আজকের এই ডিজিটাল যুগে গ্রহ-নক্ষত্রের ছবির মানও যে ভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই৷ মহাকাশের কঠিন পরিবেশে অতি উচ্চ মানের ছবি তোলে যে ক্যামেরা, তার বেশ কয়েকটি তৈরি করেছে জার্মানির এক প্রতিষ্ঠান৷
বিজ্ঞাপন
মহাকাশের চমক, জার্মান ক্যামেরা দিয়ে
04:11
পৃথিবীর ক্যামেরা দিয়ে কি আর মহাকাশে ছবি তোলা চলে? এক বিশেষ ক্যামেরা দিয়ে গবেষকরা আলোর সাতটি তরঙ্গদৈর্ঘ্যে ছবি তুলতে পারেন৷ সেই ছবি দিয়ে বহু দূরের জগতে ধাতুর অনুপাতও বিশ্লেষণ করতে পারেন তাঁরা৷
মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা-র ‘ডন' মহাকাশযানে প্রায় ৮ বছর ধরে উড়ে চলেছে এমন একজোড়া ক্যামেরা৷ ‘ভেস্টা' নামের গ্রহাণু ও ‘সেরেস' নামের এক বামন গ্রহ পরীক্ষা করাই তার কাজ৷ এই দীর্ঘ যাত্রাপথে ক্যামেরার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গবেষকদের অনেক ব্যবস্থা করতে হয়েছে৷ এমপিআই-এর প্রধান প্রফেসর উলরিশ ক্রিস্টেনসেন বলেন, ‘‘কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে চালু থাকাই এই ক্যামেরার চ্যালেঞ্জ৷ যেমন অতি নিম্ন বা উচ্চ তাপমাত্রায়৷ মহাজাগতিক রশ্মি সামলাতে হবে৷ ক্যামেরাকে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্যও হতে হবে৷ যানটি মাত্র একবার ওড়ার সুযোগ পাচ্ছে, তাই মেরামতির কোনো উপায় নেই৷''
নিভে যাওয়া তারা
সৃষ্টির সব কিছু নশ্বর৷ আকাশের তারাও অনন্তকালের জন্য নয়৷ তারাদের যখন মরণ ঘটে, তখন তারা রেখে যায় মহাকাশে এক আশ্চর্য বর্ণালী৷
ছবি: NASA
আকাশ ভরা সূর্য তারা
সব মানুষই কখনো না কখনো ভেবেছেন, আকাশে কত তারা....জ্বলছে, দপ দপ করছে৷ কিন্তু অনন্তকালের জন্য নয়৷ তারাদেরও মরণ আছে, যদিও তা আসবে লক্ষ কোটি বৎসর পরে...৷
ছবি: Ye Aung Thu/AFP/Getty Images
তারারা বাঁচে হাইড্রোজেন থেকে
আমাদের সূর্যও একটি তারা৷ তারারা গ্যাস ও প্লাজমা – অর্থাৎ ঘনীভূত তরল পদার্থ – দিয়ে তৈরি৷ আলো বিকিরণ করে৷ তারার ভেতরে হাইড্রোজেন মেলে হিলিয়ামের সঙ্গে, ফলে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি শক্তি উৎপাদিত হয়৷ কিন্তু কালে হাইড্রোজেন ফুরিয়ে আসে৷ তখন তারার শেষ দশা৷
ছবি: AP/NASA
সাদা বামন
সব তারা একভাবে ‘বুড়ো’ হয় না! হালকা তারাগুলো – যাদের ‘মাস’ বা পদার্থ হয়ত আমাদের সূর্যের এক-তৃতীয়াংশ – সেগুলো হাইড্রোজেন ফুরোলেই নিভে যায়; শুকিয়ে, কুঁকড়ে গিয়ে হয়ে দাঁড়ায় ‘হোয়াইট ডোয়ার্ফ’ বা ‘সাদা বামন’৷ দুঃখের বিষয়, সাদা বামনদের কোনো ছবি নেই – কিন্তু তারার হিসেবে তারা অতি ছোট, অনেকটা আমাদের পৃথিবীর মতো – যদিও ঘনত্ব অনেক বেশি৷ এই সাদা বামনরা এখনও খানিক উত্তাপ ছড়ায়, যদিও তা-ও একদিন অন্তর্হিত হবে৷
