার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ৷ কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান – জার্মানি (আবেদন ৪০; সফল ০), যুক্তরাজ্য (আবেদন ৩৯৫; সফল ৯৫), ইটালি (আবেদন ৯৫০; সফল ৫০) এবং ফ্রান্স (আবেদন ১,৬৬০; সফল ৩৫)৷
ছবি: picture alliance/dpa/D. Kalker
৩২ দেশের হিসাব
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮ সদস্যরাষ্ট্র এবং ‘ইউরোপিয়ান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট’ বা ইএফটিএ-এর অন্তর্ভুক্ত আইসল্যান্ড, লিখটেনস্টাইন, নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ডের পরিসংখ্যান অন্তর্ভুক্ত করেছে ইউরোস্ট্যাট৷ আরও পরিসংখ্যান জানতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Megan Williams
12 ছবি1 | 12
উদ্বাস্তুদের আগমন যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, তখন ফেডারাল অভিবাসন ও উদ্বাস্তু কার্যালয় ‘বাম্ফ’-এর ব্রেমেন শাখার কর্মীরা দৃশ্যত কাজের চাপ সামলাতে না পেরে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের প্রায় বিনা পরীক্ষাতেই অ্যাসাইলাম দিয়েছেন৷ পরে গাফিলতি ঢাকার চেষ্টা করলে পরও, সংশ্লিষ্ট কেলেঙ্কারি জার্মানির যাবতীয় দক্ষিণপন্থি পপুলিস্ট ও বহিরাগত বিদ্বেষিদের নতুন ইন্ধন জুটিয়েছে৷
‘বাম্ফ’-এর মতো একটি সরকারি বিভাগ, সারা দেশে যাদের প্রায় ১০০টি কার্যালয় ও বেশ কয়েক হাজার কর্মী আছে – সেখানে ভুল তো অবশ্যই হতে পারে, বিশেষ করে যদি তাদের ওপর হঠাৎ কোনো বড় চাপ আসে, ২০১৫ সালের উদ্বাস্তু সংকটের সময় যেমন এসেছিল৷ কিন্তু ‘বাম্ফ’-এর আরো সতর্ক হওয়া উচিৎ ছিল, কেননা অধিকাংশ জার্মান রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদানের প্রক্রিয়াটিকে অত্যন্ত জটিল ও দুর্বোধ্য বলে মনে করেন৷ ‘বাম্ফ’-এর কোনো অফিসে সন্দেহজনক কিছু ঘটছে, বলে যদি তারা আঁচ পান, তবে তাদের সন্দেহ বাতিক চরমে যে চরমে উঠবে, তা স্বাভাবিক৷ তদন্ত সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ব্রেমেন অফিসকে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া বিরত করা হয়েছে – সন্দিগ্ন দেশবাসীদের প্রতি একটি সঠিক সংকেত৷
সংসদের বিরোধীদলগুলির মধ্যে এফডিপি ও এএফডি একটি সংসদীয় তদন্ত কমিটির ধুয়ো তুলেছে – যদিও তাতে কোনো লাভ হবে না৷ বিশেষ করে এএফডি এই কমিটিকে চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের উদ্বাস্তু নীতির সমালোচনা করার কাজে লাগাবে, কেননা এএফডি সব ধরণের অভিবাসনের বিরোধী; রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদানের প্রক্রিয়া কাজ করল কি না করল, তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই৷
উদ্বাস্তুদের ‘উকিল’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং
নতুন জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সিএসইউ দলের হর্স্ট জেহোফারকে এবার দেখাতে হবে যে, পরিস্থিতি মাত্রা ছাড়ানোর আগেই তিনি এই কেলেঙ্কারির মোকাবিলা করতে সক্ষম৷ সিএসইউ প্রধান ও বাভেরিয়ার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি গত তিন বছর ধরে চ্যান্সেলর ম্যার্কেলের উদ্বাস্তু নীতির তীব্র সমালোচনা করে এসেছেন৷ এখন তিনি নিজেই ফেডারাল অভিবাসন ও উদ্বাস্তু দপ্তরের – এবং সেখানে যে অগুনতি সৎ ও পরিশ্রমী কর্মীরা কাজ করেন, তাদের সর্বেসর্বা৷ স্বভাবতই ঐ কর্মীরা তাদের দপ্তরের সুনাম নিয়ে চিন্তিত৷
শুধু ‘বাম্ফ’-এর সৎ কর্মচারীদের জন্যই নয়, এক হিসেবে জেহোফারকে উদ্বাস্তুদের হয়েও ওকালতি করতে হবে – বিশেষ করে সেই সব উদ্বাস্তু, যারা বৈধ ও ন্যায্যভাবে জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের অধিকার পেয়েছেন৷ ব্রেমেন কেলেঙ্কারিতে একদিকে যেমন তদন্ত চলবে, অন্যদিকে তেমন খেয়াল রাখতে হবে, যাতে যাবতীয় রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীকে নির্বিচারে দোষী সাব্যস্ত না করা হয়৷