সাভারে ভবন ধসের খবর ও ছবি জার্মানিতেও অনেকের মনকে নাড়া দিয়েছে৷ তৈরি পোশাকের আমদানিকারি দেশ ও ভোক্তা হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব নিয়েও চলছে তুমুল তর্ক-বিতর্ক৷ সম্প্রতি জার্মান টেলিভিশনে এক টক শো-তেও বিষয়টির নানা দিক উঠে এলো৷
বিজ্ঞাপন
গ্যুন্টার ইয়াউখ-এর টক শো-য় দেখানো হলো রানা প্লাজার ধ্বংসাবশেষে মৃতদের একটি ছবি, সেখানে পড়ে থাকা পোশাকের স্তূপের মধ্যে একটি ফুল-আঁকা জামা৷ জামাটি জার্মানির ‘কিক' কোম্পানির দোকানে পাওয়া যায়৷ অনুষ্ঠানের আয়োজক হুবহু সেই জামাটিই কিনেছে৷ দাম প্রায় ১০ ইউরো৷ তার মধ্যে শ্রমিকের পাওনা নাকি মাত্র ১২ সেন্ট৷ অর্থাৎ সেই পাওনা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করলেও দামে তেমন হেরফের হবে না৷ কিন্তু তাদের সেই পাওনা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, তার কোনো পথ অবশ্য বাতলে দিতে পারলেন না উপস্থিত বক্তারা৷
আরও প্রশ্ন উঠছে, সস্তার এই জামাটি কিনে জার্মান ক্রেতারাই কি বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ক্ষতি করছে না? নাকি দায়-দায়িত্ব আসলে জার্মান কোম্পানি, জার্মান দোকান অথবা জার্মান সরকারের? আরেক দল বলছে, আসল দায় বাংলাদেশের সরকার, প্রশাসন ও তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের৷ তাদের উপর বড়জোর বাইরে থেকে চাপ সৃষ্টি করা যায় বটে, কিন্তু একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ খুঁটিনাটি বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব নয়৷
মৃত্যুকূপ থেকে যেভাবে ফিরলেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ এই সতের দিন তিনি কিভাবে কাটিয়েছেন? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
সুস্থ আছেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ তিনি এখন সুস্থ আছেন৷ কিন্তু ধসে পড়া রানা প্লাজার মধ্যে কিভাবে সতের দিন কাটিয়েছেন তিনি? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন ছবিতে উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Reuters
উদ্ধার অভিযান
১০ মে স্থানীয় সময় বিকেল সোয়া ৩টার দিকে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক ধসে পড়া ভবনের মধ্যে বেঁচে থাকা একজন মানুষের উপস্থিতি টের পান৷ সেই মানুষটি রেশমা৷ তিনি একটি ভাঙা পাইপ দিয়ে নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং তাঁকে বাঁচানোর অনুরোধ জানান৷ এরপর রড কেটে ভিতরে ঢুকে বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে রেশমাকে বাইরে নিয়ে আসা হয়৷
ছবি: Getty Images/STRDEL
যেভাবে টিকে ছিলেন রেশমা
১৭ দিন রেশমা কি খেয়ে টিকে ছিলেন সেই প্রশ্ন অনেকের৷ উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক জানান, ‘‘রেশমা যে তলায় আটকে ছিলেন সেটা অন্যান্য তলার মতো মিশে যায়নি৷ সেখানে হাঁটা-চলা এবং নড়া-চড়া করার কিছুটা সুযোগ ছিল৷ রেশমা তাঁকে জানান যে, ঐ জায়গায় বিভিন্ন ধরনের শুকনা ও জুস জাতীয় খাবার ছিল, যা তিনি খেয়েছেন৷ ৭ মে শুকনা খাবার শেষ হয়ে যায় আর রসালো খাবার যায় পচে৷ ফলে শেষের দু’দিন ধরে তিনি অভুক্ত ছিলেন৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
চিকিৎসকের ব্যখ্যা
ধ্বংসস্তূপের নীচে রেশমার এই ১৭দিন বেঁচে থাকার ঘটনাকে ডয়চে ভেলের কাছে ব্যাখা করেছেন মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. মনি লাল আইচ৷ তিনি বলেন, ‘‘রেশমা ১৭ দিনে হৃদরোগ বা নিউরোলোজিক্যাল সমস্যায় পড়তে পারতেন৷ হয়ত মানসিক জোর এবং বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছার কারণেই তাঁকে সেই সমস্যায় পড়তে হয়নি৷ আর গবেষণায় প্রমাণিত যে নারীদের মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি৷’’
ছবি: Reuters
গোটা বিশ্বে আলোড়ন
রেশমাকে ১৭ দিন পর জীবিত উদ্ধারের খবরে গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত সাভারে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এই তরুণীকে দেখতে যান৷ রেশমাকে কেউ যাতে মানসিকভাবে পীড়া না দেয় সেজন্যও সবাইকে নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা৷
ছবি: dapd
তৃতীয় নারী রেশমা
১৭ দিন ধরে অন্ধকারে ডুবে থাকা রেশমাকে উদ্ধারের খবরের সঙ্গে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বিবিসি৷ এতে দেখা যাচ্ছে, এর আগে পাকিস্তানে একই রকম পরিস্থিতিতে নাকাশা বিবি নামক এক নারী পচা খাবার আর পানি খেয়ে টিকে ছিলেন ৬৩ দিন৷ আর হাইতির ইভান্স মোনসিজনাক টিকে ছিলেন ২৭ দিন৷ এই সময়ের পর তাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: Getty Images
পরিবারের সঙ্গে দেখা
রেশমার মা জোবেদা খাতুন, দুই ভাই ও বোন আসমা গত কয়েকদিন ধরেই রয়েছেন সাভারে৷ হাসপাতালে রেশমার সঙ্গে দেখা করেছেন তারা৷ রেশমার বড় ভাই জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘‘বর্তমানে রেশমা ভালো আছে, সুস্থ আছে৷’’
ছবি: Reuters
বাড়ছে মৃতের সংখ্যা
এদিকে, সাভারে ভবন ধসে মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে৷ গত ২৪ এপ্রিল ভবন ধসের পর ১২ মে অবধি উদ্ধার করা হয়েছে ১,১২৭ টি মৃতদেহ৷ নিহতদের মধ্যে ঠিক কতজন নারী আর কতজন পুরুষ – সেই হিসেব এখন আরা জানা যাচ্ছে না৷ অনেক মরদেহ পচে গেছে৷ গোটা বিশ্বে স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম ভবন ধস এটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তবুও কি সতর্ক আমরা?
