জার্মান প্রেস কাউন্সিল ১৯৭৩ সালে প্রেস কোড তৈরি করে দেয়৷ জার্মান সংবাদমাধ্যমগুলি সেল্ফ-মনিটরিং-এর মাধ্যমে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে, এই হল ধারণা বা পরিকল্পনা৷ কিন্তু বাস্তবে কি তাই?
বিজ্ঞাপন
১৯৫২ সালে ফেডারাল সরকার একটি প্রেস অ্যাক্ট বা সংবাদমাধ্যম আইনের খসড়া পেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়, যার ফলশ্রুতি হিসেবে ১৯৫৬ সালে নিরপেক্ষ জার্মান প্রেস কাউন্সিল গঠিত হয়৷ সাধারণ জনতা পত্র-পত্রিকায় দোষত্রুটি দেখলে প্রেস কাউন্সিলের কাছে অভিযোগ করতে পারেন৷
জার্মান প্রেস কাউন্সিলের ১৯৭৩ সালে প্রণীত ১৫ পাতার প্রেস কোডটি সহজেই অনলাইনে পাওয়া যায়৷ মুখবন্ধে এই প্রেস কোডের ব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘‘গাইডলাইনস ফর জার্নালিস্টিক ওয়ার্ক'' বা ‘সাংবাদিকতার নীতিমালা' হিসেবে৷ সেই সঙ্গে রয়েছে ‘‘অভিযোগ দাখিল করার পদ্ধতি''৷ প্রেস কাউন্সিলের কাছে নাকি বছরে প্রায় ৭০০ অভিযোগ ও তত্ত্বতালাস আসে, যার ৫০ ভাগের সহজেই উত্তর দেওয়া যায়৷
বাকস্বাধীনতা যেখানে যেমন
আপনার দেশে বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতি কেমন? ডয়চে ভেলের দুই সাংবাদিক এই প্রশ্ন করেছিলেন সদ্য সমাপ্ত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে আগত বিভিন্ন দেশের ব্লগার, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্টদের৷
ছবি: DW/A. S. Brändlin
শাম্মী হক, অ্যাক্টিভিস্ট, বাংলাদেশ
‘‘বাংলাদেশের মানুষ তাদের মনের কথা বলতে পারেন না৷ সেখানে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই এবং প্রতিদিন পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে৷ একজন সামাজিক অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার হিসেবে আমি ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করি, যা ইসলামিস্টরা পছন্দ করেনা৷ তারা ইতোমধ্যে ছয় ব্লগারকে হত্যা করেছে৷ ফলে আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ভেনেজুয়েলা
‘‘বাকস্বাধীনতা হচ্ছে এমন এক ধারণা যার অস্তিত্ব আমার দেশে নেই৷ সাংবাদিকরা জরিমানা আর নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি এড়াতে সরকারের সমালোচনা করতে চায়না৷ সরকারের সমালোচনা করলে সাংবাদিকদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়৷ এরকম পরিস্থিতির কারণে অনেক সাংবাদিক দেশ ছেড়ে চলে গেছেন৷ দেশটির আশি শতাংশ গণমাধ্যমের মালিক সরকার, তাই সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রোমান দবরোখটভ এবং একাতেরিনা কুজনেটসোভা, সাংবাদিক, রাশিয়া
রোমান: ‘‘রাশিয়ায় সরকার আপনাকে সেন্সর করবে৷ আমাদের ওয়েবসাইটটি ছোট এবং লাটভিয়ায় নিবন্ধিত৷ ফলে আমি সেন্সরশিপ এড়াতে পারছি৷ তা সত্ত্বেও সরকার মাঝে মাঝে আমাদের সার্ভারে হামলা চালায়৷’’ একাতেরিনা: ‘‘রাশিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ ইউরোপের মানুষ রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে স্বাধীন৷ আমি আশা করছি, রাশিয়ার পরিস্থিতিও বদলে যাবে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সিরিয়া
‘‘বেশ কয়েক বছর ধরেই সিরিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ এমনকি আসাদের শাসনামল সম্পর্কে অনুমতি ছাড়া মতামতও প্রকাশ করা যায়না৷ এটা নিষিদ্ধ৷ কেউ যদি সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাহলে খুন হতে পারে৷ আমি যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনামূলক কিছু লিখি, তাহলে বেশিদিন বাঁচতে পারবো না৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
আয়েশা হাসান, সাংবাদিক, পাকিস্তান
‘‘পাকিস্তানে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’ শব্দ দু’টি খুবই বিপজ্জনক৷ এগুলোর ব্যবহার আপনার ক্যারিয়ার বা জীবন শেষ করে দিতে পারে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রাবা বেন দউখান, রেডিও সাংবাদিক, টিউনিশিয়া