ছবি: NASA and H. Richer (University of British Columbia)
লাল দৈত্য
বড়, ভারী তারাগুলোর মরণ ঘটে একটু অন্যভাবে৷ হাইড্রোজেন ফুরোলেই তাদের তাপ বাড়ে অস্বাভাবিকভাবে৷ তাপমাত্রা দশ কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে পৌঁছালে হিলিয়াম পুড়তে শুরু করে! হিলিয়াম পুড়ে সৃষ্টি হয় কার্বন ও অক্সিজেন৷ তারাটা তখন ফুলে উঠে ‘রেড জায়ান্ট’ বা লাল দৈত্যের আকার ধারণ করে৷ এই সব লাল দৈত্য আমাদের সূর্যের ৮০০ গুণ এবং সূর্যের চেয়ে লক্ষ লক্ষ গুণ উজ্জ্বল হতে পারে৷
ছবি: NASA
মুমূর্ষু তারার শেষ নিঃশ্বাস
লাল দৈত্যরা বহুকাল ধরে স্থিতিশীল থাকে৷ কিন্তু আয়তন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ত্বক টেনে লম্বা হয়ে যায় ও ঘনত্ব হারায়৷ অপরদিকে তারার ভিতরের অংশ আরো ঘন হয় এবং তার তাপমাত্রা বাড়ে৷ তারাটা আর শক্তপোক্ত থাকে না৷ এমনকি তার ত্বক পুরোপুরি খসে যেতে পারে৷ সেই ত্বক তখন গ্রহতারকার নেবুলা হয়ে মহাকাশে ভেসে বেড়ায়৷ ছবিতে যেমন আমাইজেন নেবুলা বা পিঁপড়ের নেবুলা৷ ছবিটা তোলা হয়েছে হাবল টেলিস্কোপ থেকে৷
ছবি: NASA/R. Sahai
মুমূর্ষু তারার ভুতুড়ে আলো
ইএসও ৩৭৮-১ নেবুলার এই ছবিটি তোলা হয়েছে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার উত্তর চিলিতে স্থাপিত ‘ভেরি লার্জ টেলিস্কোপ’ দিয়ে৷ নেবুলাটির ডাকনাম হল ‘দক্ষিণের প্যাঁচা’৷ প্যাঁচাটির ব্যাস প্রায় চার আলোকবর্ষ!
ছবি: ESO
সুপারনোভা
খুব ভারী তারা থেকে সৃষ্ট লাল দৈত্যরা সব হিলিয়াম পুড়ে যাওয়ার পরও জ্বলতে থাকে৷ ফিউজন বা গলনের প্রক্রিয়া চলতে থাকে, তাপমাত্রা ক্রমেই আরো বাড়তে থাকে৷ শেষমেষ লাল দৈত্যটি একটি চমকপ্রদ সুপারনোভা বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায়৷ ধ্বংসের আগে ঐ একটি তারা একটা গোটা নক্ষত্রপুঞ্জের মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে৷
ছবি: NASA
7 ছবি1 | 7
জার্মানির মাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউটের সৌরজগত গবেষণা শাখার বহু দশকের অভিজ্ঞতা এমন স্পেস ক্যামেরা তৈরির ক্ষেত্রে কাজে লেগেছে৷ বায়ুমণ্ডল গবেষণার মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরু হয়েছিল৷ ১৯৪৬ সালে গ্যোটিঙেন শহরের কাছে ছোট একটি শহরে সেটি স্থানান্তরিত করা হয়৷ রেডিও বার্তার জন্য গবেষকরা প্রথমে বায়ুমণ্ডলে ইলেকট্রিক চার্জ পরীক্ষা করতেন৷ এরপর নীচের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার নিয়েও তারা গবেষণা করেন৷ রকেট ও বেলুন পাঠিয়ে প্রথম পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন তাঁরা৷ এমপিআই-এর প্রাক্তন প্রধান পেটার চেকভস্কি বলেন, ‘‘বলতেই হবে, যে আমাদের ভাগ্য সত্যি ভালো ছিল৷ আমরা এতজন যোগ্য কর্মী পেয়েছিলাম৷ তাছাড়া সে সময়ে ক্যামেরার জন্য ডিটেক্টরও ছিল নতুন এক ক্ষেত্র৷ কাজেই অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন ছিল৷''