সাভার ভবন ধসের পর কতটা সতর্ক হয়েছে বাংলাদেশ? এই প্রশ্ন অনেকর মনে৷ বিশেষ করে, যে পোশাক খাত বাংলাদেশকে গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলছে, সেই খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তায় সরকার কতটা সচেষ্ট? সর্বশেষ খবর হচ্ছে, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক শিল্পের যে নেতিবাচক ‘ইমেজ’ তৈরি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতেই এই পদক্ষেপ৷
ছবি: Reuters
‘আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক’
শান্তিতে নোবেল জয়ী বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনূস গত ৯ মে একটি নিবন্ধের একাংশে লিখেছেন, ‘‘সাভার ট্র্যাজেডি জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক৷ রানা প্লাজার ফাটল ফেটে ভবন ধসে দেখিয়ে দিলো আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে বিশাল ফাটল ধরেছে সেটা আমলে না নিলে জাতিও এরকম ধসের ভেতর হারিয়ে যাবে৷’’
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
অনুষ্ঠানে উপস্থিত জার্মান উন্নয়ন সাহায্য মন্ত্রী ডির্ক নিবেল মনে করেন, বাংলাদেশের সরকারকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে, যাতে তারাই তৈরি পোশাক কারখানার পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারে৷ কারণ অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সরকার কিন্তু সমস্যাগুলি চিহ্নিত করতে পেরেছে৷ তবে বাংলাদেশে দুর্নীতি নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেন নিবেল৷
রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার পর যেটুকু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাপই দায়ী বলে মনে করেন নারী অধিকার কর্মী গিজেলা বুয়র্কহার্ট৷ যে সব কারখানা শ্রমিকের অধিকার ও মানবাধিকার অমান্য করছে, তাদের পণ্যের উপর শুল্ক চাপানোর প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছে ইইউ৷ ঠিক তারপরই তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিক সংগঠনগুলি সক্রিয় হতে দিতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ৷
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রাক্তন শ্রমিক নাজমা আক্তার৷ তিনি জার্মান দর্শকদের কাছে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের অবস্থার বর্ণনা দেন৷ কোনো এক পক্ষ নয়, গোটা ব্যবস্থাকেই তিনি বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী করেন৷
জার্মান পোশাক ব্যবসায়ী সিনা ট্রিংকভাল্ডার বলেন, জার্মানি তথা ইউরোপে দোকানে পোশাক কেনার সময় বোঝার উপায় নেই, সেটি ঠিক কোথায় তৈরি হয়েছে৷ এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে৷ যেমন বাংলাদেশে পোশাক তৈরির প্রায় সব কাজ সেরে ফেলে ইউরোপের কোনো দেশে শেষ পদক্ষেপ নিলেও তার উপর ‘মেড ইন ইউরোপ' ছাপ পড়ে যায়৷ পোশাক ব্যবসায়ী টোমাস টাংকাই মনে করেন, পুরোটাই টাকার খেলা৷ দক্ষিণ ইউরোপে পোশাক শিল্পকে শক্তিশালী করে তুললে বাংলাদেশের উপর চাপ বাড়বে৷ তখন বাংলাদেশের পরিস্থিতির উন্নতি হবে৷
ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাংবাদিক রঙ্গা যোগেশ্বর মনে করেন, রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার পর প্রায় ৩০টি পশ্চিমা কোম্পানি মিলে বাংলাদেশে শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয়ে ঐকমত্যে এসেছে বটে, কিন্তু তারা সেই বিধিমালা না মানলে শাস্তির কোনো বিধান নেই৷
টেলিভিশন আলোচনায় আরও একটি বিষয় উঠে এলো৷ ইউরোপে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বেশ সস্তায় বিক্রি হলেও বাংলাদেশে অনেক ভোক্তা বেশি দাম দিয়ে নিজেদের দেশে তৈরি পোশাক কেনেন৷