জার্মান নির্বাচন: ইশতেহারে অভিবাসন নিয়ে কী বলছে এএফডি?
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
চলতি বছরের নির্বাচনে অভিবাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ জার্মানির কট্টর ডানপন্থি দল এএফডি নিজেদের ইশতেহারে অভিবাসন বিষয়ে কী বলছে তার বিশ্লেষণ রইল প্রতিবেদনে৷
১১ ও ১২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দলের সম্মেলনে নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করেছে কট্টর ডানপন্থি রাজনৈতিক দল এএফডি৷ আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে চ্যান্সেলর হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন৷
নির্বাচনের আগে করা জনমত জরিপে দেখা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এএফডি৷
নিজেদের ইশতেহারে রাজনীতি, অর্থনীতি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নানা বিষয়েই কথা বলেছে দলটি৷ তবে অভিবাসন নিয়ে দলটির অবস্থান অন্য দলগুলোর চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন৷
দলটি বলছে, ‘‘জার্মানির নাগরিকত্ব কাউকে উপহার হিসেবে দেওয়া উচিত নয়৷’’ ১৯৯০ সালের আগের জার্মান জাতীয়তার ধারায় ফিরে যেতে চায় এএফডি৷ সেসময় জার্মান নাগরিকত্ব পেতে কোনো শিশুর বাবা কিংবা মা কোনো একজনের জার্মান নাগরিক হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল৷
জার্মানিকে ‘আশ্রয়ের স্বর্গ' হতে দেওয়া হবে না
জার্মানিতে আশ্রয় পাওয়ার যেই ব্যবস্থা তা কঠোর করতে চায় দলটি৷ দলটি মনে করে, আশ্রয়প্রার্থীদের যে সুযোগসুবিধা দেওয়া হচ্ছে তা অনেক বেশি এবং এর ফলে জার্মান অর্থনীতিতে চাপ পড়ছে৷
এএফডির দাবি, আশ্রয় প্রদান করতে গিয়ে জার্মানি কোটি কোটি ডলার খরচ করছে৷ এক্ষেত্রে দলটি আশ্রয়আবেদন যাচাইবাছাই এবং সাবসিডিয়ারি সুরক্ষায় আশ্রয়ের আবেদন জার্মানির বাইরে অন্য কোনো দেশ থেকে করতে চায়৷
ঝুঁকিতে থাকা আফগানদের জন্য প্রদেয় ফেডারেল অ্যাডমিশন প্রোগ্রাম বাতিল করতে চায় তারা৷
ভূমধ্যসাগরে বেসরকারি সংস্থার জাহাজগুলোর উদ্ধারকাজ বন্ধ করতে চায় এএফডি এবং এর পরিবর্তে উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর সাথে চুক্তি করে সাগরপথে অভিবাসীদের আগমন থামানোর ইচ্ছা তাদের৷ উল্লেখ্য, ভূমধ্যসাগরে নিয়োজিত উদ্ধারকারী জাহাজের অনেকগুলোই জার্মানির বেসরকারি খাতের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে৷
আশ্রয়প্রার্থী ও শরণার্থী
আশ্রয়প্রদান এবং শরণার্থীদের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে দলটি৷
এএফডি বলছে, আশ্রয় চাওয়া ব্যক্তির আবেদনের সাথে তার পরিচয়পত্র ও জাতীয়তার সনদ প্রদান করতে পারলেই আবেদন গ্রহণ করা হবে৷ আবেদনের সময়ে মিথ্যা তথ্য প্রদান করলে প্রার্থী আশ্রয় পাওয়ার অধিকার হারাবে৷
সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশন বা অস্থায়ী সুরক্ষার আওতায় থাকা ব্যক্তিদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাওয়া পারিবারিক পুনর্মিলনের অধিকার বাতিল করা হবে৷
শরণার্থীর মর্যাদা পাওয়া ব্যক্তিরা শুধুমাত্র ১০ বছর পর স্থায়ী বসবাসের অনুমতির আবেদন করতে পারবেন৷ প্রতিবছর যাচাইবাছাই করে দেখা হবে, তাদেরকে আশ্রয়ের সুবিধা প্রদান চালিয়ে যাওয়া উচিত কি না৷
আশ্রয়ের জন্য আবেদন করা ব্যক্তিদের একটি বিশেষ কেন্দ্রে রাখা হবে৷ আশ্রয় আবেদন যাচাইবাছাইয়ের সময়ে তাদেরকে এই কেন্দ্রে অবস্থান করতে হবে৷
প্রত্যাবাসন
প্রত্যাবাসন বিষয়ে নতুন এক পদ্ধতি চালু করতে চায় এএফডি৷ প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ের উল্লেখ করেছে দলটি৷ এর একটি হলো, আশ্রয় চাওয়া ব্যক্তিদেরকে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো৷ আর দ্বিতীয়টি হলো, ডাবলিন নীতি অনুযায়ী, আশ্রয় আবেদনকারী ব্যক্তি প্রথমে ইউরোপের যেই দেশে প্রবেশ করেছিল সেই দেশে ফেরত পাঠানো৷
এএফডি বলছে, ইউরোপের বাইরের যে দেশগুলো তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে আগ্রহী নয় তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করা হবে৷ এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা কিংবা ওই দেশের সাথে চলমান উন্নয়ন প্রকল্প কিংবা ভিসা নীতি থামিয়ে দেওয়া৷