‘‘আমাদের অভ্যুত্থানের একমাত্র ফল হচ্ছে বাকস্বাধীনতা৷ আমরা এখন আমাদের সরকারের সমালোচনা করার ব্যাপারে স্বাধীন৷ এবং আমি যখন আমাদের অঞ্চলের অন্য দেশের বাসিন্দাদের বাকস্বাধীনতার কথা জিজ্ঞাসা করি, তখন একটা বড় ব্যবধান দেখতে পাই৷ আমাদের দেশে দুর্নীতিসহ নানা সমস্যা আছে সত্যি, তবে বাকস্বাধীনতা কোনো সমস্যা নয়৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
খুসাল আসেফি, রেডিও ম্যানেজার, আফগানিস্তান
‘‘বাকস্বাধীনতা আফগানিস্তানে একটি ‘সফট গান৷’ এটা হচ্ছে মানুষের মতামত, যা সম্পর্কে সরকার ভীত৷ এটা চ্যালেঞ্জিং হলেও আমাদের প্রতিবেশীদের তুলনায় আমাদের অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
সেলিম সেলিম, সাংবাদিক, ফিলিস্তিন
‘‘ফিলিস্তিনে সাংবাদিকদের খুব বেশি স্বাধীনতা নেই৷ একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, সাংবাদিকরা মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করতে পারে না৷ ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করছে৷ তারা যদি ফেসবুকে তাদের মতামত জানায়, তাহলেও সরকার গ্রেপ্তার করে৷ তবে সিরিয়া বা ইরাকের চেয়ে অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
অনন্য আজাদ, লেখক, বাংলাদেশ
‘‘আমাদের দেশে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই৷ আপনি ইসলাম বা সরকারের সমালোচনা করে কিছু বলতে পারবেন না৷ ইসলামী মৌলবাদীরা ঘোষণা দিয়েছে, কেউ যদি ইসলামের সমালোচনা করে, তাহলে তাকে হত্যা করা হবে৷ আমি একজন সাংবাদিক এবং গত বছর আমাকে ইসলামিস্ট জঙ্গিরা হত্যার হুমকি দিয়েছে৷ ফলে আমাকে দেশ থেকে পালাতে হয়েছে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
9 ছবি1 | 9
প্রেস কোডের মূল গাইডলাইনগুলিতে নির্বাচনি প্রচার অভিযানের উপর কিভাবে রিপোর্টিং করতে হবে, প্রেস রিলিজে কি থাকা উচিত, জনমত সমীক্ষার ফলাফল কিভাবে প্রকাশ করতে হবে, ইত্যাদি বিষয় তো বটেই – এমনকি প্রতীকী ছবি বা পাঠকদের চিঠি-পত্রের ভালোমন্দ, সব বিষয়েই মোটামুটি একটা ধাঁচা বেঁধে দেবার প্রচেষ্টা করা হয়েছে৷ ভ্রম সংশোধন বা তথ্যের গোপনীয়তা, এ সব বিষয়ও স্বভাবতই বাদ যায়নি৷ বিজ্ঞাপনের জগৎও ঢুকে পড়েছে, যেমন এসেছে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে৷ বলতে কি, সাংবাদিকতা ও সংবাদ প্রকাশনার কাজে যতো ধরনের নীতিবিদ্যাগত সমস্যা দেখা দিতে পারে, তার সব ক'টির ক্ষেত্রে কোনো না কোনো নির্দেশ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রেস কোডে৷
কোলনের সেই রাত
তা সত্ত্বেও এমন সব পরিস্থিতি দেখা দেয়, যেখানে কোনো নীতিমালা যে খাটে অথবা খাটে না,তা বলা শক্ত৷ এমন একটি ঘটনা ছিল নববর্ষের প্রাক্কালে কোলন শহরের মুখ্য রেলওয়ে স্টেশনের সামনের চত্বরে মহিলাদের উপর হামলা৷ যারা হামলা চালিয়েছে,তাদের মধ্যে বেশ কিছু ব্যক্তিকে দেখে উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত বলে মনে হয়েছে – একাধিক ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শী এ খবর দেওয়া সত্ত্বেও মিডিয়া খবরটি প্রচার করেনি৷
যে দেশের গণমাধ্যমের কোনো স্বাধীনতা নেই
না দেশটা বাংলাদেশ নয়৷ তবে বাংলাদেশের অবস্থা যে খুব একটা সুবিধাজনক তাও নয়৷ চলুন দেখে নেই, প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স অনুযায়ী কোন দেশের গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন৷
ছবি: DW/D. Olmos
ইরিত্রিয়া
রিপোটার্স উইদাউট বর্ডার্সের প্রকাশিত ২০১৬ প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স অনুযায়ী, যে দেশটিতে গণমাধ্যমের কোনোই স্বাধীনতা নেই, সেটি হচ্ছে ইরিত্রিয়া৷ গত ২০ বছরের বেশি সময় ধরে স্বৈরশাসকের কবলে থাকে দেশটির কমপক্ষে ১৫ সাংবাদিক এই মুহূর্তে জেলে আছেন৷ প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে সবার নীচে আছে ইরিত্রিয়া৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Lopez