সাফল্য অবশ্যই এসেছিল৷ মহাকাশবিজ্ঞানের ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে৷ ইউরোপের প্রথম ইন্টারপ্ল্যানেটারি গবেষণা স্যাটেলাইটে এমপিআই-এর ক্যামেরা স্থান পেয়েছিল৷ ১৯৮৬ সালে প্রথম ধূমকেতু অভিযানের সময় তা থেকে চমকপ্রদ ছবি পাওয়া গিয়েছিল৷
এরপর ২০০৫ সালে ‘হিগেন্স' নামের যান যখন শনিগ্রহের রহস্যজনক চাঁদ টাইটান-এর কাছে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনও মাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউটের ক্যামেরা সেই ঐতিহাসিক ঘটনার ছবি তুলেছিল৷ সৌরজগতের বহির্সীমায় সেটাই ছিল কোনো যানের প্রথম অবতরণের ঘটনা৷
১৯৯৭ সালে মঙ্গলগ্রহে ‘পাথফাইন্ডার' অভিযানের সময়ে তোলা ছবির জন্য টেলিভিশন পুরস্কারও জুটেছিল৷ এই প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের চাবিকাঠি কী? অধ্যাপক উলরিশ ক্রিস্টেনসেন বলেন, ‘‘আমার ধারণা, এর তিনটি কারণ রয়েছে৷ প্রথমত চাই এমন বিজ্ঞানী, যাঁদের মাথায় চোখ-ধাঁধানো যন্ত্রপাতি তৈরির আইডিয়া রয়েছে৷ তারপর চাই এমন ভালো ইঞ্জিনিয়ার এবং টেকনিশিয়ান, যাঁরা এই সব আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে পারেন৷''
সাড়ে বারো হাজার কিলোমিটার দূর থেকে ছবি
নয় বছর ঘুরে ঘুরে অবশেষে প্লুটোর কাছে গেল মহাকাশযান নিউ হরাইজন্স৷ কাছে মানে, ১২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরে৷ সেখান থেকেই তোলা হয়েছে ছবি৷ এ নিয়েই ছবিঘর৷
ছবি: Reuters/NASA/APL/SwRI
এই প্রথম....
মহাবিশ্বে ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হলো মানব সভ্যতা৷ ১৪ই জুলাই সৌরজগতের শেষ সীমায় প্লুটোর সবচেয়ে কাছ দিয়ে, অর্থাৎ ১২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূর দিয়ে উড়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা-র তৈরি মহাকাশযান নিউ হরাইজন্স৷
ছবি: JHUAPL/SwRI
মানুষহীন মহাকাশযান থেকে ছবি...
নাসার তৈরি মহাকাশযান নিউ হরাইজন্সে কিন্তু কোনো মানুষ নেই৷ স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরাই তুলেছে ছবি৷ ক্যামেরা খুব শক্তিশালী বলেই সাড়ে বারো হাজার কিলোমিটার দূর থেকেও এমন ছবি তুলতে পেরেছে নিউ হরাইজন্স৷ সাড়ে বারো হাজার কিলোমিটারকে বেশি দূর মনে হচ্ছে? পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কিন্তু এর চেয়ে ৩০ গুণ বেশি!