অপরাধের সাথে যুক্ত হলে কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে তাৎক্ষণিকভাবে ওই ব্যক্তিকে তৃতীয় কোনো দেশে বা নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে৷
আশ্রয় প্রদানের ক্ষেত্রে চার্চের নীতিমালা বাতিল করা হবে এবং সরকার ও চার্চের সাথে হওয়া এই বিষয়ক চুক্তি বাতিল করা হবে৷
সিরীয়দের নিয়ে ভাবনা
জার্মানির ম্যুনস্টারের প্রশাসনিক আদালতের একটি রেফারেন্স উল্লেখ করে দলটি বলছে, গৃহযুদ্ধের কারণে সিরিয়া আর ঝুঁকিপূর্ণ দেশ নয়৷ জার্মানিতে আশ্রয় নেওয়া সিরীয়দের বিষয়ে দলটি যেই পদক্ষেপ নিতে চায় তা হলো:
অপরাধের সাথে যুক্ত কিংবা ঝুকিপূর্ণ প্রতীয়মান সকল সিরীয় নাগরিকের সুযোগসুবিধা বাতিল করা৷
সাবসিডিয়ারি সুরক্ষার আওতায় থাকা ব্যক্তিদের সুরক্ষা সুবিধা নবায়নের সুযোগ না দেওয়া৷
সিরীয়দের নিজ দেশে ফেরত নেওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট পথ বের করতে সিরিয়ার প্রশাসনের সাথে আলোচনা করা৷
সিরীয়দের নিজ দেশে ফেরত যেতে উৎসাহিত করতে ব্যাপক আকারে বিজ্ঞাপনী ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা৷
কল্যাণ সুবিধা
শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদেরর কল্যাণসুবিধার বিষয়েও প্রস্তাবনা দিয়েছে দলটি৷ এরমধ্যে রয়েছে:
বিদেশি নাগরিকদের এক বছরের বেশি সময়ের জন্য সমাজকল্যাণ সুবিধা প্রদান না করা৷ এবং পাঁচ বছর জার্মানিতে অবস্থান করার পর বিদেশিদের ওই সুবিধা পাওয়ার সুযোগ দেওয়া৷
ইউক্রেনের আশ্রয়প্রার্থীদেরকে জার্মানদের সমান সুযোগ না দিয়ে আশ্রয়প্রার্থীদের মতো সুবিধা দেওয়া৷ তাদেরকে কাজে যোগদানে উৎসাহিত করা৷
স্বাস্থ্যসেবা খাতে কর্মরত বিদেশিদের জার্মান ভাষায় দক্ষতা বাড়ানো৷ জার্মানদের জন্য সংরক্ষিত স্বাস্থ্যখাতের পড়াশোনার সুযোগ তৈরি করা৷
দেশত্যাগের আদেশ পাওয়া ব্যক্তিদের সুবিধা ন্যূনতম অবস্থায় নামিয়ে আনা৷
কোনো আশ্রয়প্রার্থী চাকরির অফার প্রত্যাখ্যান করলে তার সামাজিক সুবিধা কমিয়ে দেওয়া৷
অভিবাসনকে ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা
কট্টর ডানপন্থি এই দলটি মনে করে, বর্তমান জার্মান অভিবাসন নীতির কারণে ‘অনিয়ন্ত্রিতভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে, সরকারি টাকার খরচ বাড়ছে, মারাত্মকভাবে অপরাধ বেড়েছে এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা ও দেশের আবাসন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে'৷
এমন অবস্থার প্রেক্ষিতে অভিবাসনকে ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনতে চায় দলটি৷
তাছাড়া, গত কয়েক বছরে প্রণীত অভিবাসন বিষয়ক যেসকল আইন ‘জার্মান স্বার্থের' অনুকূলে নয় তার পরিবর্তন করার প্রতিজ্ঞা দলটির৷ জার্মানিতে থাকার যার অধিকার নেই তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়৷
সীমান্তে অনিয়মিত অভিবাসীদের পুশব্যাক করার চিন্তা দলটির৷ এর ফলে ক্রসবর্ডার অপরাধ কমে আসবে বলে মনে করছে এএফডি৷
কাজের সুযোগ
তবে জার্মানিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে দক্ষ শ্রমিকদের কাজ করার সুযোগ দিতে চায় এএফডি৷ এক্ষেত্রে দক্ষ পেশাধারী, স্বাস্থ্যকর্মী, বিজ্ঞান ও আইটি এসব খাতের কর্মীদের স্বাগত জানানো হবে৷
দলটির ইশতেহার বলছে, যে-কোনো বিদেশি শ্রমিককে কঠোর নিয়মের মাধ্যমে যোগদানের সুযোগ দেওয়া হবে৷ ইউরোপেরদক্ষ শ্রমিকদের জার্মানিতে কাজের সুযোগ দিতে চায় এএফডি৷ তবে ইউরোপের বাইরের দেশের শ্রমিকদের বেলায় তারা একটি মানদণ্ড যেমন জার্মান ভাষার দক্ষতা ইত্যাদি তৈরি করতে চায়৷ এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু খাতে তারা কাজ করতে পারবেন৷ এমনকি এক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতিও চালু করা হতে পারে৷
গণিত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের দক্ষ কর্মীদের জন্য ইইউ ব্লু কার্ড চালুর প্রস্তাব করেছে এএফডি৷
অবসরকালীন ভাতা, সামাজিক সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রেও অভিবাসীদের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছে দলটি৷ এএফডি বলছে, দক্ষ অভিবাসনের বিষয়টি সীমিত করতে চায় দলটি, যেন চাকরির শেষে তারা জার্মান সামাজিক সুরক্ষা সুবিধার ভোগী হতে না পারেন৷
জের্টান জেন্ডানসন/আরআর