উত্তর কোরিয়া
ইরিত্রিয়ার পরই নীচের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে উত্তর কোরিয়া৷ কিম জুন-উনের নেতৃত্বাধীন দেশটি গত ১৫ বছর ধরেই প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সের একেবারে নীচের দিকে অবস্থান করছে৷ দেশটিতে বিদেশি সাংবাদিকদের ভিসা তেমন দেয়া হয় না, যদিও বা কেউ ভিসা পান, তাঁকে রাখা হয় কড়া নজরদারিতে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Yonhap/Kcna
তুর্কমেনিস্তান
এই দেশটিকে বলা হয় পৃথিবীর অন্যতম তথ্য কৃষ্ণ গহ্বর৷ স্বাধীনভাবে কোনো সাংবাদিক কাজ করতে চাইলে তাঁর জন্য মোটামুটি কারাভোগ এবং নির্যাতন নিশ্চিত দেশটিতে৷ ইনডেক্সে তাদের অবস্থান নীচের দিক থেকে তৃতীয়৷
ছবি: Stringer/AFP/Getty Images
ফিনল্যান্ড
এবার যাওয়া যাক, তালিকার উপরের দিকের অবস্থা৷ গত পাঁচবছর ধরেই প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সের শীর্ষে অবস্থান করছে ফিনল্যান্ড৷ দেশটির গণমাধ্যম সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা উপভোগ করে৷ তবে সেদেশের অধিকাংশ পত্রিকা দু’টি মিডিয়া গ্রুপের মালিকানায় রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/van Weel
নেদারল্যান্ডস
প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে গত একবছরে দু’ধাপ এগিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে এসেছে নেদারল্যান্ডস৷ দেশটির গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আইনিভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে৷
ছবি: Imago/SylviaxLederer
বাংলাদেশ
বাংলাদেশে গতবছর চারজন ব্লগার এবং প্রকাশক খুন হওয়ার পরও প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে কিঞ্চিৎ উন্নতি ঘটেছে৷ আগের বছরের তুলনায় দুই ধাপ এগিয়ে দেশটির অবস্থান এখন ১৪৪তম, তবে গ্লোবাল স্কোর কমেছে মাইনাস ২ দশমিক ৯৯ শতাংশ৷
ছবি: DW/A. Islam
6 ছবি1 | 6
এ নিয়ে জার্মান প্রেস কাউন্সিলের কাছে অভিযোগ এলে পর প্রেস কাউন্সিল ঘটনার প্রায় দু'মাস পরে রায় দেয় যে, সম্ভাব্য অপরাধীদের ধর্ম বা জাতিগত খবরাখবর প্রকাশ করলে বৈষম্যমূলক আচরণের সৃষ্টি হতে পারে, কাজেই প্রেস কোডে কোনোরকম রদবদল করা হবে না৷ প্রেস কাউন্সিলের পক্ষে এ কথা বলা সহজ, কিন্তু পেগিডা-র মতো ইসলাম-বিরোধী আন্দোলন স্বভাবতই তা মেনে নেয়নি এবং পূর্বাপর জার্মান মিডিয়াকে ‘‘ল্যুগেনপ্রেসে'' বা মিথ্যাচারী সংবামাধ্যম বলে অভিহিত করে চলেছে৷
অপরদিকে ‘‘জেক্সিশে সাইটুং''-এর মতো সংবাদপত্র ঘোষণা করেছে যে, তারা ভবিষ্যতে জার্মান বা বহিরাগত নির্বিশেষে অপরাধীদের জাতি-ধর্ম প্রকাশ করবে, কেননা জরিপে দেখা গেছে যে, এ জাতীয় কোনো খবর না দিলে পাঠকরা ধরে নেন যে, অপরাধী অ-জার্মান বিদেশি-বহিরাগত হতে বাধ্য৷
ব্যোমারমান ও এর্দোয়ান
জার্মানির ৪০ শতাংশ মানুষ যখন এমনিতেই মিডিয়ার সত্যবাদিতা নিয়ে দ্বিধা পোষণ করতে শুরু করেছেন, ঠিক তখনই – গত মার্চ মাসের শেষাশেষি – বিস্ফোরিত হয় তথাকথিত ব্যোমারমান কেলেংকারি৷ জার্মান টেলিভিশনে এক জার্মান সঞ্চালক তুরস্কের প্রেসিডেন্টকে জঘন্যতম গালাগাল দিয়ে লেখা একটি বিদ্রুপাত্মক লেখা পড়ে শোনান – স্যাটায়ার বা ব্যঙ্গ হিসেবে৷ ওদিকে জার্মানি তখন উদ্বাস্তুর স্রোত আটকাতে ঠিক সেই এর্দোয়ানের উপরেই নির্ভরশীল৷ এছাড়া জার্মান আইন অনুযায়ী বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের অপমান করা আবার দণ্ডনীয় অপরাধ৷
মামলা চলেছে, কিন্তু আরো বড় প্রশ্ন হল, জার্মানিতে ব্যঙ্গের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতারই বা কি হবে? আর রাষ্ট্রের স্বার্থ যেখানে জড়িত, সেখানে জার্মান প্রেস কাউন্সিল বা জার্মান প্রেস কোডই বা পরিস্থিতি কতটা সামলে উঠতে পারবে?
ক্রমশ প্রকাশ্য...৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