ছবি: Reuters/NASA/APL/SwRI
ঐতিহাসিক মুহূর্ত
২০০৬ সালের ১১ই জানুয়ারি ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল এয়ারফোর্স স্টেশন থেকে নিউ হরাইজন্সকে উৎক্ষেপণ করে নাসা৷ মহাকাশযানটিকে পাঠানো হয় প্লুটো নিয়ে গবেষণায় সহায়তার জন্য৷ সেই থেকে চলছিল প্রতীক্ষা – কবে প্লুটোর কাছাকাছি যাবে, কবে পাঠাবে ছবি! ১৪ই জুলাই মেরিল্যান্ডে নাসার অভিযান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে সবাই ছিলেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায়৷ ছবি দেখামাত্রই তাই উল্লাসে ফেটে পড়েন সবাই৷
নিউ হরাইজন্সের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, প্লুটোর ব্যস ২ হাজার ৩৭০ কিলোমিটার৷ আরেকটি বিষয়, প্লুটোকে আগে সবাই গ্রহ বলতেন, কিন্তু নিউ হরাইজন্স উৎক্ষেপণের পর থেকে এর নাম হয়েছে ‘বামন গ্রহ’৷
ছবি: Reuters/NASA New Horizons
যেখান থেকে শুরু
২০০৬ সালের ১১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার এই কেপ ক্যানাভেরাল এয়ারফোর্স স্টেশন থেকেই যাত্রা শুরু করেছিল নিউ হরাইজন্স৷ সেই থেকে মহাকাশযানটি ছুটেই চলেছে সেকেন্ডে ১৬ কিলোমিটার বেগে৷
ছবি: NASA
তুলনা
সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ বুধ, শুক্র, পৃথিবী এবং মঙ্গল৷ বামন গ্রহ সেরেসের পরে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন৷ দু’টি ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো দেখাচ্ছে প্লুটো এবং তার চাঁদ শ্যারনকে৷ এই বিন্দুর মতো প্লুটোর ব্যাসই প্রায় ২,৩৭০ কিলোমিটার৷ আগে একে আরো বড় মনে করা হতো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিশাল ক্যামেরা
এটি নিউ হরাইজন্সে ক্যামেরা সংযোজনের সময়ের ছবি৷ লং রেঞ্জ রিকনেসেন্স ইমেজ, সংক্ষেপে ‘লরি’ নামের এই ক্যামেরার ওজন ৮ দশমিক ৬ কিলোগ্রাম৷ ক্যামেরার প্রায় পুরোটা জুড়েই আছে বেশ বড় এক দূরবীন৷ দূরবীনটির ওজন ৫ দশমিক ৬ কিলোগ্রাম৷
ছবি: NASA
7 ছবি1 | 7
সেইসঙ্গে অবশ্যই এমন ওয়ার্কশপও চাই, যেখানে হাইটেক ক্যামেরার যন্ত্রাংশ তৈরি হয়৷ নতুন ইনস্টিটিউটে তার জন্য যথেষ্ট জায়গাও রয়েছে৷ সেখানে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে ভবিষ্যতের প্রকোশলীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়৷ ভবিষ্যতের গবেষণা অভিযানে এমন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হবে৷ সেখানে ভবিষ্যতের অপটিকাল যন্ত্রপাতি সৃষ্টি হচ্ছে৷ এক হাইটেক টেলিস্কোপ সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্র সম্পর্কে নতুন তথ্য সংগ্রহ করবে৷ এর জন্য প্রয়োজন নিখুঁত পরিমাপ৷ অথচ তার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নেই৷ তাপমাত্রার বিশাল তারতম্য সামলানোও কঠিন কাজ৷ তার উপর রয়েছে সৌর বাতাসের উপদ্রব৷ এমপিআই-এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সামি সোলাংকি বলেন, ‘‘এগুলি চার্জড পার্টিকেল – অর্থাৎ বাইরে থেকে বিদ্যুত এসে শর্ট সার্কিট সৃষ্টি করতে পারে৷ সে ক্ষেত্রে আমাদের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে৷ যেমন সেগুলি এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে পার্টিকেল কোনো ক্ষতি করতে না পারে৷''
গবেষকরা ভবিষ্যতেও বড় মহাকাশ সংস্থাগুলির কাছ থেকে অর্ডারের আশা করছেন৷ যেমনটা সৌর টেলিস্কোপের ক্ষেত্রে ঘটেছিল৷ অন্যান্য টিমও প্রস্তাব পাঠিয়েছিল, তবে বরাত পেয়েছে এমপিআই৷